আত্মপরিচয়
মুক্তির সংগ্রামে আমি কাটিয়েছি তিরিশ বৎসর ;
করিনি চেষ্টার ত্রুটি দূরবর্তী দুর্গের রক্ষায় ;
ছিল না জয়ের আশা, তবু যুদ্ধে থেকেছি তৎপর;
ভাবিনি অক্ষত দেহে ঘরে ফিরে যাব পুনরায়।।
অহোরাত্র পাহারায় এক বারও ফেলিনি পলক ;
অসাধ্য লেগেছে নিদ্রা শিবিরের সামান্য শয়নে ;
অনিচ্ছায় ঢুল এলে, তৎক্ষণাৎ ভেঙেছে চমক
সৎসাহসী সঙ্গীদের সমস্বর নাসিকাগর্জনে ।।
মাঝে মাঝে মহানিশা ভ’রে গেছে সান্দ্র অবসাদে,
হৃদয়ে জেগেছে আর্তি- নির্বোধেরই ভয়-ডর নেই-
অশ্লীল গানের কলি সে-সময়ে ভেঁজেছি অবাধে ;
পুরেছে বিবিক্ত মৌন কখনও বা উদ্ধত শিসেই ।।
উন্নিদ্র সন্দেহ চোখে, শব্দভেদী অবধান কানে,
সজাগ বন্দুকে উষ্মা, কৌতূহলী অজ্ঞের প্রগতি
থামিয়েছি অর্ধপথে ; দেখিয়েছি অব্যর্থ সন্ধানে
সূচ্যগ্রপ্রমাণ যত লম্বোদর দাম্ভিকের গতি।।
কিন্তু সে-ক্লীবের দলে হেন শত্রু মিলেছে দৈবাৎ
সাংঘাতিক লক্ষ্যবেধে যে সব্যসাচীর প্রতিযোগী;
না মেনে উপায় নেই-সাক্ষী আছে বহু রক্তপাত,
অসংখ্য উন্মুদ্র ক্ষতে প্রতিপন্ন আমি ভুক্তভোগী ।।
অনাথ দূরান্ত দুর্গ; রক্তগঙ্গা আহত প্রহরী;
বন্ধুরা নিহত,কিংবা অগ্রগামী, নচেৎ বিমুখ;
মরণেও অপরাস্ত, অবশেষে খাতে ট’লে পড়ি;
ভাঙেনি আমার অস্ত্র,শুধু জানি ফেটে গেছে বুক ।।
–হাইন্রিখ্ হাইনে
উত্তর
“চাঁদ কী রকম?” শুধালে কেউ, বোলো,
“এমনইটি ঠিক”, দাঁড়িয়ে ছাদের ‘পরে।
দেখিও মুখের দীপ্র সমারোহ,
“সূর্য কেমন?” –প্রশ্ন যদি করে।
জানতে যে চায় কিসের গুণে যীশু
প্রাণ পুনরায় জাগিয়েছিল শবে,
তার কপাল ও আমার অধর ছুঁয়ো
চুম্বনে-সব সহজ সরল হবে ।।
– জালালুদ্দীন রুমি (ইংরেজি অনুবাদ- সি ফীল্ড্)
গোধূলি
মাঝি-মাল্লার বৈকালী সভা :
আকাশ,বাতাস গোধূলি মাখে :
তার পাশে ব’সে, বাহিরে তাকাই,
যেখানে সিন্ধু অসীমে ডাকে ।।
জ্বলে একে একে দিশারী প্রদীপ,
আলোকমঞ্চ অভয়ে ভাসে ;
দূর দিগন্তে বিবাগী জাহাজ
এখনও দৃষ্টি গোচরে আসে ।।
আলোচনা হয় নাবিক জীবন :
তুফানে কী ক’রে নৌকা ডোবে ;
শুন্যে ও জলে ঘেরা কান্ডারী,
দ্বিধাটলমল খুশিতে, ক্ষোভে ।।
অভাবনীয়ের লীলানিকেতন
অবাচী,উদীচী,প্রতীচী,প্রাচী :
আচারে,বিচারে বিপরীত মতি,
মানবসমাজ সব্যসাচী ।।
স্রোতে প্রতিভাত লক্ষ মানিক,
মত্ত মলয় বকুলবনে,
গঙ্গার তীরে সৌম্য পুরুষ
সমাধিমগ্ন পদ্মাসনে ।।
ল্যাপ্দেশীয়েরা বামনের জাতি,
নোংরা, হাঁ বড়,চ্যাপ্টা মাথা,
আগুন পোহায়, মাছ সেঁকে খায়,
কথা কয় না তো , ঘোরায় জাঁতা ।।
যে যা বলে, সে তা কান পেতে শোনে,
তার পরে মুখ খোলে না আর ;
দেখা যায় না সে-বিবাগী জাহাজ,
বাহিরে গভীর অন্ধকার ।।
-হাইন্রিখ্ হাইনে
পরিবাদ
সাঁচ্চা কিছুই নেই জগতে; দুষ্ট সবাই দোষে।
গোলাপ আপন বোঁটায় বোঁটায় তীক্ষ্ণ কাঁটা পোষে।
সন্দেহ হয় ঊর্ধ্বলোকে দেবতা থাকেন যত,
হয়ত তাঁরাও খাদে ভরা মর্ত্যবাসীর মত।
কিংশুকে, কই, সৌরভই নেই। বৃন্দাবনে তাপ।
গেরুয়া দিয়ে ঢাকেন সাধু মহাবিদ্যার ছাপ।
সীতা যদি গোসা ক’রে মার কাছে না যেত,
পঞ্চসতীর পুণ্য শ্লোকে তবেই সে ঠাঁই পেত।
শিখীর পেখম জবর হলেও,বীভৎস পা তার।
শকুন্তলা, কালিদাসের কাব্যকলার সার,
তার ভণিতাও সকল সময় সহ্য হবার নয়।
কাদম্বরীর বিপুল বহর স্বতই জাগায় ভয়।
ষণ্ড স্বয়ং শিবের বাহন, জানে না দেবভাষা।
বাচস্পতি শেখেননি তো বয়েৎ খাসা খাসা।
কোণারকের সুন্দরীদের পাছা বেজায় ভারী।
বাঙালীদের নাকের আবার নেই কো বাড়াবাড়ি।
ছন্দ যতই হোক না মধুর, খুঁত থেকে যায় মিলে।
মৌচাকে,হায়, বিষাক্ত হুল। গ্রাম্য বধুর পিলে।
ব্যাধের হাতে মারা গেলেন কৃষ্ণ ভগবান।
তানসেনও, সে কলমা প’ড়ে হল মুসলমান।
স্বর্গচারী, দীপ্ত তারা, সর্দি তাকেও ধরে;
তারও কবর ধূলার ধরায়; ঠান্ডাতে সেও মরে।
দুগ্ধে মিলে ঘাসের গন্ধ। সূর্যদেবের গায়
দাগ দেখা যায় শাদা চোখেও, সেই বোঝে, যে চায়।
তোমায়, দেবী, ভক্তি করি ; কিন্তু তোমার ত্রুটি
কত যে, তার হিসাব রাখি, কোথায় এমন ছুটি?
ডাগর চোখে, শুধাও কি দোষ? আছে কি তার শেষ?
ওই সমতল বুকের তলায় নেই হৃদয়ের লেশ!
–হাইন্রিখ্ হাইনে
প্রত্যাবর্তন
মধুমালতীর কুঞ্জ – চৈত্র সন্ধ্যা- আমরা দু জনে
আবার আগের মতো ব’সে আছি খোলা জানালায়-
চাঁদ ওঠে ধীরে ধীরে , স্নাত মর্ত্য স্নিগ্ধ সঞ্জীবনে-
কেবল আমরা যেন প্রেতচ্ছায়া, গলগ্রহ দায় ।।
দ্বাদশ বৎসর পূর্বে শেষ বসেছিলুম উভয়ে
এখানে যুগলাসনে, এ-রকম কবোষ্ণ প্রদোষে ;
নবানুরাগের জ্বালা ইতিমধ্যে নিবেছে হৃদয়ে,
সম্প্রতি মন্দাগ্নি কাম অনুচিত পারণে, উপোসে ।।
নিতান্ত নিঃসাড় আমি, তথাচ সে কথার জাহাজ ;
মুখের বিরাম নেই, সঙ্গে সঙ্গে নাড়ে নিরন্তর
প্রণয়ের চিতাভস্ম; বোঝে না সে কোন মতে আজ
নির্বাপিত বিস্ফুলিঙ্গ পুনরায় হবে না ভাস্বর।।
অফুরন্ত ইতিহাস : কুচিন্তার বিরুদ্ধে সে নাকি
এত দিন যুদ্ধ ক’রে উপনীত আর্তির চরমে
অপ্রতিষ্ঠ একনিষ্ঠা, পাপস্পর্শে নষ্ট তার রাখী।
তাকাই বোবার মতো সে যখন সায় চায় সমে ।।
অগত্যা পালিয়ে বাঁচি; কিন্তু মৃত লাগে চন্দ্রালোক;
ভূতের কাতার দেখি দু পাশের অতিক্রান্ত গাছে;
নিরালায় কথা কয় পৃথিবীর পুঞ্জিভূত শোক;
ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলি, তবু সঙ্গ ছাড়ে না পিশাচে।।
-হাইন্রিখ্ হাইনে