সন্দেশ/চেখে দেখা/ছিল সুক/ঠিন;
চোখে দেখা,/তা-ও হল/নিষিদ্ধ/তাই
চক্ষুতে/আসে। জল/তাই রাত/দিন
সন্দেশ/নিয়ে শুধু/পদ্য বা/নাই।
দেখা যাচ্ছে, পদ্যটির এক-এক লাইনে আমরা তিনটি করে পর্ব (এবং সেইসঙ্গে লাইনের প্রান্তে একটি ভাঙা-পর্ব) পাচ্ছি, এবং প্রতি পর্বে পাচ্ছি। চারটি মাত্রা। মাত্রাবৃত্তের ফ্যামিলিতে এ হল ৪-মাত্রার চাল।
*
ফি-লাইনে যে তিনটি করেই পর্ব রাখতে হবে, এমন কোনও কথা নেই। পর্বের সংখ্যা আমরা ইচ্ছে করলেই কমাতে কিংবা বাড়াতে পারি। কিন্ত চারি-মাত্রার চালটা। তাতে পালটাবে না। আর ফি-লাইনের শেষে যে ওই ভাঙা-পর্বটি পাচ্ছি, ওর যে কী কাজ, তা আশা করি আর নতুন করে ব্যাখ্যা করতে হবে না। অক্ষরবৃত্ত নিয়ে আলোচনার সময়েই ভাঙা-পর্বের কাজের কথাটা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছি। তবু, বাহুল্য হলেও আর-এক বার বলি যে, ওর কাজ আর-কিছুই নয়, এক লাইন থেকে অন্য লাইনে যাবার আগে পাঠককে ও একটু দাঁড় করিয়ে রাখে, তাকে একটু দম ফেলবার ফুরসত দেয়। তা সে যাই হোক, ভাঙা-পর্বটি এক্ষেত্রে ২-মাত্রার। ইচ্ছে করলে আমরা ১-মাত্রা কিংবা ৩-মাত্রার ভাঙা-পর্বও ব্যবহার করতে পারতুম।
৪-মাত্রার চালের আর-একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। এবারে যে-পদ্য বানোব, তার ফি-লাইনে থাকবে ৪-মাত্রার দুটি করে পর্ব আর সেইসঙ্গে ১-মাত্রার একটি ভাঙা-পর্ব।
সাতপাঁচ ভাবিছটা কী,
কাজে লেগে যাও বাবুজি।
ভেবে ভেবে কুল পায় কে,
অকারণে ভ্ৰান্তি বাড়ে।
ভাবনার কোটি হাত-পা,
লাখো মাথা, প্ৰকাণ্ড হাঁ।
চিন্তার শেষ নেই তো।
চিন্তার নেই সীমানা,
সুতরাং চিন্তা না; না।
পর্ব ভাগ করে দেখলেই বোঝা যাবে যে, আমরা কথার খেলাপ করিনি; যে-নিয়মে লাইনে বাঁধব বলেছিলুম, ঠিক সেই নিয়মেই বেঁধেছি/ভাগ করে দেখালে আমাদের লাইনগুলির চেহারা এই রকমের দাঁড়ায় :
সাতপাঁচ/ভাবিছটা/কী,
কাজে লেগে/যাও বাবু/জি।
ভেবে ভেবে/কুল পায়/কে,
অকারণে/ভ্রান্তি বা/ড়ে।
ভাবনার/কোটি হাত-/পা,
লাখো মাথা/প্রকাণ্ডা/হাঁ।
থই পাবে/কই তার/জো,
চিন্তার/শেষ নেই/তো।
চিন্তার/নেই সীমা/না,
সুতরাং/চিন্তা না;/না।
গুনে দেখুন, এর ফি-লাইনে ৪-মাত্রার দুটি করে পর্ব আছে; আর সেইসঙ্গে আছে ১-মাত্রার একটি ভাঙা-পর্ব।
৪-মাত্রার চালের আর-একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। এবারে আমাদের ফি-লাইনে থাকবে তিনটি করে পর্ব, আর ভাঙা-পর্বটি হবে ৩-মাত্রার। বিষয় : সূর্যগ্রহণ। পদ্যটিকে আমরা এইরকমে সাজাতে পারি। :
দিবার আজ বড়ো করুণার পাত্র
চক্ষু নিবেছে তার, আলো নেই আকাশে।
নিশানাথ-সাথে নেই ভেদ লেশমাত্র, সকালের পাগড়িতে যেন চাঁদ বাকী সে। পর্ব ভেঙে দেখলে এই লাইনগুলির চেহারা এই রকমের দাঁড়ায় :
দিবাকর/আজ বড়ো/করুণার/পত্র,
চক্ষুনি/বেছে তার/আলো নেই/আকাশে।
নিশানাথ/সাথে নেই/ভেদ লেশ/মাত্র,
সকালের/পাগড়িতে/যেন চাঁদ/বাঁকা সে।
অর্থাৎ ফি-লাইনে এখানে পর্ব আছে তিনটি করে। ভাঙা-পর্ব একটি। পর্বগুলি ৪-মাত্রার। ভাঙা-পর্বগুলিকে আমরা ৩-মাত্রার রেখেছি।
আর নয়। মাত্রাবৃত্তের এলাকায় ৪-মাত্রার চাল আমরা অনেক দেখলুম। এর পরে ৫-মাত্রার চাল দেখব। প্রসঙ্গত বলে রাখি, ভাঙা-পর্বের বৈচিত্ৰ্য আর দেখতে চাইনে। ছন্দের মূল চাল তো আর ভাঙা-পর্বের হ্রাসবৃদ্ধির উপরে নির্ভর করে না। সুতরাং তার উপরে জোর দিয়ে লাভ নেই।
***
পাঁচ মাত্রার চালের মাত্রাবৃত্তের প্রতি পর্বে থাকে পাঁচটি করে মাত্রা। তবে কান পাতলেই ধরা পড়বে যে, আমরা যাকে ৫ বলছি, বস্তৃত সে ৩ + ২। অর্থাৎ ৫-মাত্রার পর্ব আসলে ৩-মাত্রা আর ২-মাত্রার সমষ্টি; বিজোড়-জোড়ে তার শরীর গড়া।। ৪-মাত্রার ছন্দ এগোয় খটখট-খাটাখাট চালে; ৫-মাত্রার ছন্দ সেক্ষেত্রে খটাস-খাট খটাস-খাট ধ্বনি জাগিয়ে চলতে থাকে। নীচের লাইনগুলি লক্ষ করুন :
আসতে-যেতে এখনো তুলি চোখ,
রেলিঙে আর দেখি না নীল শাড়ি।
কোথায় যেন জমেছে কিছু শোক,
ভেঙেছ খেলা সহসা দিয়ে আড়ি।
এখন সব স্তবধ নিরালোক;
অন্ধকারে ঘুমিয়ে আছে বাড়ি।
এ হল ৫-মাত্রার চাল। এর প্রতি লাইনে আছে দুটি করে পর্ব (ইচ্ছে করলেই পর্ব আরও বাড়ানো যেত); আর সেইসঙ্গে একটি ভাঙা-পর্ব। পর্বগুলি ৫-মাত্রায় গড়া; ভাঙা-পর্বটি ২-মাত্রার। ভেঙে দেখলে এই লাইনগুলির চেহারা এইরকম দাঁড়ায় :
আসতে- যেতে/এখনো তুলি/চোখ,
রেলিঙে আর/দেখি না। নীল/শাড়ি।
কোথায় যেন/জমেছে কিছু/শোক,
ভেঙেছ খেলা/সহসা দিয়ে/আড়ি।
এখন সব/স্তবধ নিরা/লোক,
অন্ধকারে/ঘুমিয়ে আছে/বাড়ি।
৫-মাত্রার চালকে যে কেন ৩ + ২ মাত্রার চাল বলেছি, এখন আর সেটা বুঝতে কোনও অসুবিধে হবার কথা নয়। এ হল বিজোড় + জোড়, বিজোড় + জোড় চাল। মাত্রার হিসেবে শব্দগুলিকে যদি সেইভাবে (অর্থাৎ বিজোড়া + জোড়, বিজোড়’ + জোড় করে) সাজানো হয়, তবে তো কথাই নেই, ছন্দের নৌকো একেবারে তরতর করে চলবে; তবে মাঝে-মাঝে তার অন্যথা ঘটলেও (অর্থাৎ বিজোড়-মাত্রার বিজোড়-মাত্রার শব্দ বসালেও) তাতে কোনও ক্ষতি হয় না। কেন-না, জোড়-মাত্রার শব্দটি প্রথমে বসলেও, ছন্দের চালের তাড়নায়, সে পরবতী শব্দের প্রথম মাত্রাটিকে নিজের শরীরের মধ্যে টেনে আনে। (অর্থাৎ জোড়’ + বিজোড় তখন জোড়বি + জোড় হয়ে যায়।) দৃষ্টান্ত দিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। নীচের লাইনগুলি লক্ষ করুন :