সিলেবল-এর সংখ্যা, আমরা আগেই আভাস দিয়েছি, তিনে নেমেই সর্বদা ক্ষান্ত হয় না। মাঝে-মাঝে, নামবার ঝোকে, সে দুয়ে গিয়েও নামে। প্ৰবোধচন্দ্র তার ছন্দ-পরিব্রুমা গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে তার দৃষ্টান্ত দিয়েছেন :
“বাইরে কেবল/জলের শব্দ/ঝুপ ঝুপ/ঝুপ
দস্যি ছেলে/গল্প শোনে/একেবারে/চুপ।”
এখানে দুটি লাইনেই আছে তিনটি করে পর্ব ও একটি করে ভাঙা-পর্ব। প্রতি পর্বে আছে চারটি করে সিলেবল।। ব্যতিক্রম ঘটেছে শুধু প্রথম লাইনের তৃতীয় পর্বে। সিলেবল-এর সংখ্যা সেখানে শুধু যে কমেছে তা নয়, কমে একেবারে দুয়ে এসে ঠেকেছে। ছন্দের চাল তবু যে নষ্ট হয়নি, তার ব্যাখ্যা কী? ব্যাখ্যা অবশ্যই এই যে, ‘ঝুপ ঝুপকে এক্ষেত্রে আমরা টেনে “ঝুউপ-ঝুউপ” করে উচ্চারণ করি; ফলে চারের হিসেবটাও মিলে যায় (ঝু-উপ-কু-উপ), ছন্দের চালও নষ্ট হয় না।
স্বরবৃত্ত ছন্দের নিয়ম কী, আমরা জেনেছি। নিয়মের ব্যতিক্রমের কথাও জানলুম। ব্যতিক্ৰম ঘটা সত্ত্বেও ছন্দের চাল কেন নষ্ট হয় না, সেই ব্যাখ্যাটাও পাওয়া গেল। ব্যাখ্যা র্যােরা দিয়েছেন, তারা প্ৰবীণ ছান্দসিক। ছন্দশাস্ত্রে তারা পারদ্রষ্টা। তাদের পাণ্ডিত্য প্রশ্নাতীত; ধ্বনি ও উচ্চারণের হাড় হদ তারা জানেন। তাদের কথার প্রতিবাদ করব, এত বড়ো ধৃষ্টতা আমাদের নেই।
কিন্তু নিজেদের কথাটাকে জানাবার অধিকার নিশ্চয়ই আছে। আমাদের বক্তব্য আমরা এখানে পেশ করলুম।
১) “কাঁপিয়ে পাখ’, ‘তলিয়ে দেখলে’, ‘যমুনাবতী’, ‘মরে যেন সে, ‘পূজাবাটীতে’-জাতীয় পাঁচ সিলেবল সংবলিত পর্বের ক্ষেত্রে উচ্চারণকে কিছুমাত্র বিকৃত কিংবা সংকুচিত না করে (অর্থাৎ প্রতিটি শব্দকেই যথাবিধি উচ্চারণ করে) দেখেছি, স্বরবৃত্তের চাল তাতেও নষ্ট হয় না। ঠিকই থাকে।
২) তৎসত্ত্বেও যদি ছান্দসিকেরা বলেন যে, না, চাল ঠিক থাকে না, এবং ঠিক রাখবার জন্যেই উচ্চারণকে কোথাও (পর্বে যেখানে সিলেবল-এর সংখ্যা চারের বেশি) গুটিয়ে আনতে হবে, আবার কোথাও (পর্বে যেখানে সিলেবল-এর সংখ্যা চারের কম) ছড়িয়ে দিতে হবে, এবং পর্বের দৈর্ঘ্যে এইভাবে সমতা বিধান করতে ৩বে, তাহলে আমরা বিনীতভাবে প্রশ্ন করব যে, উচ্চারণের এইভাবে হ্রাসবৃদ্ধি ঘটাবার রীতি তো গানের ব্যাপারে চলে, ও-রীতি কি কবিতাতেও চলা উচিত?
কথাটা যখন উঠলই, তখন আরও মূলে গিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। জিজ্ঞেস করা যায়, স্বরবৃত্ত ছন্দে উচ্চারণকে প্রয়োজনবোধে কোথাও গুটিয়ে আনা এবং কোথাও ছড়িয়ে দেওয়া (এবং এইভাবে পর্বের দৈর্ঘ্যে সাম্যবিধান করা) যদি অত্যাবশ্যক ৩য়ই, তবে স্বরবৃত্তকে মূলত কবিতার ছন্দ বলে গণ্য করা চলে কি না।(2)
প্রশ্নটা অকারণ নয়। আমরা সকলেই জানি, সেকালের অনেক ছড়াই গানের সগোত্ৰ। ঘুমপাড়ানি ছড়া তো বটেই। “খোকা ঘুমোল পাড়া জুড়োল বগি এল দেশে”— কোলের উপরে ছেলেকে শুইয়ে একালের জননীরাও যখন এই কথাগুলি উচ্চারণ করেন তখন অজান্তেই এই কথাগুলিতে কিছুটা সুরের দোলানি লেগে যায়। (প্রসঙ্গত বলি, “খোকা ঘুমোল’ আর ‘পাড়া জুড়োল’তেও সিলেবল-এর সংখ্যা চারের বেশি।) লাগে আরও অনেক ছড়াতেই। তখন মনে হয়, এই ছড়াগুলি আসলে কবিতা নয়, গান— যা সুর সহযোগে গেয়। কথার ভূমিকা সেখানে যৎসামান্য, সুরই সেখানে ছন্দ ঠিক রাখে। (সেই সুর হয়তো খুবই এলিমেনটারি, কিন্তু তা সুরই।) আর তা-ই যদি হয়, ছড়ার কথাগুলিকে তবে কবিতার ছন্দের কড়া-ইন্ত্রি নিয়মকানুনের ফ্রেমে আঁটাবার চেষ্টা কি কিছুটা অর্থহীন হয়ে পড়ে না? কাব্যছন্দের ব্যাকরণ দিয়ে তো গীতিকা-র শরীরকে আমরা বিশ্লেষণ করতে পারিনে।
ছান্দসিকেরা এ-সম্পর্কে কী বলবেন, আমাদের জানা নেই। তবে স্বরবৃত্তের চালচলন দেখে সন্দেহ না-হয়েই পারে না যে, এই ছন্দ মূলত গানেরই ছন্দ, পরবর্তী কালে কবিতাতেও যার সার্থক ব্যবহার সম্ভব হয়েছে।
—————
1. রাতদিন তুই’-পর্বটির তিনটি সিলেবলই বুদ্ধ, সুতরাং ইচ্ছে করলেও ওখানে অতিরিক্ত কোনও সিলেবল ঢোকানো শক্ত হত। “ছাইভস্ম’ পর্বটি সম্পর্কে কিন্তু সে-কথা খাটে না। ওখানে আছে দুটি বুদ্ধ ও একটি মুক্ত সিলেবল (ছাই+ভস+স)। সুতরাং আর-একটি সিলেবল ওখানে ঢোকানো যেত। কিন্তু তা না-ঢোকানো সত্ত্বেও যে ছন্দ বেচাল হয়নি, এটুকু অবশ্যই লক্ষণীয়।
2. ‘পরিশিষ্ট’ অংশে ড. ভবতোষ দত্তের চিঠি দ্রষ্টব্য।
০৭. সব ছন্দই কি সিলেবিক
যা বলবার বলেছি। এখন ছন্দের এই ব্যাপারটাকে আর-এক দিক থেকে দেখা যাক। তিন ছন্দের শারীরিক নির্মাণের উপরে নজর রেখে ভাবা যাক যে, এদের মাত্রা বিচারের কোনও সামান্য কৌশল আছে কি না। সামান্য বলতে এখানে তুচ্ছ কিংবা নগণ্য বোঝানো হচ্ছে না। ইংরেজিতে যাকে বলে “কমন, সামান্য এখানে তা-ই। (দৃষ্টান্ত : ইংরেজদের মধ্যে কেউ রোগা, কেউ মোটা, কেউ ঢাঙা, কেউ বেঁটে, কিন্তু এসব বৈসাদৃশ্য সত্ত্বেও তাদের যে একটা কমন ফ্যাকটর’ বা ‘সামান্য লক্ষণ” সকলের চোখে পড়ে, সেটা এই যে, তারা সবাই দিব্যি গৌরবরন।) এবং “সামান্য কৌশল’ বলতেও আমরা সেই কৌশলকে বোঝাচ্ছি, তিনটি ছন্দের মাত্রাবিচারেই যা প্রয়োগ করা যেতে পারে।
কিংবা ‘সামান্য কৌশল না-বলে আমরা মাসটার কী’ও বলতে পারি। স্বৰ্গত দীনেন্দ্ৰকুমার রায় ইংরেজি এই ‘মাস্টার কীর ভারী সুন্দর একটি বাংলা করে। দিয়েছিলেন। “সবখোলাচাবি”। কথা হচ্ছে, অক্ষরবৃত্ত মাত্রাবৃত্ত আর স্বরবৃত্ত, এই তিন তালাকেই যা খুলতে পারে, এমন কোনও সবখোল চাবির আশা কি নেহাতই দুরাশা?