সীমানা ছাড়িয়ে ওপরে উঠবার দৃষ্টান্ত আগেই দেওয়া যাক। বিখ্যাত কিছু পদ্য কিংবা ছড়া থেকে দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। (হাতের কাছে বই না থাকায় মিলিয়ে নেবার উপায় নেই। উদ্ধৃতিতে যদি একটু-আধটু ভুল ঘটে যায়, সহৃদয় পাঠক আশা করি ক্ষমা করবেন।) নীচের লাইন দুটি লক্ষ করুণ।
“রাত পোহাল, ফরসা হল, ফুটল কত ফুল;
কাঁপিয়ে পাখা নীল পতাকা জুটল। অলিকুল।”
এখানে ফি-লাইনে আছে তিনটি করে পর্ব। লাইনের শেষে ভঙা-পর্বও আছে। প্রতিটি পর্বে চারটি করে সিলেবল থাকবার কথা। আছেও। শুধু দ্বিতীয় লাইনের প্রথম পর্বে ব্যতিক্ৰম ঘটেছে। পর্বটি হল “কাঁপিয়ে পাখা’। হিসেব করে দেখুন, সিলেবল-এর সংখ্যা এক্ষেত্রে চার নয়, পাঁচ।
আর-একটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছি :
“জাদুর গুণের বালাই নিয়ে মরে যেন সে কাল!”
এটিও আপনাদের চেনা লাইন। এতেও আছে তিনটি পর্ব আর একটি ভাঙা-পর্ব। কিন্তু তৃতীয় পর্বে (‘‘মরে যেন সে) সিলেবল রয়েছে চারের বদলে পাঁচটি।
আর-একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যায় :
“যমুনাবতী সরস্বতী কাল যমুনার বিয়ে।”
—এ-লাইনটিও আপনারা অনেক বার শুনেছেন। কিন্তু এর প্রথম পর্বে (যমুনাবতী) যে পাঁচটি সিলেবল রয়েছে, তা হয়তো সবাই খেয়াল করে দেখেননি। ঠিক তেমনি, ‘পূজাবাটীতে জোর কাঠিতে যখন ঢাক বাজে, তখনও অনেকেই খেয়াল করে দেখেন না যে, ‘পূজাবাটীতে” পুরো পাঁচটি সিলেবল গিয়ে ঢুকেছে।
ইতিপূর্বে আমরা স্বরবৃত্তের যেসব দৃষ্টান্ত নিজেরা তৈরি করে নিয়েছিলুম, তাতে অবশ্য কুত্ৰাপি কোনও ব্যতিক্রম ছিল না। কিন্তু থাকলেই কি তাতে স্বরবৃত্তের পবিত্রতা নষ্ট হত? ট্রেনের মধ্যে হঠাৎ-দেখতে-পাওয়া বন্ধুটির সঙ্গে খানিকবাদেই ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে, এই কথাটা জানিয়ে আমরা লিখেছিলুম :
সেটা সত্যি, কিন্তু অত
ভেবে দেখলে কষ্ট বড়ো।
সেক্ষেত্রে ভেবে না-দেখে আমরা যদি তলিয়ে দেখতুম, এবং লিখতুম :
সেটা সত্যি, কিন্তু অত
তলিয়ে দেখলে কষ্ট বড়ো।
তাহলেই ব্যতিক্ৰম ঘটত, এবং দ্বিতীয় লাইনের প্রথম পর্বে (তালিয়ে দেখলে) পাঁচটি সিলেবল ঢুকে পড়ত। কিন্তু স্বরবৃত্তের চাল যে তাই বলে নষ্ট হত, এমন মনে হয় না।
নষ্ট হয় না সিলেবল-এর সংখ্যা কমে গেলেও। উর্ধ্বগতির কথা তো বললুম। নিম্নগতির ক্ষেত্রেও সেই একই কথা। চারের বদলে তিন সিলেবল দিয়েও মাঝেমাঝে স্বরবৃত্তের পর্ব গড়া হয়েছে, কিন্তু ছন্দের রেলগাড়ি তাতে বেলাইন হয়নি। দৃষ্টান্ত দিচ্ছি :
“আজ রামের অধিবাস কাল রামের বিয়ে।”
এটিও একটি সুপরিচিত লাইন, এবং এ-ও স্বরবৃত্তই। লাইনটিতে মোট তিনটি পর্ব, আর তৎসহ একটি ভাঙা-পর্ব রয়েছে। কিন্তু তিনটি পর্বের প্রত্যেকটিই এখানে তিন-সিলেবল দিয়ে গড়া (আজ রামের/অধিবাস/কাল রামের)।
আর-একটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছি :
“গুণবতী ভাই আমার মন কেমন করে।”
এটিও একটি পরিচিত ছড়ার লাইন। এরও দ্বিতীয় পর্বে (ভাই আমার) আর তৃতীয় পর্বে (মন কেমন’) আছে তিনটি করে সিলেবল।
আরও একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। এবারে দু-লাইন নিজেরাই বানিয়ে নিচ্ছি :
রাতদিন তুই ছাইভস্ম কী যে
কথা বলিস নিজের সঙ্গে নিজে।
লাইন দুটির প্রত্যেকটিতে আছে দুটি করে পর্ব আর একটি করে ভাঙা-পর্ব। লক্ষ করে দেখুন, প্রথম লাইনের দুটি পর্বই (রাতদিন তুই/ছাইভস্ম), গড়া হয়েছে তিনটি করে সিলেবল দিয়ে।(1) কিন্তু ছন্দ তাতে বেচাল হয়নি।
কেন হয় না? সিলেবল-এর সংখ্যা চারের জায়গায় বেড়ে গিয়ে পাঁচ, কিংবা কমে গিয়ে তিন, হওয়া সত্ত্বেও কী করে ছন্দের চাল ঠিক থাকে?
ব্যাপারটার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ছান্দসিকেরা বলেন, চাল নষ্ট হয় না। আমাদের উচ্চারণের গুণে। (বললুম। ‘গুণ, কিন্তু ব্যাপারটা আসলে উচ্চারণের ‘দোষ” ছাড়া আর কিছু নয়। তবে এক্ষেত্রে সেটা দোষ হৈয়াও গুণ হচ্ছে বটে!)। আমরা লিখি বটে ‘কাঁপিয়ে পাখা’, কিন্তু উচ্চারণে সেটা ‘কাঁপ্য়ে পাখা’ হয়ে দাঁড়ায়, ‘তলিয়ে দেখলে’ হয় ‘তলয়ে দেখলে’। ফলে সিলেবলও একটি করে কমে যায়। কাঁপিয়ে পাখায় যেক্ষেত্রে পাঁচটি সিলেবল পাচ্ছি (কঁ+পি+য়ে পাখা), “কাঁপিয়ে পাখায় সেক্ষেত্রে চারটি সিলেবল মিলবে (কাঁপি+য়ে পা খা)। তলিয়ে দেখলে যেক্ষেত্রে পাঁচটি সিলেবল দিয়ে গড়া (ত+লি+য়ে দেখ+লে), তিলয়ে দেখলের সিলেবল সংখ্যা সেক্ষেত্রে চারের বেশি নয়। (তল-য়ে দেখ+লে)।
কিন্তু যমুনাবতীর ব্যাখ্যা কী? ছান্দসিকেরা এক্ষেত্রেও সম্ভবত বলবেন যে, তাড়াতাড়ি বলবার সময়ে আমরা ‘যমুনাবতী’ বলি না, বলি ‘যোম্নাবতী’; ফলে সিলেবল-এর সংখ্যা এক্ষেত্রেও চারে এসে দাঁড়ায় (যেমন-না–ব+তী)। এই নিয়ম অনুযায়ী মরে যেন সে’ আর ‘পূজাবাটীতে’র ক্ষেত্রেও সিলেবল-এর সংখ্যা কমে গিয়ে চারে এসে দাঁড়াবার একটা-কিছু ব্যাখ্যা নিশ্চয় মিলবে।
ব্যাখ্যা মেলে সিলেবল-এর সংখ্যা যেখানে চারের কম, সেখানেও। ছান্দসিক বললেন, তিন সিলেবলকেই আমরা সেখানে টেনে উচ্চারণ করে চারে এনে দাঁড় করাই। “আজ রামেরা/অধিবাস/কাল রামের/বিয়ে” এই লাইনটিকে টেনে বলি “আ-জ রামেরা/অধি-ব্যাস/কা-ল রামের/বিয়ে’। ‘গুণবতী ভাই আমার মন কেমন করেীর ক্ষেত্রে প্রথম পর্বটিতে চারটি সিলেবল থাকায় টেনে পড়বার দরকার হয় না, কিন্তু দ্বিতীয় পর্বে আর তৃতীয় পর্বে সিলেবল-এর ঘাটতি থাকায় টেনে পড়তে হয়। ঘাটতি মেটাবার জন্যে বলতে হয়, “ভা-ই আমার/ম-ন কেমন”।