লাইন আর মিলের বিন্যাসটা একটু অন্য রকমের বটে, কিন্তু এ-ও সেই ৬-মাত্রারই চাল। পর্ব ভাঙলে এই লাইনগুলির চেহারা এইরকমের দাঁড়াবে :
ইলিশ, তোমাকে/দেখি না,
শুধুই/ তোমার স্বপ্ন/দেখে
সপ্তাহ-মাস-/বৎসর যায়,/
দুঃখে বিন্দরে/হিয়া।
সান্ত্বনা দিতে/নেই পাকা রুই,/
সেও বহুকাল/থেকে
নিখোঁজ, এখন/বাজার জমায়/
রাশি রাশি টিলা/পিয়া।
দেখা যাচ্ছে, এর প্রথম, তৃতীয়, পঞম আর সপ্তম লাইনের শেষে ভঙা-পর্ব নেই বলেই সেখানে থেমে থাকা যাচ্ছে না, দ্রুত গিয়ে পরবর্তী লাইনে ঢুকতে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে দ্বিতীয়, চতুর্থ, ষষ্ঠ আর- বলাই বাহুল্য- শেষ লাইনের শেষে ভাঙা-পর্ব আছে বলে সেখানে আমরা দাঁড়াতে পারি। আসলে ব্যাপারটা এই যে, প্রথম লাইনের সঙ্গে দ্বিতীয় লাইনকে, তৃতীয় লাইনের সঙ্গে চতুর্থ লাইনকে, পঞম লাইনের সঙ্গে ষষ্ঠ লাইনকে, এবং সপ্তম লাইনের সঙ্গে অষ্টম লাইনকে আমরা অনায়াসেই জুড়ে দিতে পারতুম; পাঠের ব্যাপারে তাতে এতটুকু ইতারবিশেষ হত না।
আর-একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। এবারে আমাদের বক্তব্যকে আর-একটু উচ্চস্তরে উঠিয়ে আনব। নীচের লাইনগুলি লক্ষ করুন :
যন্ত্রণা থেকে আনন্দ জেগে ওঠে
শোক সান্ত্বনা হয়;
কাঁটার ঊর্ধ্বে গোলাপের মতো ফোটে
সমস্ত পরাজয়।
এটাও যে ৬-মাত্রার চাল, সেটা বোঝাবার জন্য আশা করি আর পর্ব ভেঙে দেখাতে হবে না।
***
চার, পাঁচ আর ছায়ের চাল আমরা দেখেছি। এবারে ৭-মাত্রার চাল দেখবার পালা। মাত্রাবৃত্তের ঘরে এইটিই আপাতত চুড়ান্ত চাল। বাংলা কাব্যে এর দৃষ্টান্ত খুব বেশি নেই। চার, পাঁচ। আর ছয়ের তুলনায় ৭-মাত্রার চালে লেখা কবিতার সংখ্যা যে অনেক কম, তাতে সন্দেহ করিনে। ৭-মাত্রার দৃষ্টান্ত রবীন্দ্ৰকাব্যে কিছু আছে; রবীন্দ্রনাথের পরেও অনেকে মাত্রাবৃত্তের এই চালে কবিতা লিখেছেন; হাল-আমলের কবিরাও যে এ-চালে চলেন না, এমন নয়; তবে তার দৃষ্টান্ত খুব বেশি চোখে পড়ে না।
দেখা যাক, আমরা এ-চালে চলতে পারি কি না। নীচের এই লাইনগুলি লক্ষ করুন :
ছিল না উদ্যত জটিল জিজ্ঞাসা,
মুক্ত অবারিত চিত্তে ছিল আশা।
নদীর কলতানে
পাখির গানে-গানে
বিশ্ব ভরা ছিল, মধুর ছিল ভাষা,
তখন বুকে ছিল গভীর ভালোবাসা।
জানি না, ঠিক-চালে এই লাইনগুলিকে আপনারা পড়তে পেরেছেন কি না। না-পারলে তাতে লজ্জার কিছু নেই, বিস্ময়েরও না। কেন-না। হুট করে একটা নতুন চালে পা ফেলা খুবই শক্ত ব্যাপার; যেমন ছয়ে-চারে তেমনি সাতে-পাঁচে অনেকেরই গন্ডগোল বেধে যায়। পা যেখানে পড়বার কথা, তার কিছুটা আগে পড়লেই মুশকিল, সাতকে তখন পাঁচ বলে মনে হতে পারে। দ্বন্দু ঘুচিয়ে দেবার ওজন্যে প্রথমে এই লাইনগুলিকে পর্বে পর্বে ভাগ করে দেখানো যাক :
ছিল না উদ্যত/জটিল জিজ্ঞাসা,/
মুক্ত অবারিত / চিত্তে ছিল আশা।/
নদীর কলতানে/
পাখির গানে-গানে/
বিশ্ব ভরা ছিল/মধুর ছিল ভাষা,/
তখন বুকে ছিল/গভীর ভালোবাসা/
দেখতেই পাচ্ছেন, প্রথম দ্বিতীয় পঞম ও ষষ্ঠ লাইনের প্রত্যেকটিতে আছে দুটি করে পর্ব তৃতীয় ও চতুর্থ লাইনে আমরা একটি করে পর্ব রেখেছি; লাইনের শেষে ভাঙা-পর্ব রাখিনি (ইচ্ছে করলেই রাখতে পারতুম); প্রতিটি পর্বই ৭-মাত্রায় গড়া। মুশকিল। এই যে, ৭-মাত্রার এই পর্বগুলিকে যদি ৫+২ হিসেবে পড়েন, তাহলেই ধন্ধ। লাগবে, মনে হবে এ-ও (একটি পর্ব ও একটি ভাঙা-পর্ব সংবলিত)। ৫-মাত্রার চাল। ধন্ধ এড়াবার জন্য একে ৩+৪ হিসাবে পড়া দরকার। পর্বের প্রথমাংশ (অর্থাৎ ৩-মাত্রাকে) একসঙ্গে পড়ুন, অতঃপর দ্বিতীয়াংশ (অর্থাৎ বাকি ৪-মাত্রাকে) একসঙ্গে পড়ুন। দ্বিতীয়াংশের প্রথমে যেন একটু জোর পড়ে। তাহলে আর ভাবনা নেই; সাতে-পাঁচে গুলিয়ে না-ফেলে তখন স্পষ্ট বুঝতে পারবেন, অন্যান্য চালের সঙ্গে এর তফাতটা কোথায়। ফি-মাত্রাকে যদি একটি পদক্ষেপ বলে গণ্য করি, তো ৭-মাত্রার এই চালকে ‘সপ্তপদী চাল’ বললে কি অন্যায় হবে?
কে যেন বারে বারে তার
পুরোনো নাম ধরে ডাকে;
বেড়ায় পায়ে-পায়ে, আর
কাঁধের পরে হাত রাখে।
অথচ খাঁখাঁ চারিধার,
ঠান্ডা চাঁদ চেয়ে থাকে;
ও-হাতখানি। তবে কার,
কে তবে ডাক দিল তাকে?
৭-মাত্রার চালটাকে ধরতে পারা যাতে আরও সহজ হয়, তার জন্যে আর-একটু বিশদ করে, অর্থাৎ ৭-মাত্রাকে তিনে + চারে ভাগ করে, এবারে পর্ব ভাঙছি। শুধু তা-ই নয়, শব্দগুলিকে কোথাও জুড়ে দিয়ে, কোথাও ভেঙে দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছি,
কেযেন + বারেবারে/ তার
পুরনো+নামধরে/ডাকে;
বেড়ায়ন-পায়েপায়ে/আর
কাঁধের+পরেহাতি/রাখে।
অথচ +খাঁখাঁচারি/ধার,
ঠান্ড+চাঁদচেয়ে/থাকে,
ওহাত-খানিতবে/কার,
কেতবে+ডাকদিল/তাকে?
বলা বাহুল্য, পর্বের শারীরিক গঠনটাকে স্পষ্ট করে বোঝাবার জন্যেই এই অদ্ভুত পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছি। কবিতা পড়বার সময়ে এতটাই কসরত করবার দরকার নেই। করতে গেলে শুধু ছন্দই পড়া হবে, কবিতা পড়া হবে না। সে-কথা থাক। এবারে আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারছি যে, ৭-মাত্রার চাল আসলে তিন+চারের যোগফল। এখানে ফি-লাইনে আছে ৭-মাত্রার একটি করে পর্ব ও তৎসহ দু-মাত্রার একটি করে ভাঙা-পর্ব। আশা করি, এর পরে আর ৭-মাত্রার চাল নিয়ে কারও ধন্ধ লাগবে না।
আরও একটি দৃষ্টান্ত তবু দিচ্ছি :
রাস্তা উঁচুনিচু, চলেছি সাবধানে,
বিশেষ নেই পুঁজিপাটা।
বিপদ চারিদিকে, বিঘ্ন সবখানে,
পথের সবখানে কাঁটা।