এ হল মাত্রাবৃত্ত ছন্দ। অক্ষরবৃত্তের সঙ্গে একে একবার মিলিয়ে নিন। মেলাতে গেলেই অমিলটা বেশ স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়বে।
আরও কিছু দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। পাশাপাশি এই দুই ছন্দের চেহারা দেখতে দেখতে এদের অমিলটা যখন একেবারে স্পষ্ট হয়ে যাবে, তখনই শুরু হবে মাত্রাবৃত্তের চরিত্রবিচার। আগেই যদি চরিত্রবিচার করতে বসি, ব্যাপারটা তাহলে অত সহজে পরিষ্কার হবে না। কার চরিত্র কী রকমের সেটা বস্তৃতা দিয়ে বোঝানো শাস্তু; দৃষ্টান্তের সাহায্য নিলে সে-কাজ অনেক সহজে সম্পন্ন হয়। যার পিঠে কখনও কিল পড়েনি, তাকে যদি বলি, “কিল বলিতে বদ্ধমুষ্টির সাহায্যে প্রদত্ত এক প্রকারের আঘাত বুঝায়”—তবে আর তার কতটুকুই-বা সে বুঝবে? তার চাইতে বরং গুম করে তার পিঠের উপরে একটা কিল বসিয়ে দেওয়া ভালো।
সুতরাং আসুন, মাত্রাবৃত্তের বৈশিষ্ট্য কী, হাতে-কলমে সেটা বুঝে নিই। অর্থাৎ, অক্ষরবৃত্তের পাশাপাশি আরও কয়েক বার তার চেহারাটা বেশ উত্তমরূপে নিরীক্ষণ করি, এবং বুঝবার চেষ্টা করি, অক্ষরবৃত্তের সঙ্গে তার তফাতটা ঠিক কোথায়।
ধরা যাক, আমরা রেলগাড়ি নিয়ে দু-লাইন পদ্য বানাব। গর্জন করে ট্রেন ছুটছে, এবং সেই গর্জন শুনে মাঠের গোরু দিগন্তের দিকে দৌড় লাগাচ্ছে, এই হবে তার বিষয়বস্তু।
লাইন দুটিকে প্রথমে আমরা অক্ষরবৃত্তে লিখব। তা এইভাবে তাকে লেখা যেতে পারে :
গর্জন কম্পিত বিশ্ব, ট্রেন ছুটে যায়;
আতঙ্কে গোরুর দল দিগন্তে পালায়।
এবারে এই কথাগুলিকে মাত্রাবৃত্ত ছন্দে বেঁধে ফেলা যাক। এইভাবে বাঁধা যেতে পারে :
গর্জন কাঁপে মাটি, ট্রেন ছুটে যায়।
আতঙ্কে গোরুগুলি দিগন্তে ধায়।
কানের কাছে তফাতটা আশা করি ধরা পড়েছে। এবার আসুন, আর-একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। এবারে কী নিয়ে পদ্য লিখব? প্রেম নিয়ে? ভালো ভালো, পদ্য রচনার পক্ষে প্ৰেম অতি চমৎকার বিষয়বস্তু। তা ধরা যাক, প্রেমিক তার প্রেমিককে বলছে যে, সে (অর্থাৎ প্রেমিক) যদি তাকে (অর্থাৎ প্রেমিকাকে) পাশে পায়, তাহলে দৈত্যের সঙ্গেও সে (অর্থাৎ প্রেমিক) লড়তে রাজি। অক্ষরবৃত্ত ছন্দে এই কথাগুলিকে এইভাবে বাঁধা যায় :
তুমি যদি সারাক্ষণ পার্শ্বে থাকো নারী,
দৈত্যকেও তবে আমি যুদ্ধ দিতে পারি।
অনেকে হয়তো বলবেন যে, প্রেমিকের উক্তিটা এক্ষেত্রে একেবারেই যাত্রাপ্যাটার্নের হয়ে গেল। তা হোক, এ তো আর একালের আটাশ-ইঞি-বুকের-ছাতি লিন্কপিকে প্রেমিক নয় যে, মিনমিনে গলায় কথা বলবে। আর কেঁচার খুঁটে চোখের জল মুছতে-মুছতে ঘন-ঘন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলবে। এ হচ্ছে সেকালের বীরপুরুষ প্রেমিক। সেকালে প্রেমিকেরা বনবান করে তলোয়ার ঘোরাত এবং ঘ্যাচাং করে। দৈত্যদানের মুণ্ডু কেটে ফেলত। সুতরাং তাদের উক্তিতে যদি একটু বীরত্বের বড়াই থাকে, তবে তা নিয়ে এত আপত্তির কী আছে! আর তা ছাড়া উক্তি নিয়ে আমরা এখানে মাথা ঘামাচ্ছিনে, আমরা ছন্দের পার্থক্য বুঝতে চাই। সুতরাং পার্থক্যটাকে বুঝে নেবার জন্য, আর কথা না বাড়িয়ে, এই উক্তিটিকে এবারে আমরা মাত্রাবৃত্তে বাঁধব। এইভাবে বাঁধা যাক :
তোমাকে যদি পার্শ্বে পাই,
তাহলে আমি, নারী
দৈত্যকেও অকুতোভয়ে
যুদ্ধ দিতে পারি।
পার্থক্যটা বুঝতে পারছেন? নিশ্চয়ই পারছেন। তবু আসুন, আরও একটা দৃষ্টান্তের সাহায্য নেওয়া যাক।
এবারে আমরা কী নিয়ে লিখব? প্রেম নিয়ে তো লিখলুম, এবারে বিরহ নিয়ে লেখা যেতে পারে। অক্ষরবৃত্তে আমাদের বিরহী নায়কের উক্তিটা এই রকমের চেহারা নিচ্ছে :
যে নেই সম্মুখে, কানে কণ্ঠ তার বাজে;
দিন চলে যায়, তবু রাত্রি যায় না যে।
আবার মাত্রাবৃত্তে এই একই কথাকে আমরা এইরকমে বাঁধতে পারি। :
সম্মুখে নেই, তবু কানে কানে
কণ্ঠ তাহারি বাজে,
দিন চলে যায়, দিবা অবসানে
নিশীথিনী যায় না যে।
আর নয়। অনেক দৃষ্টান্ত দিয়েছি। অক্ষরবৃত্তের দৃষ্টান্তগুলির সঙ্গে মাত্রাবৃত্তের দৃষ্টান্তগুলিকে এবারে উত্তমরূপে আর-একবার মিলিয়ে নিন। তাদের পার্থক্য বুঝতে তাহলে আর এতটুকু অসুবিধে হবে না।
কথা এই যে, পার্থক্য যেমন অক্ষরবৃত্ত আর মাত্রাবৃত্তের মধ্যে আছে, তেমনি আবার মাত্রাবৃত্তের আপনি এলাকাতেও আছে। অর্থাৎ এক-ধরনের মাত্রাবৃত্তের সঙ্গে অন্য-ধরনের মাত্রাবৃত্তের আছে। মাত্রাবৃত্তের ধরন মাত্র একটি নয়, অনেক। পার্থক্য তাদের নিজেদের মধ্যেও আছে বটে, কিন্তু সেই ঘরোয়া পার্থক্যের প্রকৃতিও পৃথক।
সে কথা পরে। মাত্রাবৃত্তের মধ্যেকার ঘরোয়া পার্থক্যের কথা পরে বোঝা যাবে। তার আগে অক্ষরবৃত্ত আর মাত্রাবৃত্তের মৌলিক পার্থক্যটা বুঝে নেওয়া চাই।
অক্ষরবৃত্তের মোটামুটি নিয়মটা আশা করি ইতিমধ্যে আপনারা ভুলে যাননি। ‘মোটামুটি” কথাটা ব্যবহার করলুম। এইজন্যে যে, নিয়মের ব্যতিক্রমও নেহাত কম নয়। কিছু কিছু ব্যতিক্রমের হদিসও আমরা পেয়েছি। তা সে যা-ই হোক, ব্যতিক্রমের কথা ছেড়ে দিলে, মোটামুটি যে-নিয়মটা পাওয়া যায়, সেটা এই যে, অক্ষরবৃত্ত ছন্দে অক্ষর আর মাত্রার সংখ্যা সাধারণত সমান সমান; অর্থাৎ এর এক-এক লাইনে যত অক্ষর তত মাত্রা। শুধু তা-ই নয়, যুক্তাক্ষর যদিও শব্দের ওজন বাড়ায়, তবু অক্ষরবৃত্ত ছন্দের গণনাপদ্ধতি এতই সমদৰ্শী যে, যুক্তাক্ষরকে সে একমাত্রার বেশি মর্যাদা দেয় না।