ইতিপূর্বে বলেছি, স্বরবৃত্ত ছন্দে সিলেবল-এর হিসেবে মাত্রার মূল্য চুকিয়ে দিতে হয়; ফি সিলেবলকে দিতে হয় একটি করে মাত্রার মূল্য। সেক্ষেত্রে এই রীতিতে দেখা যাচ্ছে মাত্রা-সংখ্যার দিক থেকে ‘ছন্দ” আর ‘বন্ধন” তুল্যমূল্য শব্দ; কেন-না অক্ষর-সংখ্যায় পৃথক হয়েও সিলেবল সংখ্যায় তারা সমান, তাদের দুজনেরই শরীর দুটি করে সিলেবল দিয়ে গঠিত হয়েছে।
অক্ষরবৃত্ত আর মাত্রাবৃত্তের সঙ্গে স্বরবৃত্তের প্রধান পার্থক্য এইখানেই। ধ্বনিটাই অবশ্য প্রধান কথা, অক্ষর নেহাতই গৌণ ব্যাপার। সে-কথা আগেও অনেক বার বলেছি, তবু, প্রথম দুটি ছন্দের ক্ষেত্রে অক্ষরও একেবারে ন-গণ্য নয়। ব্যতিক্রমের কথা যদি ছেড়ে দিই, তবে অক্ষরের ভিত্তিতেও মাত্রার একটা মোটামুটি হিসেব সেখানে রাখা চলে। স্বরবৃত্তে সেটা একেবারেই চলে না। একই শব্দ যে এই তিন রকমের ছন্দে কীভাবে তিন রকমের মাত্রা মূল্য পায়, কবিকঙ্কণের কিঙ্কণ” দিয়েই সেটা বুঝিয়ে দেওয়া যেতে পারে।
১) অক্ষরবৃত্তে সাধারণত প্রতিটি অক্ষরই একটি করে মাত্রার মূল্য পায়। সুতরাং “কঙ্কণ” সেখানে ৩-মাত্রার শব্দ।
২) মাত্রাবৃত্তে আমরা সাধারণত প্রতিটি অক্ষরকে একটি করে মাত্রার মূল্য দিই কিন্তু শব্দের মধ্যস্থ কিংবা প্রান্তবতী যুক্তাক্ষরকে (যদি না সেই যুক্তাক্ষরের ঠিক পূর্ববর্তী বর্ণটি হয় হস্বৰ্ণ) দিই ২-মাত্রার মূল্য। সুতরাং কঙ্কণ” সেখানে ৪-মাত্রার শব্দ।
৩) স্বরবৃত্তে আমরা প্রতিটি সিলেবলকে একটি করে মাত্রার মূল্য দিই, এবং ‘কঙ্কণ’ শব্দটিতে মোট দুটি সিলেবল (কং+কণ) পাওয়া যাচ্ছে। সুতরাং কঙ্কণ’ সেখানে ২-মাত্রার শব্দ।
অর্থাৎ কিনা একই শব্দ তিন রকমের ছন্দে তিন রকমের মাত্রা মূল্য পাচ্ছে।
পদ্যের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত দিলে কথাটা আরও পরিষ্কার হবে। পরপর তিন রকমের ছন্দে আমরা মোটামুটি একই বক্তব্যকে এখানে উপস্থিত করছি :
১) অক্ষরবৃত্ত
অঙ্কের দাপটে কাব্য নাভিশ্বাস ছাড়ে,
আনন্দের লেশ নেই ছন্দের বিচারে।
২) মাত্রাবৃত্ত (৬-মাত্রা)
অঙ্কের চোখ-রাঙানিতে হায়,
নাড়ি ছাড়ে কাব্যের,
ছন্দ-বিচারে বলো কেবা পায়
স্পর্শ আনন্দের?
৩) স্বরবৃত্ত
অঙ্ক কষে কিছু পেলে?
কাব্য গেল মারে।
আনন্দের কি পরাশ মেলে
ছন্দ-বিচার করে?
কথাটা সত্যি নয়। ছন্দ-বিচারেও আনন্দ মেলে। বইকি। আপাতত লক্ষ করে। দেখুন, “আনন্দের’ শব্দটি তিনটি দৃষ্টান্তেই আছে। কিন্তু তিন জায়গায় তার মাত্রা মূল্য সমান নয়। প্রথম দৃষ্টান্তে (অর্থাৎ অক্ষরবৃত্তে) সে পাচ্ছে ৪-মাত্রার মূল্য; দ্বিতীয় দৃষ্টান্তে (অর্থাৎ মাত্রাবৃত্তে) সে পাচ্ছে ৫-মাত্রার মূল্য; আবার তৃতীয় দৃষ্টান্তে (অর্থাৎ স্বরবৃত্তে) সে মাত্র ৩-মাত্রার মূল্য পেয়েই খুশি থাকছে।
স্বরবৃত্তে সে মাত্র ৩-মাত্রার মূল্য পাচ্ছে কেন? কারণটা আগেই বলেছি। পাচ্ছে, তার কারণ, স্বরবৃত্তে মাত্রার মূল্য দেওয়া হয় সিলেবল অনুযায়ী, এবং ‘আনন্দের শব্দটিতে (আ+নন°দের) তিনটির বেশি সিলেবল নেই।
এবারে আমরা স্বরবৃত্তের পর্ব-বিভাগ করে দেখাব। সিলেবল অনুযায়ী মাত্রার মূল্য দেবার ব্যাপারটা তাতে আরও স্পষ্ট হবে। কিন্তু পর্ব ভেঙে দেখাবার জন্যে একটা পদ্য চাই। হাতের কাছে পদ্যের বই পাচ্ছিনে; তাই, আসুন, স্বরবৃত্ত ছন্দে লেখা লাইন-কয়েকের একটা টুকরো পদ্য নিজেরাই বানিয়ে নেওয়া যাক। ভয় পবার কিছু নেই, অক্ষরবৃত্ত আর মাত্রা বৃত্ত ছন্দে তো আর আমরা কম পদ্য বানাইনি, কান যদি ঠিক থাকে তো স্বরবৃত্তেও কয়েকটা লাইন আমরা ঠিকই খাড়া করে ফেলতে পারব।
ধরা যাক, আমাদের বক্তব্য এই হবে যে, রেলের কামরায় অকস্মাৎ এক পুরোনো বন্ধুর (কিংবা বান্ধবীর) সঙ্গে দেখা হয়েছে, খানিক বাদেই আবার ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে, দুজনে দু-পথে চলে যাব, কিন্তু সেই বিচ্ছেদের ভাবনাকে আমরা আমল দিতে চাইনে, বরং দু-দণ্ডের এই হঠাৎ-মিলনকে গল্পে-গল্পে ভরিয়ে তুলতে চাই। তা স্বরবৃত্তে সেই কথাটাকে আমরা এইভাবে প্রকাশ করতে পারি :
পথের মধ্যে হঠাৎ দেখা,
ট্রেনের মধ্যে আলাপচারি;
স্টেশন এলেই আবার একা
অন্য পথে দেব পাড়ি।
সেটা সত্যি, কিন্তু অত
ভেবে দেখলে কষ্ট বড়ো;
বরং এসো, আপাতত
হালকা কিছু গল্প করো।
যাক, লাইনগুলি মোটামুটি খাড়া হয়েছে। এবারে একে পর্বে-পর্বে ভাগ করতে হবে। সেক্ষেত্রে এর চেহারা দাঁড়াবে এইরকম :
পথের মধ্যে/হঠাৎ দেখা,/
ট্রেনের মধ্যে/আলাপচারি;/
স্টেশন এলেই/আবার একা/
অন্য পথে/দেব পাড়ি।/
সেটা সত্যি,/কিন্তু অত/
ভেবে দেখলে/কষ্ট বড়ো;/
বরং এসো,/আপাতত/
হালকা কিছু/গল্প করো।/
দেখতে পাচ্ছি, এখানে ফি-লাইনে আছে দুটি করে পর্ব (সংখ্যাটাকে ইচ্ছে করলেই বাড়ানো যেত); লাইনের শেষে ভঙা-পর্ব নেই। (ইচ্ছে করলেই রাখা যেত)।
লাইন তো ভাঙলুম। এখন পর্বকেও যদি ভেঙে দেখি, তাহলে তার মধ্যে চারটি করে সিলেবল-এর সাক্ষাৎ পাওয়া যাবে। দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রথম লাইনের প্রথম পর্বটিকে ভেঙে দেখছি, প + থেরন্ + মধ্য + ধে- এই চারটি সিলেবল-এ তার শরীর গড়া। অন্য ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হবে না, যে-কোনও পর্ব এখানে ভাঙি না কেন, মোট চারটি করে সিলেবলই তাতে মিলবে।
এবং আপনারা আগেই জেনেছেন যে, স্বরবৃত্ত ছন্দে প্রতিটি সিলেবল একটি করে মাত্রার মূল্য পায়। সেই হিসেবে আমরা বলতে পারি যে, স্বরবৃত্তের চাল ৪-মাত্রার। মাত্রাবৃত্ত অনেক চালে চলে। কিন্তু স্বরবৃত্তের এই একটিই চাল। চারের চাল ছাড়া সে চলে না।