সমাপ্তি
বরষাবিষন্ন বেলা কাটালাম উন্মন আবেশে |
জনশূণ্য হৃদয়ের কবাট উদ্ঘাটি’,
স্মরণে চলাচল করিলাম সহজ, সরল |
দৃষ্টিহারা নেত্রপাতে দেখিলাম সন্নত আকাশে
এইমতো আর-এক দিবসের ছবি |
অবিশ্রান্ত বৃষ্টির বিলাপে
শুনিলাম সে কণ্ঠের স্নেহসম্ভাষণ |
অর্গলিত বাতায়নে ঝটিকার নিরর্থ আক্রোশে
বিচ্ছেদবিধ্বস্ত হিয়া বাখানিলো ক্ষুব্ ধ অক্ষমতা
নির্বিকার, নিরুত্তর, রুক্ষ বিধাতারে ||
এলো সন্ধ্যা রক্তবরিষণ ;
দিনান্তের মুমূর্ষু বর্তিকা
প্রাকনির্বাপণ দীপ্তি প্রজ্বলিত করিল সহসা
প্রাণের অন্তিম শক্তিব্যয়ে ;
তার পর অন্তরে বাহিরে
অন্ধকার বিস্তারিল শবপ্রাবরণী ||
মনে হ’লো আশা নাই
মনে হ’লো ভাষা নাই পিঞ্জরিত ব্যর্থতা বলার |
মনে হ’লো
সংকুচিত হ’য়ে আসে মরণের চক্রব্যূহ যেন |
মনে হ’লো রন্ধ্রচারী মুষিকের মতো
শটিত জঞ্জালকণা কুড়ায়েছি এতকাল ধ’রে
কৃপণের ভাণ্ডারে ভাণ্ডারে ;
এইবার ফুরায়েছে পালা,
ঘাতক যন্ত্রের কারা অবরুদ্ধ হ’লো অবশেষে ;
এইবার উত্তোলিত সম্মার্জনীমূলে
পিষ্ট হবে অচিরাৎ অকিঞ্চন উঞ্ছবৃত্তি মম ||
সৃষ্টিরহস্য
আয়ুর সোপানমার্গ বহু কষ্টে অতিক্রম করি
উন্মুক্ত মৃত্যুর প্রান্তে ঊর্ধ্বমুখে দাঁড়ায়েছি এসে ;
সিন্ধুর ভাস্বর আঁখি খোঁজে মোরে নিম্নে নিরুদ্দেশে ;
আমার আরতিদীপ মহাশুন্যে সাজায় শর্বরী ।।
সম্মুখে নিখিল নাস্তি, পৃষ্ঠদেশে মৌল নীরবতা ;
প্রশান্তি দক্ষিণে, বামে ; জনহীন, অন্তর,বাহির।
তবু কার আবির্ভাবে কণ্টকিত আমার শরীর ;
অবচেতনার তলে গুমরে কী জাতিস্মর কথা?
তবে কি বিরাট শূন্য শূন্য নয়, সাগরের প্রেত ;
উদ্বেল বিক্ষোভ তার পরিণত বিদেহ ঈথারে?
তবে কি দুর্মর মর্ত্য ক্রন্দসীতে ক্রন্দন বিথারে;
শস্যের মিসরী শবে উপ্ত সম্ভাবনার সংকেত ?
নির্লিপ্ত আলোর দ্বীপ নয় ওই দিব্য নীহারিকা,
কালের প্রপাতে মগ্ন বাসনার ভাসমান ফেনা ?
অবচ্ছিন্ন তারারাশি, ওরা চিরদিনকার চেনা
পশুদের স্থুল সত্তা, লালসার মূর্ত বিভীষিকা ?
নাই নাই মৌন নাই, সর্বব্যাপী বাঙ্ময় জগৎ ;
নির্বাণ বুদ্ধির স্বপ্ন, মৃত্যুঞ্জয় জ্বলন্ত হৃদয় ;
হয়ত মানুষ মরে, কিন্তু তার বৃত্তি বেঁচে রয় ;
জন্ম হতে জন্মান্তরে সংক্রমিত প্রত্ন মনোরথ ।।
কপোল কল্পনা ত্যাগ ; নিরাসক্তি অসাধ্যসাধন;
অনন্তপ্রস্থান মিথ্যা ; সত্য শুধু আত্মপরিক্রমা ;
বিদ্রোহে স্বাতন্ত্র্য নাই ; মুক্তি মানে নিরুপায় ক্ষমা ;
সৃষ্টির রহস্য মাত্র আলিঙ্গন, পুনরালিঙ্গন।।
তন্বী (১৯৩০)
শ্রাবণবন্যা
সংকীর্ণ দিগন্ত-চক্র ; অবলুপ্ত নিকট গগনে ;
পরিব্যাপ্ত পাংশুল সমতা ;
অবিশ্রান্ত অবিরল বক্রধারা ঝরিছে সঘনে ;
হাঁকে বজ্র বিস্মৃত মমতা ;
প্লাবিত পথের পাশে আনত বঙ্কিম তরুবীথি
শিহরিছে প্রমত্ত ঝঞ্ঝায় ; নিমজ্জিত প্রহরের বৃতি ;
ভেদ নাই উষায় সন্ধ্যায় ||
পথস্থ কুটিরদ্বারে ভয়ে পান্থ নিয়েছে আশ্রয় ;
সিক্ত গাভী ছুটে চলে গোঠে ;
কপোত কুলায় কাঁপে ; দাদুরী নীরব হয়ে রয় ;
পুষ্পবুকে অশ্রু ভ’রে ওঠে ;
নিষিক্ত স্তব্ধতা ভেদি, প্রলয়ের হুংকার-রণনে,
পরিপ্লুত নদীর কল্লোলে,
উন্মাদ শ্রাবণবন্যা ছুটে আসে ভৈরব নিঃস্বনে,
অবরুদ্ধ পরান-পল্বলে ||
দশমী (১৯৫৬)
প্রতীক্ষা
পাতী অরণ্যে কার পদপাত শুনি
জানি কোনও দিন ফিরবে না ফাল্গুনী;
তবে অঞ্জলি উদ্যত কেন পলাশে?
বনের বাহিরে ক্ষওয়া মাটি ধূ ধূ করে;
নেই ফসলের দুরাশাও অম্বরে;
যা ছিল বলার, কবে হয়ে গেছে বলা সে।।
মহাশূন্যের মৌনে পরিস্ফীত,
বিবিক্তি আজ বেষ্টনীবিরহিত;
অধুনায় নিশ্চিহ্ন অতীত, আগামী;
নাস্তিতে নেতি স্বতঃসিদ্ধ প্রমা,
সোহংবাদীর আর্তি আত্মোপমা,
অগতির গতি মনোরথ বৃথা লাগামই।।
আরও এক বার, হাজার বছর আগে,
বিপ্রলব্ধ আস্থা অন্তরাগে
খুঁজে পেয়েছিল উজ্জীবনের প্রেরণা;
এবং আবার সহস্র বৎসর
পূবে আসে বটে, তবু মন্বন্তর
মানবেতিহাসে সর্বনাশেরই দেশনা।।
অন্তত এতে সন্দেহ নেই আর
অলাতচক্রে ঘুরে ঘুরে, সংসার
অনাদি অমাকে আনে আমাদের গোচরে;
পুঞ্জ পুঞ্জ ব্যক্তির বুদ্ধুদ,
সময়ের স্রোতে অচির, অরুন্তুদ,
মমতার জোট পাকায় এ-চরে, ও-চরে।।
অভাব হয়তো স্বভাবেরই অগ্রজ :
নিরবধি তাই প্রভাসে ফুরায় ব্রজ–
প্রতিজ্ঞা রাখে মরণ ত্রাতার বদলে;
বিশৃঙ্খলার পরাকাষ্ঠায় স্থাণু,
পৃথিবী অনাথ; যথেচ্ছ পরমাণু;
প্রগতিক শুধু কালভৈরব সদলে।।
অতএব কারও পথ চেয়ে লাভ নেই :
অমোঘ নিধন শ্রেয় তো স্বধর্মেই;
বিরূপ বিশ্বে মানুষ নিয়ত একাকী।
অনুমানে শুরু, সমাধা অনুশ্চয়ে,
জীবন পীড়িত প্রত্যয়ে প্রত্যয়ে :
তথাচ পাব না আমি আপনার দেখা কি?
কলকাতা
২৭ জুলাই ১৯৫৪
প্রতিধ্বনি (১৯৫৪)
অধঃপাত
অনাচারে ডোবে নিসর্গসুন্দরী-
মানবধর্মে নিয়েছে কি সেও দীক্ষা ?
পশু,পাখী,কীট,ফল,ফুল,মঞ্জরী,
প্রাপ্ত সকলে অপলাপে লোকশিক্ষা ।।
বিশ্বাস করি কী ক’রে কুমুদ সতী ?
হাটে হাঁড়ি ভেঙে ,রসরঙ্গে সে লিপ্ত ;
নটবর নবকার্তিক প্রজাপতি,
অবাক সাধ্বী চাটু চুম্বনে দীপ্ত ।।
ভীরু মাধবীও মনে মনে রঙ্গিলা ;
রতিপরিমলে নেই তার অনায়ত্তি ;
আপাতত যেন কুমারী লজ্জাশীলা,
আসলে সে সাধে মোহিনীর প্রতিপত্তি ।।
বুলবুল গলা কাঁপায় যে পালাগানে,
নেই তাতে উপলব্ধির নাম-গন্ধ ;
সন্দেহ হয় বাঁধা গীতে মিড় টানে
অতিরঞ্জিত কাকুতির নির্বন্ধ ।।
ক্রমে ম’রে আসে সত্য সর্ব ঘটে,
নিষ্ঠা বা তার দেখা পাওয়া আজ শক্ত।
কুকুরের ল্যাজ যথারীতি নড়ে বটে,
কিন্তু জগতে নেই আর প্রভুভক্ত ।।
-হাইন্রিখ্ হাইনে