প্রদীপ
বনবীথি জনশূন্য নিশীথে;
শঙ্কিত শিখা বক্ষোদীপে ;
সুদূরের বাঁশি ডাকে অভিসারে ;
পিছনে কে চলে পা টিপে টিপে ;
পথের দু পাশে ভূতের জটলা
স্মৃতি-বিস্মৃতি উজাড় করে ;
চিত্রার্পিত পুরাণ কাহিনী
নক্ষত্রের ঘুণাক্ষরে ;
চক্রী পবনে গুঢ় কানাকানি,
প্রতিবাদে জাগে প্রতিধ্বনি ;
বনস্পতির নিবিদ রটায়
অবোধ হৃদয়ে কি আগমনী ;
অনাদি কালের চির রহস্য
ত্রস্নু শরীরে বেপথু হানে ;
সৃজননেমীর ঘূর্নাবর্ত
ভ্রাম্যমাণেরে কেন্দ্রে টানে;
বিশ্বপিতার হাতে হাত রেখে,
শিশু ধরিত্রী আচম্বিতে
দোলা ছেড়ে ওঠে, টলমল পদে
ক্রান্তিবলয়ে টহল দিতে;
স্তম্ভিত কভু হয় না সে তবু,
যদিও পলক পড়ে না চোখে ;
শুধু আনন্দ বেদনার সাড়া
পায় মাঝে মাঝে মানসলোকে ।।
নিশীথে বিজন বনবীথি যবে,
শঙ্কিত শিখা বক্ষোদীপে,
নিরুদ্দেশের যাত্রী তখন
আপনার ছবি নিরখে নীপে ;
প্রথম প্রাণের পরম প্রণবে
সার্থক তার মর্মবাণী;
অভিসারিকার নূপুরে সে-সুর,
সে-তালে দোদুল অরণ্যানি ;
অগ্নিগর্ভ গুল্মে আবার
পুরাণপুরুষ আবির্ভূত ;
কান্ডে কান্ডে ধরা পড়ে যূপ
আত্মবলির মন্ত্র-পূত,
যুগান্তরের সঞ্চিত খেদ
নিবেদন করে মৌন তারে ;
মৃত্যুদণ্ডে নতশির যীশু
তারই অগ্রিম কপটাচারে ;
দর্শক আর দৃশ্যের দ্বিধা
ঘুচে যায় তার সংগোপনে ;
থাকেনা প্রভেদ শ্রুতিতে শ্রোতাতে ;
প্রবর্তকে ও প্রবর্তনে ;
প্রেমেও যেহেতু নিষ্কাম, তাই
নির্বিকার সে দুঃখে,সুখে ;
আত্মীয়-পর সরূপ যমজ,
পক্ষপাতের আপদ চুকে ;
নৈশ পাখীর স্বগত কূজনে
পূরে আরব্ধ কাব্যকলি ;
জানে সে কোথায় মাধুরী জমায়
অন্ধকারের অতলে অলি ;
চটকের চ্যুতি দেখে সে যেমন,
তেমনই মুগ্ধ উল্কাপাতে ;
ভাস্বর বনবীথিকা যখন
দীপ্রহৃদয়, নিভৃত রাতে ।।
দূর থেকে দূরে যায় সে একাকী,
নিঃস্ব, অথচ পৃথিবীপতি ;
অদ্বিতীয় সে অনুকম্পায়,
ত্রিভুবনে তার অবাধ গতি ;
মন্দাকিনীর অমৃত শীকর
থেকে থেকে তার মাথায় ঝরে ;
অধরার বরমাল্য গলায়,
সৃষ্টির চাবি মুক্ত করে,
সে আসে যেখানে বন্দী অরূপ
যক্ষজাগর পাতালে কাঁদে,
পারায়ে বনের নৈশ নিরালা
বক্ষোদীপের আশীর্বাদে ।।
-হিউ মেনাই
প্রদোষ
প্রদোষ : বিলীয়মান দূর বনরাজী;
কানে আসে কাকের কলহ ;
শৈলমূলে কুয়াশা ও একাধিক দীপ;
সর্বোপরি একমাত্র গ্রহ ;
চাষীরা ফসল মাড়ে ওই যে-খামারে,
থেমে গেছে ওখানে গুঞ্জন ।
প্রদোষ সখার সঙ্গে পরিচিত পথে
পুনরায় করি বিচরণ ।।
যারা মৃত, এক কালে প্রিয় ছিল যারা,
ভাবি সেই বন্ধুদের কথা :
মৃত আজ সে-সুন্দর বন্ধুরা,যদিও
ক্ষণস্থায়ী মৃত্যুর ক্ষমতা;
তাদের সুন্দর দৃষ্টি অশুচি ধূলায়,
একে একে, নিবে গেছে কবে ;
সুন্দরহৃদয় তারা প্রচুর প্রসাদ
এনেছিল আমার শৈশবে ।।
-জন্ মেস্ফীল্ড
ফাল্গুনী
বসন্তদিনের সনে করিব কি তোমার তুলনা?
তুমি আরও কমনীয়,আরও স্নিগ্ধ,নম্র,সুকুমার :
কালবৈশাখীতে টুটে মাধবের বিকচ কল্পনা,
ঋতুরাজ ক্ষীণপ্রাণ,অপ্রতিষ্ঠ যৌবরাজ্য তার ;
আলোকের বিলোচন কখনও বা জ্বলে রুদ্র তাপে,
কখনও সন্নত বাষ্পে হিরণ্ময় অতিশয় ম্লান ;
প্রাকৃত বিকারে, কিংবা নিয়তির গূঢ় অভিশাপে,
অসংবৃত অধঃপাতে সুন্দরের অমোঘ প্রস্থান ।
তোমার মাধুরী কিন্তু কোনও কালে হবে না নিঃশেষ :
অজর ফাল্গুনী তুমি, অনবদ্য রূপের আশ্রয় ;
মানে না প্রগতি তব মরনের প্রগল্ভ নির্দেশ,
অমৃতের অধিকারী যেহেতু এ-পঙ্ক্তিকতিপয় ।
মানুষ নিঃশ্বাস নেবে, চোখ মেলে তাকাবে যাবৎ,
আমার কাব্যের সঙ্গে তুমি রবে জীবিত তাবৎ ।।
-উইলিয়ম্ শেক্স্পীয়র
মাধুরী
শুন্য মাঠে সূর্যোদয়,গিরিশৃঙ্গে সূর্যাস্ত দেখেছি,
গম্ভীর সৌন্দর্যে শান্ত সনাতন গায়ত্রীর মতো ;
মাধবের সমাগমে অতসীর পরাগ মেখেছি ;
প্রত্যক্ষ করেছি তৃণ নব জলধারায় উদ্গত ।।
ফুলের খেয়াল আর সমুদ্রের ধ্রুপদ শুনেছি;
পাল-তোলা তরী থেকে তাকিয়েছি কত দূর দেশে ;
কিন্তু সে সমস্তে নয়, বিধাতার প্রসাদ গুনেছি
তার বাঁকা বিম্বাধরে, কন্ঠস্বরে, দৃষ্টিপাতে,কেশে ।।
–জন্ মেস্ফীল্ড
মায়ার খেলা
বিদ্যুতের পক্ষপাতী যেহেতু আমি, তাই
ভাবো কি নই কুলিশে কৃতবিদ্য ?
ভ্রান্ত ব’লে বোঝো না লীলা দেখাই, না দেখাই,
স্বভাবতই আমি অশনিসিদ্ধ ।।
শুনতে পাবে পরীক্ষার ভয়ঙ্কর দিনে
আমার রূঢ় কণ্ঠ মেঘমন্দ্রে,
ত্রাহিস্বর বাত্যাহত বৃক্ষে তথা তৃণে,
প্রতিধ্বনি রন্ধ্র থেকে রন্ধ্রে ।।
সে-দুর্যোগে বজ্র মেতে উঠবে তান্ডবে,
লাগবে যত প্রাসাদে ভূমিকম্প,
দৈবতের গর্ব হবে খর্ব খাণ্ডবে,
অবাধ শত শিখার উল্লম্ফ ।।
-হাইন্রিখ্ হাইনে
স্বপ্নপ্রয়াণ
চেয়ে দেখেছিলে আমাকে নিবিড় সুখে,
বিচ্ছেদে আজ খেদ, ক্ষতি নেই তাই;
যেখানেই থাকো,সেখানে, দীপ্র মুখে,
স্বপ্নকে দিও আঁধার শয়নে ঠাঁই ।।
ঘুমে বুজে আসে তোমার তরল আঁখি,
বিবশ রসনা মানে না তথাপি মানা ;
মিলনে যে-কটি কথা রয়ে গেল বাকী,
অবাধ হয়েছে বিরহে তাদের হানা ।।
ঘুমাও,ঘুমাও, আরামে ঘুমাও তবে,
আমার আশিষে তোমার শিয়র পূত;
সংবৃত তুমি অধুনা যে-গৌরবে,
আমি সে-রহসে নিয়ত আবির্ভূত ।।
কৃপণ গানের অমৃত সঞ্চয়নে
ব্যক্ত তোমার অনুপম পরিচিতি ;
বাসা বেঁধেছিলে আজ যে-আলিঙ্গনে,
তাতে বার বার ফেরাবে তোমাকে স্মৃতি ।।
-সীগ্ফ্রিড্ সসুন্