দুপুর গেল, বিকেল হল সারা,
গোপনে ফোটে একটি-দুটি তারা,
বাতাসে যেন চাপা বেদনা লাগে।
বেদনা করি, কথাটা তার কী,
পৃথিবী তার কিছুই বোঝেনি;
আকাশে বাঁকা চন্দ্ৰকলা জাগে।
পর্ব ভেঙে দেখালে এই লাইনগুলির চেহারা এইরকম দাঁড়ায়।
দুপুর গেল,/বিকেল হল/সারা,
গোপনে ফোটে/একটি-দুটি/তারা,
বাতাসে যেন/চাপা বেদনা/লাগে।
বেদনা করি/কথাটা তার/কী,
পৃথিবী তার/কিছুই বোঝে/নি;
আকাশে বাঁকা/চন্দ্ৰকলা/জাগে।
এখানে প্রতিটি পর্বেই ৫-মাত্ৰা গড়া হয়েছে বিজোড় + জোড় বিজোড় + জোড় দিয়ে। শুধু একটি ক্ষেত্রে- তৃতীয় লাইনের চাপা বেদনায়- তার ব্যতিক্ৰম দেখছি। ‘চাপা বেদনা’ বিজোড় + জোড় নয়, জোড় + বিজোড়। কিন্তু তাতেও কিছু অসুবিধের সৃষ্টি হচ্ছে না। কেন না, বিজোড় + জোড় এই ছন্দের তাড়নাই তাকে ”চাপাবে দানা’ বানিয়ে ছাড়ছে।
আর-একটা ব্যাপারও লক্ষ করুন। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় আর ষষ্ঠ লাইনের অন্তে যে ভাঙা-পর্ব রয়েছে, তার প্রত্যেকটিই ২-মাত্রা দিয়ে গড়া। ব্যতিক্ৰম ঘটেছে চতুর্থ আর পঞম লাইনের প্রান্তবর্তী ভাঙা-পর্বে। ও-দুটি পর্ব ১-মাত্রার। দেখা যাচ্ছে, একই কবিতার মধ্যে এক-এক জায়গায় আমরা এক-এক রকমের ভাঙা-পর্ব গড়লুম, কিন্তু কানের তাতে আপত্তি নেই। আসলে, জায়গা বুঝে এইভাবে ব্যতিক্ৰম ঘটালে কান যেমন আপত্তি তোলে না, তেমনি কবিতার শরীরে কিছুটা বৈচিত্ৰ্যও আনা যায়। (বলেছিলুম, ভাঙা-পর্বের উপরে জোর দেব না। তবু যে একটু কারিকুরি করলুম, তার হেতুটা আর কিছুই নয়, লোভ। কারিকুরির সুযোগ পেয়ে আর ছাড়া গেল না।)
৫-মাত্রার চালের আর-একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। লাইনের বিন্যাস এবারে একটু পালটে দেব। নীচের লাইনগুলি লক্ষ করুন :
কিছুটা ছিল অন্ধকার
কিছুটা ছিল আলো;
কিছুটা ছিল শুভ্ৰ, আর
কিছুটা ছিল কালো।
জীবনভোর জ্বলেছ। যার বিষে
ওষ্ঠে তার সুধাও ছিল মিশে।
এবারে তবে স্মরণে তার
নয়নে ক্ষমা জ্বালো–
কিছুটা ছিল মন্দ যার,
বাকিটা ছিল ভালো।
এবারে আর পর্ব ভেঙে দেখাচ্ছিনে। কষ্ট করে নিজেরাই ভেঙে নিন। তাহলে দেখতে পাবেন, এর পর্বগুলি ৫-মাত্রার। কোনও লাইনে দুটি করে পর্ব আছে, কোনও লাইনে একটি করে। কোথাও ভঙা-পর্ব আছে, কোথাও নেই। কিন্তু সব মিলিয়ে একটা প্যাটার্ন ঠিকই তৈরি হয়েছে।
৫-মাত্রার চাল দেখানো এখানেই শেষ হল।
***
পাঁচের পরে ছয়। মাত্রাবৃত্তের সংসারে এবারে ৬-মাত্রার চাল দেখবার পালা। এই চালে যদি চলতে হয়, তবে পর্বে-পর্বে ছটি করে মাত্রার বরাদ চাপাতে হবে। লাইনের শেষের ভাঙা-পর্বটি আমরা যেমন-খুশি গড়তে পারি।
ধরা যাক, আমরা অন্ত্রানের শীত নিয়ে দু-চার ছত্র লিখতে চাই। হঠাৎ বিষম ঠান্ডা পড়েছে, লেজ গুটিয়ে বাঘ পালাচ্ছে (ঈশ্বর জানেন পালায় কি না, কিন্তু কথাটা শোনাচ্ছে ভালো), খালবিল জমে কুলপি বরফ হয়ে যাচ্ছে (বলা বাহুল্য, বাংলা দেশে জমে না, কিন্তু লিখলে ক্ষতি কী, কবিতায় তো শুনতে পাই সাতখুন মাফ), গাছের ডালে একটা পাখি বসে থারথার করে কঁপিছে, কবিরা এই হাড়-কাঁপানো শীতের মধ্যে হাটেমাঠে মিল খুঁজে বেড়াক, কিন্তু গৃহস্থের পক্ষে এখন জানালা-দরোজা বেশ উত্তমরূপে এটে রাখা দরকার— এই হবে আমাদের বিষয়বস্তু। তা ৬-মাত্রার চালে এই কথাগুলিকে আমরা এইভাবে সাজাতে পারি :
অঘ্রান মাসে পড়েছে ঠান্ডা বড়ো
ব্যাঘ্র পালায়, জমে যায় খালবিল;
বৃক্ষশাখায় বসে কাঁপে থরোথরো
সঙ্গবিহীন বৃদ্ধ একটি চিল।
কবি, তুমি যাও, হাটেমাঠে খুঁজে মরো
দু-চারটে মন-মজানো কথার মিল;
গৃহস্থ, তুমি জানোলা বন্ধ করো,
দরোজায় বেশ ভালো করে আঁটো খিল।
এ-ও মাত্রাবৃত্ত, কিন্তু, পড়লেই বুঝতে পারবেন, ৪-মাত্রা কিংবা ৫-মাত্রার চালের সঙ্গে এর মিল নেই। এর চাল হচ্ছে ৬-মাত্রার। কানে শুনেও যদি কেউ তা না-বুঝে থাকেন, তবে পর্ব ভাঙলেই ব্যাপারটা তিনি চক্ষুষ উপলব্ধি করতে পারবেন। পর্ব ভাঙলে এই লাইনগুলির চেহারা এইরকম দাঁড়ায় :
অস্ত্ৰান মাসে/পড়েছে, ঠান্ডা/বড়ো,
ব্যাঘ্র পালায়,/জমে যায় খালি/বিল;
বৃক্ষশাখায়/বসে কাঁপে থরো/থরো
সঙ্গবিহীন/বৃদ্ধ একটি/চিল।
কবি, তুমি যাও,/হাটেমাঠে খুঁজে/মারো
দু-চারটে মন-/মজানো কথার/মিল;
গৃহস্থ তুমি/জানোলা বন্ধ/করো,
দরোজায় বেশী/ভাল করে আঁটো/খিল।
দেখতেই পাচ্ছেন, এর প্রতি লাইনে আছে দুটি করে পর্ব। (সেইসঙ্গে লাইনের প্রান্তে একটি করে ভাঙা-পর্ব রয়েছে)। আর প্রতি পর্বে আছে ছটি করে মাত্রা (ভাঙা পর্বগুলি দু-মাত্রার)। বলা বাহুল্য, পর্বের সংখ্যা আমরা ইচ্ছে করলেই আরও বাড়াতে পারতুম।
আর-একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। ধরা যাক, এবারে আমরা মাছ নিয়ে লিখব। তা বঙ্গদেশে আজ মাছ নিয়ে কিছু লেখা মানেই মাছ-না-থাকার কথা লেখা। মীনাভাবে হীন হয়ে আছি; না আছে ইলিশ, না আছে পাকা রুই: বাজারে ঢুকলে যেন কান্না পায়; নিষ্পাদপ ভূখণ্ডে বাঁটকুল এরণ্ডও যেমন দ্রুমের সম্মান পায়, ‘নির্মীন’ বঙ্গদেশে টিলাপিয়া তেমনি আজ ফাঁকতালে আসর জমাচ্ছে। তা এই কথাগুলিকে আমরা ৬-মাত্রার চালে এমননিভাবে সাজাতে পারি। :
ইলিশ, তোমাকে দেখি না,
শুধুই তোমার স্বপ্ন দেখে
সপ্তাহ-মাস-বৎসর যায়,
দুঃখে বিন্দরে হিয়া।
সান্ত্বনা দিতে নেই পাকা রুই,
সেও বহুকাল থেকে
নিখোঁজ, এখন বাজার জমায়
রাশি রাশি টিলাপিয়া।