এ হল স্বরবৃত্ত। অক্ষরবৃত্ত আর মাত্রাবৃত্তের পাশাপাশি একে পড়ুন। তাহলেই বুঝতে পারবেন যে, এর চলন একেবারে আলাদা।
আবার দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। এবারে কী নিয়ে লিখব? ফুর্তির কথা তো লিখলুম, এবারে অন্য-কিছু লেখা যাক। বক্তব্যকে আর-একটু উঁচুতে উঠিয়ে এনে, আসুন, হৃদয়ঘটিত কিছু লিখি। পর-পর তিন রকমের ছন্দে সে-কথা লেখা হবে।
(১) অক্ষরবৃত্ত
ঘৃণায় বিঁধেছ যাকে,
ঘৃণায় বিঁধেছে যাক, দিয়েছ ধিক্কার
দিয়েছ ধিক্কার আহবান জানালে তাকে মিথ্যে কেন আর?
(২) মাত্রাবৃত্ত (৫-মাত্রা)
ঘৃণাতে যাকে বিধেছ, যাকে
বলেছ শুধু ছি-ছি,
সহসা কেন এখানে তাকে
ডেকেছ মিছিমিছি?
(৩) স্বরবৃত্ত
ঘৃণা করো যে লোকটাকে
শুধুই বলো ছি-ছি,
আবার তুমি কেন তাকে
ডাকলে মিছিমিছি?
দেখতেই পাচ্ছেন, মোটামুটি একই কথাকে আমরা তিন রকমের ছন্দে বাঁধিলুম। পাশাপাশি এদের বারিকয়েক পড়ে দেখুন। পড়তে গেলেই বুঝতে পারবেন, তৃতীয় ছন্দটির অর্থাৎ স্বরবৃত্তের চাল আগের দুটির কোনওটির সঙ্গেই মেলে না। এর পা ফেলবার ভঙ্গি একেবারেই আলাদা।
আবার দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। উদর থেকে যখন হৃদয়ে একবার প্রোমোশন পেয়েছি, তখন বক্তব্য নির্বাচনে আর সহসা আমরা লঘুচিত্ততার পরিচয় দিচ্ছিনে। ধরা যাক, কোনও-এক খণ্ডিতা নায়িকার নিরুদ্ধ বেদনার কথাকে আমরা প্রকাশ করতে চাই। তা তিন রকমের ছন্দেই সে-কথা প্রকাশ করা চলে। যদি অক্ষরবৃত্তে প্ৰকাশ করতে হয়, তো আমরা লিখব :
মুখে তার কথা নেই, শয্যার উপরে
সমস্ত না-বলা কথা অশ্রু হয়ে ঝরে।
চাল পালটে যদি মাত্রাবৃত্ত ছন্দে এই কথাগুলি জানাতে হয়, তো সেক্ষেত্রে আমরা লিখতে পারি। :
মুখে কথা নেই ভীরু নায়িকার,
বিনিদ্র বিছানায়
না-বলা কথার যন্ত্রণা তার
অশ্রুতে ঝরে যায়।
এ হল ছয়ের চালের মাত্রাবৃত্ত। আবার এই একই কথাকে আমরা স্বরবৃত্তের সুতোতেও গেথে তুলতে পারি। সেক্ষেত্রে আমরা লিখব :
একটি কথা নেই মুখে তার
সঙ্গিবিহীন ঘরে
রুদ্ধ কথার যন্ত্রণাভার
অশ্রু হয়ে ঝরে।
অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত আর স্বরবৃত্তের চাল যে সম্পূর্ণ পৃথক, আশা করি সেটা ইতিমধ্যে নিঃসংশয়ে বুঝে নিয়েছেন। এই পার্থক্যের মূলে রয়েছে এদের নিজস্ব গঠনরীতি। তাকে বিশ্লেষণ করলেই ধরা পড়বে, এদের চলন কেন আলাদা।
অক্ষরবৃত্ত আর মাত্রাবৃত্তের গঠনরীতি ইতিপূর্বেই আমরা বিশ্লেষণ করেছি। করে একটা মোটামুটি নিয়মের হদিস পেয়েছি। সেটা এই যে, ১) অক্ষরবৃত্তে সাধারণত প্রতিটি অক্ষর একটি করে মাত্রার মূল্য পায়, এবং ২) মাত্রাবৃত্তে প্রতিটি অক্ষর তো একটি করে মাত্রার মূল্য পায়ই, প্রতিটি যুক্তাক্ষর (যদি সেই যুক্তাক্ষর শব্দের আদিতে না থাকে, কিংবা শব্দের মধ্যে অথবা অন্তে থাকলেও তার পূর্ববর্তী বর্ণটি যদি হস্বৰ্ণ না হয়) পায় দু-মাত্রার মূল্য।
স্বরবৃত্তে সেক্ষেত্রে প্রতিটি সিলেবলকে একটি করে মাত্রার মূল্য চুকিয়ে দিতে হয়।
সিলেবল-এর বাংলা প্রতিশব্দ কী করব? সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত করেছিলেন ‘শব্দ-পাপড়ি’, কালিদাস রায় করেছেন ‘পদাংশ’; প্ৰবোধচন্দ্ৰ ‘দল’-এর পক্ষপাতী। ‘পাপড়ি’ আর দল’-এর অর্থ একই। অনুমান করতে পারি, সত্যেন্দ্রনাথ আর প্ৰবোধচন্দ্ৰ শব্দকে পুষ্প হিসেবে দেখেছেন; সিলেবল তার পাপড়ি কিংবা দল। (কট্টর নৈয়ায়িকেরা সম্ভবত এইটুকু শূনেই ভুকুটি করে বলে বসবেন যে, শব্দকোশে সেক্ষেত্রে আর যে-পুষ্পেরই থাক, শতদলের দৃষ্টান্ত মিলবে না, কেন-না, একশসিলেবল দিয়ে যার অঙ্গ গড়া, এমন শব্দ না ভুতো ন ভবিষ্যতি)
কিন্তু সে-কথা পরে। সিলেবলই বলি, কিংবা পাপড়ি অথবা দলই বলি, বস্তুটা আসলে কী, আগে সেটা বোঝা চাই।
এক কথায় বলতে পারি, কোনও-কিছু উচ্চারণ করতে গিয়ে নূ্যনতম চেষ্টায় যেটুকু আমরা বলতে পারি, তা-ই হচ্ছে একটি সিলেবল। সেই দিক থেকে এক-একটি সিলেবল হচ্ছে আমাদের উচ্চারণের এক-একটি ইউনিট কিংবা একক। এই এককগুলির সমবায়েই আমাদের উচ্চারণের শরীর গড়ে ওঠে। দৃষ্টান্ত দিয়ে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিচ্ছি :
ধরা যাক, কবিকঙ্কণ’ শব্দটাকে আমরা উচ্চারণ করতে চাই। করলুম। করে দেখতে পাচ্ছি, চারটি এককে তার অঙ্গ গড়া। আলাদা করে সেগুলিকে এইভাবে দেখানো যায় :
ক+বি+কং+কণ্
অর্থাৎ ‘কবিকঙ্কণ’ শব্দটি মোট চারটি সিলেবল-এর সমবায়ে গড়ে উঠেছে।
এই হিসেবে ছন্দ’ শব্দটিতে আছে দুটি সিলেবল (ছন + দ); আবারঅক্ষরের সংখ্যা যদিও বাড়ল— ‘বন্ধন’ শব্দটিতে দুটির বেশি সিলেবল নেই (বন। + ধন)।
এই পর্যন্ত যা বলেছি, তার থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, সিলেবল দু-রকমের হতে পারে। ইংরেজিতে বলে ‘ওপন সিলেবল ও ‘ক্লোজড্ সিলেবল। প্ৰবোধচন্দ্ৰ তো সিলেবল শব্দটার বাংলা করেছেন দল, সেই হিসেবে ‘ওপন সিলেবল ও ‘ক্লোজড্ সিলেবলকে তিনি “মুক্তদল” ও “বুদ্ধিদল’ বলেন। ‘কবিকঙ্কণ’ শব্দটার মধ্যে “ক” আর ‘বি’ হচ্ছে মুক্ত সিলেবল; অন্য দিকে কিং’ আর ‘কৰ্ণ হচ্ছে রুদ্ধ। বুদ্ধ’ বলছি। এইজন্যে যে, “ক” আর ‘বি’-র মতো এ-দুটি সিলেবল-এর উচ্চারণকে টেনে নিয়ে যাওয়া যায় না। ‘ভাই’ বউ” “যাও” ইত্যাদিও বুদ্ধ সিলেবল-এর দৃষ্টান্ত। এসব “সিলেবল-এর শেষে যদিও স্বরবর্ণ আছে, তবু— উচ্চারণ যেহেতু তন্মুহুর্তেই ফুরিয়ে যায়, তাই- কাৰ্যত সেই স্বরবর্ণগুলি হসন্ত বর্ণেরই সামিল, ফলে এরাও বুদ্ধ সিলেবল বলে গণ্য হয়। ( যায়’, ‘হায়’ ইত্যাদির ক্ষেত্রে তো সেই এক কথা বটেই, “যাঃ’ বাঃ”, ইত্যাদিও রুদ্ধ সিলেবল।)