অর্থাৎ চোদো মাত্রায় লাইন সাজিয়ে আমরা যখন লিখি;
ছন্দের গুতো খেয়ে পোড়োদের হায়
চোখ থেকে অবিরল অশু গড়ায়।
কহে কবিকঙ্কণ, ‘কান্না থামাও,
ক্লাস থেকে মানে-মানে চম্পট দাও।’
তখন যুক্তাক্ষরগুলিকে একে-একে ভেঙে-ভেঙে আমরা মাত্রার মাশুল চুকিয়ে দিই; ফলে লাইনগুলির চেহারা বস্তৃত এই রকমের দাঁড়ায় :
ছন্দের গুতো খেয়ে পোড়োদের হায়
চোখ থেকে অবিরল অশ্রু, গড়ায়।
কহে কবিকংকণ, ‘কান্না থামাও,
ক্লাস থেকে মানে-মানে চম্পট দাও।’
লক্ষ করুন, সর্বক্ষেত্রেই আমরা যুক্তাক্ষরকে ভেঙে দিয়েছি, ফলে ফি-লাইনে এখন চোদ্দোটি করে অক্ষর পাচ্ছি, এবং সেই চোদো অক্ষরের প্রত্যেকেই এক-একটি করে মাত্ৰা-মূল্য পাচ্ছে (ভাঙিনি শুধু একটি যুক্তাক্ষরকে; চতুর্থ লাইনের ‘ক্লাস’ শব্দের ‘ক্ল’-কে। এই ব্যতিক্রমের কারণ আপনার আগেই জেনেছেন। যুক্তাক্ষরটি এক্ষেত্রে শব্দের প্রথমেই রয়েছে; ফলে তাকে ভাঙা সম্ভব নয়। শব্দের প্রথমে আছে বলে মাত্রাবৃত্তেও সে এক-মাত্রার বেশি দাবি করবে না।)
আসলে ব্যাপারটা এই যে, মাত্রাবৃত্তের বেলায় হস্বর্ণগুলিকেও একটি করে মাত্রার মূল্য দিয়ে দিতে হয়। অক্ষরবৃত্তের ক্ষেত্রে শুধু বিযুক্ত হস্বর্ণগুলিকেই আমরা মাত্রার মূল্য দিই। (অনেকসময়ে তা-ও দিই না, বিযুক্ত থাকা সত্ত্বেও তাদের মাত্রা আমরা দরকার হলেই গাপ করি); মাত্রাবৃত্তের বেলায় সেক্ষেত্রে বিযুক্ত হস্বর্ণগুলি তো মাত্রার মূল্য পায়ই, তদুপরি যেসব হিসাবর্ণ যুক্তাক্ষরের মধ্যে লুকোনো, মাত্রাবৃত্ত তাদেরও যুক্তাক্ষরের ভিতর থেকে টেনে বার করে আনে, এবং তাদের হাতেও একটি করে মাত্রার মূল্য ধরিয়ে দেয়। অক্ষরবৃত্তের কষ্ট’ (২-মাত্রা) তাই মাত্রাবৃত্তের কাছে কষট’ (৩-মাত্রা), অক্ষরবৃত্তের আনন্দ’ (৩-মাত্রা) তাই মাত্রাবৃত্তের কাছে ‘আননন্দ (৪-মাত্ৰা); অক্ষরবৃত্তের মহোল্লাস’ (৪-মাত্রা) তাই মাত্রাবৃত্তের কাছে মহোলালাস” (৫-মাত্রা)। এবং এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে, অক্ষরবৃত্তের রাস্তা” আর মাত্রাবৃত্তের রাস্তা” মোটেই এক নয়। আর তাই মাত্রাবৃত্তকে আসলে মাতৃরাবৃত্ত লিখলেই ঠিক হত; ছা্ন্দসিকেরা তাতে নিশ্চয় বিন্দুমাত্র অসন্তুষ্ট হতেন না!
আমরা বলেছি, মাত্রাবৃত্তের সূচনা মানসী পর্বের কবিতায়। মানসী-র ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “আমার রচনার এই পর্বেই যুক্ত অক্ষরকে পূর্ণ মূল্য দিয়ে ছন্দকে নূতন শক্তি দিতে পেরেছি।” পূর্ণ মূল্য দেওয়ার অর্থ দুই মাত্রার মূল্য দেওয়া। বাংলা কবিতায় যুক্তাক্ষরকে ইতিপূর্বে দুই-মাত্রার মূল্য দেবার সুনির্দিষ্ট রীতি ছিল না। এখন যুক্তাক্ষরকে ভেঙে তাকে দুই-মাত্রার মূল্য দিয়ে দেখা গেল, ছন্দের চোলই একেবারে পালটে গেছে। ঘাড়ের উপর থেকে বাড়তি বোঝা নামিয়ে দেওয়ায় তার গতি অনেক বেড়ে গেছে; সে আর গজেন্দ্রগমনে চলতে চাইছে না।
উপমা দিয়ে বলতে পারি, অক্ষরবৃত্তের চাল যেন হাতির চাল; পিঠের উপরে যুক্তাক্ষরের বাড়তি বোঝা নিয়ে সে ধীরপায়ে এগোয়। আর মাত্রাবৃত্ত যেন তেজি ঘোড়ার মতো; সংকেত পেলেই সে যুক্তাক্ষরের শিকল ছিঁড়ে ঘাড় বেঁকিয়ে পায়ের খুরে হস্যবর্ণের খাটাখাট ধ্বনি বাজিয়ে ছুটতে থাকে।
মানসী-র দ্বিতীয় কবিতা ‘ভুল ভাঙা’। তার প্রথম স্তবকেই দেখছি :
“বাহুলতা শুধু বন্ধনপাশ
বাহুতে মোর।”
‘বন্ধন’কে ভেঙে এখানে চার-মাত্রার মূল্য দেওয়া হয়েছে। ছান্দসিক বলছেন, শুধু বাহুলতার বন্ধন কেন, বাংলা কবিতায় যুক্তাক্ষরের বন্ধনও এই একই সঙ্গে ভেঙে গেল।
অক্ষরবৃত্ত আর মাত্রাবৃত্তের চাল যে একেবারে আলাদা, তা আমরা বুঝতে পেরেছি। কেন আলাদা তা-ও বুঝলুম। এখন, মাত্রাবৃত্তের আপনি এলাকার মধ্যে যেসব আলাদা আলাদা চাল রয়েছে, তার খবর নিতে হবে।
মাত্রাবৃত্তের চাল সাকুল্যে চার রকমের। ৪-মাত্রার চাল, ৫-মাত্রার চাল, ৬-মাত্রার চাল, আর ৭-মাত্রার চাল। অনেকে আবার ৮-মাত্রার চালের কথা বলেন। কিন্তু ৮-মাত্রার চাল যে একটা আলাদা জাতের চাল, এমন কথা মেনে নেওয়া শক্ত। শ্ৰীপ্ৰবোধচন্দ্র সেন মহাশয়ও তাকে আলাদা জাতের চাল বলে মেনে নেননি। আসলে, হঠাৎ দেখলে যাকে ৮-মাত্রার চাল বলে মনে হয়, পর্ব ভাঙলে বুঝতে পারি যে, সেটা ৪-মাত্রারই একটা রকমফেরমাত্র, তাকে আলাদা একটা চাল বলাটা ঠিক নয়।
মূল কথায় ফিরে আসি। লাইনের এক-একটা অংশ কিংবা পর্বে মাত্ৰা-সংখ্যা কত, তারই হিসেব নিয়ে আমরা বলি, এটা অত-মাত্রার চাল, সেটা তত-মাত্রার। এবারে আসুন, মাত্রাবৃত্ত ছন্দে এমনকিছু পদ্য বানাই, যার প্রতিটি পর্বের মাত্ৰা-সংখ্যা হচ্ছে চার।
কী নিয়ে পদ্য বানাব? সন্দেশ নিয়ে? বেশ, তা-ই হোক। ওই মহার্ঘ বস্তু মুখে তোলা যে জনসাধারণের পক্ষে কোনওকালেই খুব সহজ ছিল, এমন বলতে পারিনে, তবে চোখে অন্তত দেখা যেত। কিছুকাল আগে ছানার মিষ্টি নিষিদ্ধ হওয়ায় তা-ও যাচ্ছিল না। সেইসময়কার পটভূমিকায় সন্দেশ-বিষয়ক একটি পদ্য বানানো যাক। তা আমাদের তৎকালীন বেদনার কথাটাকে আমরা এইভাবে প্রকাশ করতে পারি। :
সন্দেশ চেখে দেখা ছিল সুকঠিন;
চোখে দেখা, তা-ও হল নিষিদ্ধ, তাই
চক্ষুতে আসে জল, তাই রাতদিন
সন্দেশ নিয়ে শুধু পদ্য বানাই।
পদটা বিশেষ জুতের হল না। না হোক, চালটা ঠিকই বুঝতে পারা যাবে। আরও ভালো করে বুঝবার জন্যে এই লাইন-কাটিকে পর্বে পর্বে ভাগ করে ফেলা যাক। ভাগ করলে এর চেহারাটা এই রকমের দাঁড়ায়–