উত্তর ফাল্গুনী (১৯৪০)
নিরুক্তি
আমারে তুমি ভালবাসো না ব’লে,
দুঃখ আমি অবশ্যই পাই ;
কিন্তু তাতে বিষাদই শুধু আছে,
তাছাড়া কোন যাতনা, জ্বালা নাই।।
জনমাবধি প্রণয়বিনিময়ে
অনেক বেলা হয়েছে অবসান ;
বেজেছে ফলে কেবলই বৃথা ব্যথা,
পারিনি কভু করিতে বরদান।।
এ-ভুজমাঝে হাজার রূপবতী
আচম্বিতে প্রসাদ হারায়েছে ;
অমরা হতে দেবীরা সুধা এনে,
গরল নিয়ে নরকে চ’লে গেছে।।
অযুত নারী, তাদের প্রতিশোধে,
জাগায়ে লোভ হেনেছে অবহেলা ;
সাহারা,গোবি ছেয়েছে ভাঙা পণে,
মরমহিমা হয়েছে ছেলেখেলা।।
অসূয়া বুকে করেছে মাতামাতি
ঝড়ের রাতে বিজুলিঝলাসম;
চিনেছি তাতে আপন নীচতারে,
টুটেছে মান, উঠেছে বেড়ে তম।।
মিলনে ক্ষুধা মিটেনি কোনও কালে ;
কামনা শেষে মিশেছে এসে কামে ।
অন্ধ আশা রুদ্র বিরহেরে
ভাববিলাসী করেছে পরিণামে।।
হয়ত তাই তোমার অনাদরে
আজিকে আমি হই না বিচলিত ;
শিখেছি ঠেকে ব্যর্থ ভালোবাসা,
কালের কাছে অতনু পরাজিত ।।
হৃদয় তবু বিষাদে ভ’রে ওঠে
নিরুদ্দেশ শুন্যে যবে চাই ;
পাই না ভেবে শান্তিতে কি হবে,
সাধনাতে যে সিদ্ধি হেথা নাই।।
নন্দনের বদ্ধ দ্বার, জানি,
যাবে না খুলে তোমার করাঘাতে;
অমৃতযোগে প্রেতের কানাকানি ;
ঘুচাবে ভেদ তৃপ্তি-শোচনাতে।।
তথাপি মিছে আত্মসমাহিতি ;
নিরাসক্তি আসক্তিরই ভেক ;
নাস্তি যার পৃষ্ঠে, পুরোভাগে,
সমান তার বিবেক, অবিবেক।।
আত্মা সদা স্বগত,একা বটে,
তাই কি হেয় দেহের পরিচিতি?
থাক না তাতে তৃষিত অচিরতা,
বাকি যা-কিছু, সবই যে অনুমিতি।।
প্রতিদান
ওগো গরবিনী,সত্রে তোমার
যত উপবাসী নিত্য জুটে,
আমি তো তাদের একজন নই,
চাব না ভিক্ষা চরনে লুটে।
তা ব’লে ভেব না ক্ষুধা নেই মম,
জানি না অভাব নিষ্ঠুরতম,
আশা-নিরাশার দোদুল দোলায়
নামিনি পাতালে, উঠিনি কূটে ।
প্রতিদানহীন ডান নিতে তবু
আসিনি লোভীর সঙ্গে জুটে ।।
বহুবার বিধি বহু দিক হতে
বহু বঞ্চনা করেছে মোরে
খনে খনে তবু অলোকের স্নেহে
জীবন আমার গিয়েছে ভ’রে ।
কপট পাশায় পৃথিবীপতিরে
বনে পাঠায়েছে অবনত শিরে ;
দ্বৈরথরণে তারই মাহাত্ম্য
দিয়েছে আবার দ্বিগুন ক’রে।
শাপ ও আশিস্, সুধা আর বিষ
একত্রে বিধি বিতরে মোরে ।।
যদিও আজিকে সম্পদহীন
পথে পথে ঘুরি মৌন দুখে,
তবু অরূপের অক্ষয় স্মৃতি
সঞ্চিত আছে আমারই বুকে ।
আমি জানি কোথা কোন পল্বলে
সোনার সবিতা তিলে তিলে গলে,
বকুলবনের কোন্ কোণে শশী
দেখে মুখছবি মুকুরে ঝুঁকে ।
তারার মেলায় যে গণে প্রহর,
অতন্দ্রিত সে আমারই দুখে ।।
যদিও আজিকে বীত নিঃশ্বাস,
দীর্ণ আমার মোহন বেণু,
তবু হয়েছিল সে-সুরে সিদ্ধি,
যা শুনে ভ্রষ্ট কল্পধেনু
ফিরে আসে গোঠে গোধূলিবেলায়,
চপলতা জাগে রাধিকার পায়,
মধুমালতীর বন্ধ্যা শাখায়
উড়ে এসে লাগে সৃজনরেণু ।
দেবতারা রাতে দীপ্র নয়নে
শুনে গেছে মোর দিব্য বেণু ।।
যেই বিভিষিকা ছায়ার সমান
ফেরে অহরহ রূপের পাছে,
বহুবার তার আকার,প্রকার
ব্যক্ত হয়েছে আমার কাছে।
আমার মনের আদিম আঁধারে
বাস করে প্রেত কাতারে কাতারে ।
প্রাক্পুরাণিক বিকট পশুর
দায়ভাগ মোর শোণিতে নাচে ।
সমুখে মরুর মরীচিকা ডাকে,
প্রলয়পয়োধি গরজে পাছে ।।
খিন্ন হলেও আমার নয়ন
দিব্যদৃষ্টি তাতেই রাজে।
আমি জানি কেন নিগূঢ় বেদনা
নবপ্রণয়ীর মরমে বাজে।
নির্মিত আমি পরশ পাথরে;
মৃন্ময়ী হয়য় সোনা মোর করে ।
জানি উর্বশী চিরযৌবনা
কারে পরখিতে জরতী সাজে ।
বুঝি আমি কোন্ নিগম অর্থ
ইতরের অপভাষায় রাজে ।।
তোমার প্রাণের পরতে পরতে
যে-অনাম তৃষা গুমরি কাঁদে,
অনুকম্পায়ী জীববীণা মোর
ঝংকৃত আজ সে অনুনাদে।
অচিন পথের দূতরূপে তাই
প্রতিদিন এসে দুয়ারে দাঁড়াই ;
অভাবনীয়ের আহ্বান নিয়ে
অবক নয়ন তোমায় সাধে ।
নিত্য জ্বালায় কলুষকালিমা
জানি ; তাই হিয়া দরদে কাঁদে ।।
নিয়ে যাবো আমি তোমারে যে –পথে,
সে-পথে একাকী যায় না যাওয়া ;
পদে পদে তার কাঁটার আঘাত,
পাকে পাকে হাঁকে পাগল হাওয়া ;
হিতবুদ্ধির তড়িৎ ভ্রুকুটি
দূরদিগন্তে উঠে ফুটিফুটি;
ভ্রমে আশেপাশে হিংসালু শিবি ;
পশ্চাতে আর যায় না চাওয়া ।
সর্বহারার দুর্গম পথে
নিয়ামক বিনা যায় না যাওয়া।।
তবু পরিহরি বিত্তের মোহ
রিক্ত অয়নে দাঁড়াও নেমে।
তোমার ত্যাগের দাম ধ’রে দেব
অনির্বচন অমর প্রেমে ;
নিয়ে যাব যেথা নেই দেশ-কাল,
নেই ব্যাধি-জরা, ক্ষয়-জঞ্জাল,
সত্য যেখানে স্বপ্নসুষমা,
ভেদ নেই যেথা সীসায় হেমে।
স্বার্থপরের অর্ঘ্যের লোভ
ত্যাগ ক’রে এসো নিভৃতে নেমে ।।
মোদের সমুখে নন্দনবন
আগলমুক্ত আবার হবে ;
রবে পদতলে অলকানন্দা,
ইন্দ্রধনুর তোরণ নভে ।
রচি ফুলশেজ চ্যুত পারিজাতে
পীযূষপেয়ালা তুলে দেব হাতে ।
উধাও মলয় দ্যুলোকে-ভূলোকে
মোদের প্রেমের কাহিনী কবে।
মোর অসাধ্যসাধনে, মানবী,
নিশ্চয় তুমি সিদ্ধ হবে।
ক্রন্দসী (১৯৩৭)
অকৃতজ্ঞ
আমার মৃত্যুর দিনে কৌতূহলী প্রশ্ন করে যদি-
সাধিলাম কি সুকৃতি, হব যার প্রসাদে অমর ?
মেনে নিও মুক্ত কণ্ঠে, নেই মোর পাপের অবধি ;
সারা ইতিহাস খুঁজে মিলিবে না হেন স্বার্থপর ।।
অজস্র ঐশ্বর্য মোরে অর্পিয়াছে সমুদার বিধি ;
ভুঞ্জেছি নিষ্কুন্ঠ মনে সে-সকলই প্রাপ্য ভেবে আমি ।
পেয়েছি অমিত সুধা আমন্থিয়া কালের বারিধি ;
করেছি তা আত্মসাৎ, শুধু বিষ কন্ঠে গেছে থামি ।।
দেখেছি এ-মরচক্ষে নটরাজ মহাশূন্যে নাচে;
শুনেছি পার্থিব কানে সে-নক্ষত্রনুপূরের ধ্বনি।
তথাপি আমার বীণা বাজায়েছে বেসুর পিশাচে ;
অধরার অনুনাদে সাড়া কভু দেয়নি ধমনী।।
ফাল্গুন অঙ্গনে মোর ছড়ায়েছে অশোক পলাশ।
দক্ষিণের বাতায়নে কৃষ্ণচূড়া হেনেছে বৈশাখ ।
জাগায়ে মেদুর মেঘে চপলার চকিত বিলাস
বিকচ কদম্বকুঞ্জে আষাঢ় দিয়েছে মোরে ডাক ।।
শেফালিরঞ্জিত হস্তে নবান্নের নৈবেদ্য এনেছে
অতিক্রমি কাশবন সিতাম্বর শ্যামল আশ্বিন ।
কাননে ছড়ায়ে সোনা উদাসী অঘ্রান চ’লে গেছে
পৌষের পাথেয় দিতে সর্বহারা হয়েছে বিপিন ।।
তথাপি অভাব মোর মিটে নাই মুহূর্তের তরে ;
অপব্যয়ী প্রকৃতির অরক্ষিত দানসত্র থেকে
অপহরি মহাবিত্ত আনিয়াছি বৎসরে বৎসরে
অন্তর্ভৌম কোষাগারে মরুলুপ্ত সুড়ঙ্গের পথে ।।
সে-উদার দৃষ্টান্তেও হয় নাই কার্পণ্য লজ্জিত,
সন্দেহের অবকাশ পায় নাই গৃধ্নুতা আমার।
ফিরেছি ধনীর দ্বারে অপলাপী চীবরে সজ্জিত,
বলেছি নাটকী স্বরে, বিশ্বে শুধু সত্য অবিচার ।।
অন্তরঙ্গ সখাসম ফুলধনু আমার ইঙ্গিতে
ফুটায়েছে পারিজাত হিমরুক্ষ তুঙ্গ তপোবনে ;
স্বয়ংবরা শৈলসুতা এসেছে কৌমার্য নিবেদিতে ;
টুটেছে দুঃস্বপ্ন মোর ব্রহ্মান্ডের মঙ্গলাচরণে ।।
তবু মোর নীল কন্ঠে উঠে নাই কামোদ ঝংকারি;
অনভ্যস্ত রসনায় উৎসরিত হয়নি দীপক ।
মোর প্রিয়সম্ভাষণে বিরহের আশঙ্কা সঞ্চারি,
অন্তরের দ্বার জুড়ে হেসেছে অশ্লীল বিদূষক ।।
গোপন বৈভব আমি ব্যক্ত কভু করিনি প্রিয়ারে ;
বুঝি নাই বিনিময়, বিনা বরে কুড়িয়েছি পূজা;
অভিব্যাপ্ত ক্ষুধা মম অবরোধে ঘিরেছে তাহারে ;
পরিতৃপ্তি বিতরিতে পারেনি স্বয়ং দশভূজা।।
নিমেষ না যেতে তাই ফুরায়েছে প্রথম আবেশ;
উন্মীলিত বিলোচন জ্বলিয়াছে বিপ্রবলব্ধ লোভে,
অচিরাৎ সে-আগুন কামেরে করেছে ভস্মশেষ ;
অপর্না সেজেছে চন্ডী আত্মহিতে মোর উপদ্রবে ।।
কেবলই চেয়েছি আমি, ক্ষতি কভু ছোঁয়নি আমারে ;
কোনওদিন বজ্রাঘাতে সর্বস্বান্ত করেনি উর্বশী ;
মোর তারাদীপাবলী মূলাধার অমার ফুৎকারে
কখনও যায়নি নিবে, ধংসমূক হয়নি ক্রন্দসী ।।
শিখিনি কদাচ আমি কাম্য যার নিশ্চিন্ত অমরা,
অনির্বাণ কুম্ভীপাকে হতে হয় তাহারে নিখাদ ।
শুধুই জঞ্জালে তাই ভরিয়াছি প্রাণের পসরা ;
গায়ত্রী জপেছি, কিন্তু শোনা গেছে নিরর্থ নিনাদ ।।
আমার মৃত্যুর দিনে, তাই যদি অলস জিজ্ঞাসু
মাগে শবপরিচিতি, বিনা ভাষ্যে বোলো তারে,সখা,-
জগতের কোনও কাজে লাগেনি এ-অখ্যাত গতাসু,
যায়নি অনাথ ক’রে কোনও মৌন হৃদয়-অলকা।।