আর-একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। এবারে আমাদের বিষয়বস্তু হবে ভালোবাসা। একটি মেয়ের চাউনিতে আলো জুলেছে, হাসিতে রং ধরেছে, অথচ ভঙ্গিটি সলজ। তার বুকের মধ্যে জেগেছে অসম্ভবকে জয় করবার আশা; অন্য দিকে, দ্বিধা আর ভয়ের শিকলটাকেও সে ছিড়তে পারছে না। অর্থাৎ কিনা সে প্রেমে পড়েছে। তা তার এই অবস্থােটাকে আমরা, স্বরবৃত্ত ছন্দে এইভাবে প্রকাশ করতে পারি :
দুটি চোখে কে ওই আলো জ্বালে,
ঠোঁটে লাগায় হাসি?
ভঙ্গিতে কে আমন করে ঢালে
লজ্জা রাশিরাশি?
বুকের মধ্যে বাজায় গুরুগুরু
অসম্ভবের আশা;
ভয়ে তবু কাঁপে যে তার ভুরু,
সেই তো ভালোবাসা।
ঈশ্বর জানেন, প্রথম-প্রেমের এই বর্ণনাটা সকলের মনঃপূত হল কি না। তবে এ-ও যে স্বরবৃত্তই, তাতে সন্দেহ নেই। পর্ব ভেঙে দেখালে এর চেহারা হবে। এইরকম :
দুটি চোখে/কে ওই আলো/জ্বালে,
ঠোটে লাগায়/হাসি?
ভঙ্গিতে কে/অমন করে/ঢালে
লজ্জা রাশি/রাশি?
বুকের মধ্যে/বাজায় গুরু/গুরু
অসম্ভবের/আশা;
ভয়ে তবু/কাঁপে যে তার/ভুরু,
সেই তো ভালো/বাসা।
দেখতে পাচ্ছি, এর প্রথম, তৃতীয়, পঞম আর সপ্তম লাইনে আছে দুটি করে পর্ব; দ্বিতীয়, চতুর্থ, ষষ্ঠ আর অষ্টম লাইনে সেক্ষেত্রে একটি করে পর্ব আছে। ফি-লাইনের শেষে আমরা ভাঙা-পর্ব রেখেছি। প্রতিটি পর্বই ৪-মাত্রায় গড়া (অর্থাৎ প্রতিটি পর্বেই চারটি করে সিলেবল আছে)। ভাঙা-পর্বগুলি ২-মাত্রার।
আরও একটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। এবারে আমাদের বিষয়বস্তু হচ্ছে অকৃতজ্ঞতা।
প্রেম-ভালবাসা-প্রকৃতির কথা তো অনেক বললুম, এবারে জীবনের অন্ধকার দিকটার দিকেও একবার তােকানো যাক। যুগপৎ অকৃতজ্ঞ ও নির্বোিধ এমন মানুষের কথা বলা যাক, নিজের ক্ষমতার দৌড় না-বুঝেই যে কিনা উপকারীকে দংশন করতে উদ্যত :
চেহারাটা আজকে তোমার
এক মুহুর্তে পড়ল ধরা।
হাঁড়ির মধ্যে আটকা ছিলে,
যেই না খুলে দিলুম সরা–
অমনি তুমি আমার দেহেই
সমস্ত বিষ ঢালতে চাচ্ছ,
সাপের মতোই ফণা তুলে
দিব্যি তুমি ফোঁসফোঁসাচ্ছ।
কৃতজ্ঞতা কিছু নেই কি?
বুদ্ধি? তা-ও না? আরো ছি-ছি।
বুদ্ধি থাকলে বুঝতে পারতে
ভয় দেখাচ্ছ মিছিমিছি।
সাপের ওষুধ আছে আমার,
কোরো না তাই বাড়াবাড়ি।
তোমার মতন হাজার সাপকে
হাঁড়িতে ফের পুরতে পারি।
এবারে আর পর্ব ভেঙে দেখাচ্ছিনে। নিজেরাই ভেঙে নিন। ভাঙলে দেখতে পাবেন, এর ফি-লাইনে দুটি করে পর্ব আছে (লাইনের শেষে ভঙা-পর্ব নেই)। প্রতি পর্বে, যথারীতি, আছে চারটি করে সিলেবল।
কথা এই যে, স্বরবৃত্ত ছন্দে ৪-সিলেবল-এর পর্বটাই নিয়ম বটে, তবে মাঝে-মাঝে তার ব্যতিক্রমও ঘটে যায়। আমরা তিনটি মুক্ত ও একটি বুদ্ধ সিলেবল-এর সমবায়ে পর্ব গড়তে পারি (দৃষ্টান্ত : “দিনের আলো” = দি/নের/আ/লো), কিংবা চারটি মুক্ত সিলেবল-এর সমবায়ে পর্ব গড়তে পারি (দৃষ্টান্ত : ‘নিভে এলো”= নি/ভে/এ/লো), কিংবা দুটি মুক্ত ও দুটি বুদ্ধ সিলেবল-এর সমবায়েও পর্ব গড়তে পারি (দৃষ্টান্ত : “বাইরে কেবল” = বাই/রে/কে/বল)। এই সবই চার-সিলেবল-সম্পন্ন পর্বের দৃষ্টান্ত। কিন্তু সবগুলি সিলেবলকেই যদি বুদ্ধ রাখতে ইচ্ছা করি, তাহলে পর্বের মধ্যে সাকুল্যে তিনটির বেশি সিলেবল ঢোকাতে গেলে আমাদের ঘাম ছুটে যাবে। (দৃষ্টান্ত দেবার জন্যে এক্ষুনি একটা লাইন বানিয়ে নেওয়া যাক। “শনশন শন ৰাতাস বইছে”— এই যে লাইনটি, এর মধ্যে দুটি পর্ব আছে। “শন শন শন” আর “বাতাস বইছে”। তার মধ্যে প্রথম পর্ব অর্থাৎ “শন শন শন”-এর সব কটি সিলেবলই যেহেতু বুদ্ধ তাই সেই পর্বের মধ্যে সাকুল্যে তিনটির বেশি সিলেক্ল-এর জায়গা মেলেনি; মেলানো শাস্তু।) তাহলেই দেখা যাচ্ছে: ৪-মাত্রার নিয়মটা সর্বদা বজায় থাকে না; সিলেবল-এর চরিত্র অনুযায়ী মাত্রার সংখ্যা বাড়ে কমে। এখানে যে-দৃষ্টান্ত দিয়েছি, তা ছাড়া অন্য প্রকারের ব্যতিক্রমের দৃষ্টান্তও এই ছন্দে বিস্তর মেলে। যেমন মাত্রাহাস, তেমনি মাত্রাবৃদ্ধির দৃষ্টান্তও প্রচুর। স্বরবৃত্তের আর-এক নাম ছড়ার ছন্দ। তা চোখ বুলোলেই ধরা পড়বে যে, সেকাল আর একালের অনেক ছড়ারই অনেক পর্বে চারটি করে সিলেবল নেই। কোথাও বেশি আছে, কোথাও কম।
স্বরবৃত্ত ছন্দে একালেও কিছু কম কবিতা লেখা হয়নি। কিন্তু একালের কবিরাই যে পর্বে-পর্বে চারটি করে সিলেবল-এর বরাদ্দ চাপাবার কানুন সর্বদা মান্য করছেন, এমনও বলতে পারিনে। ব্যতিক্রম বিস্তর চোখে পড়ে। আকছার দেখতে পাই, পর্বে কোথাও সিলেবল-এর সংখ্যা চারের বেশি, কোথাও কম। সিলেবল-এর সংখ্যা যখন বাড়ে, তখন পাঁচে, এমনকি এক-আধ ক্ষেত্রে ছয়েও গিয়ে পৌছোয়। (প্রাচীন ছড়ায় ছয়-সিলেবলযুক্ত পর্বের দৃষ্টান্ত : কাজিফুল কুড়োতে কুড়োতে’ পেয়ে গেলাম মালা) যখন কমে, তখন সাধারণত তিনে এসে নামে।
ওঠানামার ব্যাপারটা কি কবিদের ইচ্ছাকৃত? অর্থাৎ চার-সিলেবল দিয়ে স্বরবৃত্তের পর্ব গড়বার যে একটি অলিখিত বিধান রয়েছে, সেইটোকে লঙ্ঘন করবার জন্যেই কি তাঁরা মাঝে-মাঝে সিলেবল-এর সংখ্যা বাড়ােন কিংবা কমান? উত্তরটা কবিরাই দিতে পারবেন। আমরা শুধু এইটুকু বলতে পারি যে, নিয়ম লঙ্ঘন করলেও র্তারা সাধারণত এক-পায়ের বেশি লঙ্ঘন করেন না। চারের সীমানা ছাড়িয়ে যখন তারা ওপরে ওঠেন, তখন বড়োজের এক পা ওঠেন। এবং যখন নামেন, তখন সাধারণত এক পা-ই নামেন। (নামতে নামতে দুয়ে নামবার দৃষ্টান্তও কিছু আছে।)