মাত্রাবৃত্তের সঙ্গে অক্ষরবৃত্তের প্রধান পার্থক্যটা এইখানেই। মাত্রাবৃত্তের বেলায় যে-নিয়মে আমরা এক-একটা লাইনের ধ্বনিপ্রবাহকে ভাগ করে মাত্রা গণনা করি, তাতে প্রতিটি অক্ষর তো এক-মাত্রার মূল্য পায়-ই, যুক্তাক্ষর পায় দু-মাত্রার মূল্য। (বলা বাহুল্য, সেই যুক্তাক্ষরটি শব্দের মধ্যে কিংবা অন্তে থাকা চাই, এবং সেই যুক্তাক্ষরের ঠিক পূর্ববর্তী বর্ণটি হস্বৰ্ণ না-হওয়া চাই*; শব্দের আদিতে যুক্তাক্ষর থাকলে তার মাত্রাগত মূল্য বাড়ে না, সে তখন ধ্বনিগত ওজনের বিচারে আর পাঁচটা সাধারণ অক্ষরের তুল্যমূল্য। যুক্তস্বর ঐ” আর ‘ঔ’ –এর দাপট অবশ্য আরও কিছু বেশি। শব্দের আদি-মধ্য-অন্ত যেখানেই থাক, মাত্রাবৃত্তে তারা দু-মাত্ৰা আদায় করবেই।)
আসলে কথাটা এই যে, অক্ষরবৃত্ত ছন্দে উচ্চারণকে সংকুচিত ক’রে মাত্রার যোগফলে গোল না-ঘটিয়েও শব্দের ওজন বাড়িয়ে নেবার যে-সুবিধেটা পাওয়া যায়, মাত্রাবৃত্তে সেটা মেলে না। মাত্রাবৃত্তে যদি যুক্তাক্ষর ঢোকাই, তবে দু-মাত্রার মূল্য সে ঠিকই আদায় করে ছাড়বে। (অবশ্য— আবার বলি- সে যদি শব্দের মধ্যে কিংবা অন্তে থাকে এবং তার পূর্ববতী বর্ণটি যদি হিসাবর্ণনা হয়।) মাত্রার মাশুল ফাঁকি দিয়ে শব্দের ওজন বাড়াবার কোনও উপায়ই এক্ষেত্রে নেই। নীচের লাইন দুটি লক্ষ করুন :
আকাশে হঠাৎ দেখে একফালি চাঁদ
ছন্দের কামড়ে কবি হলেন উন্মাদ।
বলাই বাহুল্য, এই লাইন দুটি অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লেখা। এর প্রথম লাইনে অক্ষরের সংখ্যা মোট চোদ্দো, যুক্তাক্ষর একটিও নেই, এবং মাত্রার সংখ্যাও মোট চোদ্দো। দ্বিতীয় লাইনে অক্ষরের সংখ্যা মোট চোদ্দো, তার মধ্যে দু-দুটি যুক্তাক্ষর, কিন্তু মাত্রার সংখ্যা। তবু চোদ্দে তো চোদ্দেই, তার এক কাচ্চাও বেশি নয়। অর্থাৎ যুক্তাক্ষরের জন্য সেখানে বাড়তি মাত্রার মাশুল গুনতে হয়নি।
মাত্রাবৃত্ত হলে কিন্ত এমনটি হতে পারত না। সেখানে যুক্তাক্ষর ঢোকালেই সে দু-মাত্রা মাশুল আদায় করে ছাড়ত। নীচের লাইন দুটি লক্ষ করুন।
যেই তিনি দেখেছেন একফালি চাঁদ
কবিবর হয়েছেন ঘোর উন্মাদ।
এ-দুটি লাইন মাত্রাবৃত্ত ছন্দে লেখা। প্রথম লাইনে অক্ষরের সংখ্যা মোট চোদ্দো, যুক্তাক্ষর একটিও নেই, এবং মাত্রার সংখ্যা মোট চোদ্দো। দ্বিতীয় লাইনে অক্ষরের সংখ্যা মোট তেরো, কিন্তু মাত্রার সংখ্যা। তবু চোদ্দো, তার কারণ তেরোটি অক্ষরের মধ্যে একটি হচ্ছে যুক্তাক্ষর, এবং সেই যুক্তাক্ষরটি দু-মাত্রা আদায় করে ছেড়েছে। হিসেবটা সুতরাং এই রকমের দাঁড়াল। বারোটি সাধারণ অক্ষর = ১২ মাত্রা; তৎসহ একটি যুক্তাক্ষর = ২ মাত্রা; মোট ১৪ মাত্রা। বাস্।
প্রশ্ন এই যে, যুক্তাক্ষরকে এখানে আমরা দু-মাত্রা দিচ্ছি কেন। উত্তর : দিতে বাধ্য হচ্ছি; ছন্দের চাল। নইলে ঠিক থাকে না। ছন্দের চাল ঠিক রাখবার জন্যেই যুক্তাক্ষরকে এখানে আমরা বিশ্লিষ্ট করছি; তাকে ভেঙে দুটি পৃথক অক্ষর হিসেবে পড়ছি। এবং সেইজন্যেই (অর্থাৎ তাকে ভেঙে দুটি পৃথক অক্ষর হিসেবে পড়ছি বলেই) তাকে দু-দুটি মাত্রা দিতে হচ্ছে।
,অক্ষরবৃত্ত আশ্লেষে স্মৃৰ্তি পায়, মাত্রাবৃত্ত বিশ্লেষে। অক্ষরবৃত্ত জোড়া দিতে চায়, মাত্রাবৃত্ত ভাঙতে। অক্ষরবৃত্তে শব্দের মধ্যবতী বিযুক্ত হস্বৰ্ণও অনেকসময়ে, দৃশ্যত না হোক, শ্রবণের ঔদার্যে তার পরবর্তী অক্ষরের সঙ্গে যুক্ত হয়। যথা চার জন= চার্জন। মাত্রাবৃত্তে তার উলটো নিয়ম। সেখানে যুক্তাক্ষরকেও আমরা বিযুক্ত করে। পড়ি। যথা সার্জন= সারজন। অক্ষরবৃত্তে পোস্ট অফিসের চতুরক্ষর “ডাকতার’-বাবুটকেও প্রয়োজনবোধে কানের কাছে ত্রিবীর্ণ ‘ডাক্তার’ হিসেবে চালিয়ে দিয়ে ১-মাত্রা গাপ করা যায়। মাত্রাবৃত্তে কিন্তু খাঁটি ত্ৰিবৰ্ণ ‘ডাক্তার বাবুটিও ৪-মাত্রার কম ফি নেন না। কানের কাছে তিনিই তখনই চতুরক্ষর ডাক্তার বাবু। অক্ষরবৃত্তে ‘খাকতির খাই, দরকার হলে, ২-মাত্রার মূল্য দিয়েই মেটাতে পারি (কানের কাছে তিনি তখন খাঁক্তি); মাত্রাবৃত্তে ‘ভক্তি’র মতো বিশুদ্ধ হৃদয়বৃত্তিও ‘ভকতি’ হিসেবে শক্ত হাতে পুরো তিন মাত্ৰা আদায় করে ছাড়ে।
মাত্রাবৃত্তের এইটিই হচ্ছে বৈশিষ্ট্য। যুক্তাক্ষরকে সে যুক্ত থাকতে দেয় না, তাকে সে ভেঙে দেয়। এই জন্যেই এককালে একে যুক্তাক্ষর-ভাঙা ছন্দ বলা হত।
বাংলা কবিতায় যুক্তাক্ষরকে এইভাবে ভেঙে পড়বার কোনও সুনির্দিষ্ট রীতি আগে ছিল না। রবীন্দ্রনাথ এই নতুন রীতির প্রবর্তক। প্রবর্তন ঘটল তাঁর মানসী-পর্বের কবিতায়। তার আগে যে তিনি কিংবা আর-কেউ যুক্তাক্ষরকে কদাচ ভেঙে ব্যবহার করেননি, এমন বলতে পারিনে, তবে ভাঙলেও সেটা আকস্মিক ঘটনা, তখনও সেই ভাঙাটা কোনও নির্দিষ্ট নিয়মের ব্যাপার হয়ে ওঠেনি। অর্থাৎ অক্ষরবৃত্তের জানলা দিয়ে মাত্রাবৃত্ত তখন এক-আধ বার এসে উকি দিয়ে যেত মাত্র, তার বেশি কিছু নয়। মানসী-তেই প্রথম দেখতে পাওয়া গেল যে, যুক্তাক্ষরকে ভেঙে ব্যবহার করবার প্রবণতা একটা নির্দিষ্ট, পরিকল্পিত নিয়মের বাঁধনে এসে ধরা দিয়েছে। সেই হিসেবে মানসী-তেই এই নতুন ছন্দের- মাত্রাবৃত্তের— সূচনা।
দেখতে পেলুম, মাত্রাবৃত্তের বেলায় আমরা যুক্তাক্ষরগুলিকে ভেঙে ভেঙে পড়ি। ছন্দের চাল নইলে ঠিক থাকে না। চালটাকে ঠিক রাখবার জন্যেই এক্ষেত্রে শব্দের ভিতরকার কিংবা শেষের যুক্তাক্ষরকে ভেঙে দুটি আলাদা-আলাদা অক্ষর হিসেবে গণ্য করতে হয়, এবং আলাদা-আলাদাভাবেই তাদের মাত্রার মাশুল চুকিয়ে দিতে হয়। (যুক্তস্বর ঐ কিংবা ঔ অবশ্য শব্দের আদিতে থাকলেও মাত্রাবৃত্তে দু-মাত্রার মর্যাদা পায়। সে-কথা আমরা আগেও বলেছি)। আমরা লিখি বটে শব্দ’, কিন্তু মাত্রার মূল্য দিতে গিয়ে তাকে ‘শবদ’রূপে গণ্য করি। আমরা দেখি বটে ‘অক্ষর’, কিন্তু মাত্রার মাশুল দেবার বেলায় তাকেই ‘অকখর হিসেবে দেখতে হয় (বিদ্বজ্জন অবশ্য ‘অক্ষর’ শুনলে আরও বেশি খুশি হবেন। কিন্তু আমরা তো আর বিদ্বজ্জন নই, তাই ‘অকখর’ শুনেই তুষ্ট থাকব।) আমরা ‘ছন্দ বিচার করতে গিয়ে মাত্রাবৃত্তের বেলায় তাকে ‘ছন্দ’ হিসেবে বিচার না করে পারি না।