এবারে আর পর্ব ভেঙে দেখাব না। নিজেরাই ভেঙে নিন।
মাত্রাবৃত্তের আলোচনা, আপাতত, এখানেই শেষ হল। এ-ছন্দের নিয়মগুলি আপনারা জেনে নিয়েছেন। নিয়মের ব্যতিক্রমও নেহাত কম নেই। একটি ব্যতিক্রমের কথা এখানে বলি।
আমরা জেনেছি এবং দেখেছি যে, মাত্রাবৃত্ত ছন্দের বেলায় শব্দের মধ্যে কিংবা অন্তে অবস্থিত যুক্তাক্ষর দু-মাত্রার মূল্য পায়। (যদি না সেই যুক্তাক্ষরের ঠিক পূর্ববতী বর্ণটি হয় হস্বৰ্ণ) যুক্তস্বর (ঐ, ঔ) অবশ্য- শব্দের মধ্যে কিংবা অন্তে থাকলে তো বটেই— আদিতে থাকলেও দু-মাত্রার মূল্য পেয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে লক্ষণীয় ব্যাপার এই যে, শব্দের আদিতে যেখানে যুক্তস্বর, সেখানে সেই যুক্তস্বরের পাশে একটি যুক্তব্যঞ্জন থাকলে তারা দুয়ে মিলে ২+২=8 মাত্রার মূল্য আদায় করতে পারে না। একটা দৃষ্টান্ত দিচ্ছি :
দৈন্যকে কেন আর সৈন্যে সাজাও,
চৈত্রে মৈত্রী চায় পাষণ্ডেরাও।
এখন, এই যে আমরা মাত্রাবৃত্ত ছন্দে দু-লাইন লিখলুম, মাত্রাবৃত্তের নিয়ম অনুযায়ী ‘দৈন্য’ ‘সৈন্যে’ ‘চৈত্রে’ আর ‘মৈত্রী’- এই শব্দ চতুষ্টয়ের প্রত্যেকেরই তো এখানে চার-মাত্রার মূল্য পাবার কথা, কিন্তু তা তারা কেউ পাচ্ছে কি? কেউই পাচ্ছে না। প্রত্যেকেই পাচ্ছে তিন-মাত্রার মূল্য। প্রত্যেকেরই আদিতে আছে যুক্তস্বরের দাপট ও সেই যুক্তস্বরের ঠিক পাশেই আছে যুক্তব্যঞ্জনের দাবি। এবং এই দুয়ের সংঘর্ষে প্রতিটি শব্দের ক্ষেত্রে একটি করে মাত্ৰা মারা পড়ছে। ‘বৌদ্ধ’ ‘ঔদ্ধত্য” ইত্যাদি শব্দের বেলাতেও মাত্রাবৃত্তে একটি করে মাত্রা লোপ পেয়ে যায়। প্রশ্ন হছে, লোপ পেয়ে যায়। কার হিসসা থেকে? অর্থাৎ সংঘর্ষের ফলে কার শক্তিক্ষয় ঘটে? শব্দের আদিতে অবস্থিত যুক্তস্বরের, না তার পাশে বসা যুক্তব্যঞ্জনের? অনেকে বলবেন, আদির ওই যুক্তস্বরই এসব ক্ষেত্রে দুর্বল হয়ে পড়ে ও তার মাত্রা মূল্য কমে যায়। আবার অনেকে হয়তো বলবেন, না, সংঘর্ষের ফলে মার খাচ্ছে ওই পাশে-বসা যুক্তাক্ষরটিই। সেক্ষেত্রে কেউ-কেউ আবার এমনও বলতে পারেন যে, একটু-একটু মোর খাচ্ছে দুজনেই। এই তিন অভিমতের কোনটা ঠিক, সেটা ধ্বনিতাত্ত্বিকের বিচাৰ্য।**
কিন্তু না, আর নয়, মাত্রাবৃত্তের সীমানা পেরিয়ে এসেছি, এবারে আমরা স্বরবৃত্তের রাজ্যে ঢুকব।
—————
* শব্দের মধ্যে কিংবা অন্তে থাকা সত্ত্বেও যুক্তাক্ষর দু-মাত্রার মূল্য পায় না, যদি সেই যুক্তাক্ষরের পূর্ববতী বর্ণটি হয় হস্বৰ্ণ। দৃষ্টান্ত : ট্রানস্লেশন। এক্ষেত্রে যুক্তাক্ষরটি শব্দের মধ্যবর্তী হওয়া সত্ত্বেও— যেহেতু তার পূর্ববতী বর্ণটি হস্বৰ্ণ, তাই— দু-মাত্রার মূল্য পাচ্ছে না। মাত্রাবৃত্তেও না।
** ‘পরিশিষ্ট’-অংশে কবি শ্ৰীশঙ্খ ঘোষের চিঠি দেখুন।
০৬. স্বরবৃত্ত বা দলবৃত্ত বা শ্বাসাঘাতপ্রধান ছন্দ
যেমন অক্ষরবৃত্ত আর মাত্রাবৃত্তের ব্যাপারে নিয়েছি, তেমনি স্বরবৃত্তের ব্যাপারেও নাম-পরিচয়টা আগেই স্পষ্ট করে জেনে নেওয়া যাক। স্বরবৃত্ত নামটিও শ্ৰীপ্ৰবোধচন্দ্র সেনেরই উদভাবিত। তবে লৌকিক ছন্দ নামেও তিনি একেই বোঝাতে চেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ সেক্ষেত্রে এই ছন্দকে বলতেন বাংলা প্রাকৃত’। শ্ৰীঅমূল্যধন মুখোপাধ্যায় বলেন শ্বাসাঘাতপ্রধান ছন্দ। স্বরবৃত্ত নামটি পরে শ্ৰীপ্ৰবোধচন্দ্র সেনের দ্বারা পরিত্যক্ত হয়। তিনি এর নতুন নাম রাখেন দলবৃত্ত। তবে পুরনো নামটা যখন প্রসিদ্ধি পেয়েই গেছে, তখন আমরা তাকে ছাড়ছিনে, এই আলোচনায় স্বরবৃত্ত নামটাই আমরা ব্যবহার করব।
এবারে সেই স্বরবৃত্তের রাজ্যে ঢোকার পালা। বলা বাহুল্য, মাত্রাবৃত্তের এলাকায় আমরা যেভাবে ঢুকেছিলুম, স্বরবৃত্তের এলাকাতেও ঠিক সেইভাবেই ঢুকব। অর্থাৎ কিনা গোত্তা মেরে দুম করে ঢুকব না। তার চাইতে বরং দূরে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণের জন্য তার চালচলন বেশ উত্তমরূপে নিরীক্ষণ করব; বুঝে নেব, অক্ষরবৃত্ত আর মাত্রাবৃত্তের সঙ্গে তার গতিভঙ্গিমার তফাত কোথায়। সেটা যদি ভালো করে বুঝতে হয়, তাহলে অক্ষরবৃত্ত আর মাত্রাবৃত্তের পাশাপাশি রেখে তাকে দেখা দরকার। তাতে তুলনা করবার সুবিধা মেলে; বুঝতে পারি, কে কোনভাবে পা ফেলে হাঁটছে। ছন্দবিচারে অবশ্য দেখার মূল্য যৎসামান্য, শোনার মূল্যই বেশি। যার চলন দেখতে চাই, আসলে তাকে বাজিয়ে দেখতে হবে। আসুন, অক্ষরবৃত্ত মাত্রাবৃত্ত আর স্বরবৃত্তকে তাহলে পাশাপাশি বাজিয়ে দেখা যাক।
ধরা যাক, আমরা ভোজনপর্ব নিয়ে কিছু লিখতে চাই। দিনকাল যা পড়েছে, তাতে সত্যি তো আর ভোজনের সাধ মেটাবার উপায় নেই, এখন শুধু পদ্য বেঁধেই শখ মেটাতে হবে। তা কথা এই যে, শখটা তিন রকমের ছন্দেই মেটাতে পারি। প্রথমত লিখতে পারি :
দক্ষিণহস্তের ক্রিয়া জমে পরিপাটি
পলান্নের সঙ্গে পেলে কোমা এক বাটি।
বুঝতেই পারছেন, এ হল অক্ষরবৃত্ত ছন্দ। ছন্দ পালটে এবারে আর-এক রকমের দোলা লাগিয়ে এই কথাগুলিকে প্রকাশ করা যাক। লেখা যাক :
দাও যদি পলান্ন, সাথে এক বাটি
কোর্মা দিলেই
ভোজনের পর্বটা জমে পরিপাটি–
সন্দেহ নেই।
এ হল মাত্রাবৃত্ত ছন্দ। (চালটা এক্ষেত্রে ৪-মাত্রার) এবারে পুনশ্চ ছন্দ পালটে এই কথাগুলিতে আমরা আর-এক রকমের দোল লাগাব। লিখব :
আহার জমে পরিপাটি
সত্যি বলি ভাই
পলান্ন আর একটি বাটি
কোর্মা যদি পাই।