দেওয়ালী
(ভূপেন্দ্রনাথ ভট্রাচার্য-কে)
তোর সেই ইংরেজীতে দেওয়ালীর শুভেচ্ছা কামনা
পেয়েছি, তবুও আমি নিরুৎসাহে আজ অন্যমনা,
আমার নেইকো সুখ, দীপান্বিতা লাগে নিরুৎসব,
রক্তের কুয়াশা চোখে, স্বপ্নে দেখি শব আর শব।
এখানে শুয়েই আমি কানে শুনি আর্তনাদ খালি,
মুমূর্ষু কলকাতা কাঁদে, কাঁদে ঢাকা, কাঁদে নোয়াখালী,
সভ্যতাকে পিষে ফেলে সাম্রাজ্য ছড়ায় বর্বরতঃ
এমন দুঃসহ দিনে ব্যর্থ লাগে শুভেচ্ছার কথা;
তবু তোর রঙচঙে সুমধুর চিঠির জবাবে
কিছু আজ বলা চাই, নইলে যে প্রাণের অভাবে
পৃথিবী শুকিয়ে যাবে, ভেসে যাবে রক্তের প্লাবনে।
যদিও সর্বদা তোর শুভ আমি চাই মনে মনে,
তবুও নতুন ক’রে আজ চাই তোর শান্তিসুখ,
মনের আঁধারে তোর শত শত প্রদীপ জ্বলুক,
এ দুর্যোগ কেটে যাবে, রাত আর কতক্ষণ থাকে?
আবার সবাই মিলবে প্রত্যাসন্ন বিপ্লবের ডাকে,
আমার ঐশ্বর্য নেই, নেই রঙ, নেই রোশনাই-
শুধু মাত্র ছন্দ আছে, তাই দিয়ে শুভেচ্ছা পাঠাই।।
নিভৃত
অনিশ্চিত পৃথিবীতে অরণ্যের ফুল
রচে গেল ভুল;
তারা তো জানত যারা পরম ঈশ্বর
তাদের বিভিন্ন নয় স্তর,
অনন্তর
তারাই তাদের সৃষ্টিতে
অনর্থক পৃথক দৃষ্টিতে
একই কারুকার্যে নিয়মিত
উত্তপ্ত গলিত
ধাতুদের পরিচয় দিত।
শেষ অধ্যায় এল অকস্মাৎ।
তখন প্রমত্ত প্রতিঘাত
শ্রেয় মেনে নিল ইতিহাস,
অকল্পেয় পরিহাস
সুদূর দিগন্তকোণে সকরুণ বিলাল নিঃশ্বাস।
যেখানে হিমের রাজ্য ছিল,
যেখানে প্রচ্ছন্ন ছিল পশুর মিছিলও
সেখানেও ধানের মঞ্জরী
প্রাণের উত্তাপে ফোটে, বিচ্ছিন্ন শর্বরী;
সূর্য-সহচরী!
তাই নিত্যবুভুক্ষিত মন
চিরন্তন
লোভের নিষ্ঠুর হাত বাড়াল চৌদিকে
পৃথিবীকে
একাগ্রতায় নিলো লিখে।
সহসা প্রকম্পিত সুষুপ্ত সত্তায়
কঠিন আঘাত লাগে সুনিরাপত্তায়।
ব্যর্থ হল গুপ্ত পরিপাক,
বিফল চীৎকার তোলে বুভুক্ষার কাক
–পৃথিবী বিস্ময়ে হতবাক।।
নিভৃত ২
বিষণ্ণ রাত, প্রসন্ন দিন আনো
আজ মরণের অন্ধ অনিদ্রায়,
সে অন্ধতায় সূর্যের আলো হানো,
শ্বেত স্বপ্নের ঘোরে যে মৃতপ্রায়।
নিভৃত-জীবন-পরিচর্যায় কাটে
যে দিনের, আজ সেখানে প্রবল দ্বন্দ্ব।
নিরন্ন প্রেম ফেরে নির্জন হাটে,
অচল চরণ ললাটের নির্বন্ধ?
জীবন মরণে প্রাণের গভীরে দোলা
কাল রাতে ছিল নিশীথ কুসুমগন্ধী,
আজ সূর্যের আলোয় পথকে ভোলা
মনে হয় ভীরু মনের দুরভিসন্ধি।।
পঁচিশে বৈশাখের উদ্দেশে
আমার প্রার্থনা শোনো পঁচিশে বৈশাখ,
আর একবার তুমি জন্ম দাও রবীন্দ্রনাথের।
হাতাশায় স্তব্ধ বাক্য; ভাষা চাই আমরা নির্বাক,
পাঠাব মৈত্রীর বাণী সারা পৃথিবীকে জানি ফের।
রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে আমাদের ভাষা যাবে শোনা
ভেঙে যাবে রুদ্ধশ্বাস নিরুদ্যম সুদীর্ঘ মৌনতা,
আমাদের দুঃখসুখে ব্যক্ত হবে প্রত্যেক রচনা।
পীড়নের প্রতিবাদে উচ্চারিত হবে সব কথা।
আমি দিব্যচক্ষে দেখি অনাগত সে রবীন্দ্রনাথ;
দস্যুতায় দৃপ্তকণ্ঠ (বিগত দিনের)
ধৈর্যের বাঁধন যার ভাঙে দুঃশাসনের আঘাত,
যন্ত্রণায় রুদ্ধবাক, যে যন্ত্রণা সহায়হীনের।
বিগত দুর্ভিক্ষে যার উত্তেজিত তিক্ত তীব্র ভাষা
মৃত্যুতে ব্যথিত আর লোভের বিরুদ্ধে খরদার,
ধ্বংসের প্রান্তরে বসে আনে দৃঢ় অনাহত আশা;
তাঁর জন্ম অনিবার্য, তাঁকে ফিরে পাবই আবার।
রবীন্দ্রনাথের সেই ভুলে যাওয়া বাণী
অকস্মাৎ করে কানাকানি;
‘দামামা ঐ বাজে, দিন বদলের পালা
এ ঝড়ো যুগের মাঝে’।
নিষ্কম্প গাছের পাতা, রুদ্ধশ্বাস অগ্নিগর্ভ দিন,
বিষ্ফারিত দৃষ্টি মেলে এ আকাশ, গতিরুদ্ধ রায়ু ;
আবিশ্ব জিজ্ঞাসা এক চোখে মুখে ছড়ায় রঙিন
সংশয় স্পন্দিত স্বপ্ন, ভীত আশা উচ্চারণহীন
মেলে না উত্তর কোনো, সমস্যায় উত্তেজিত স্নায়ু।
ইতিহাস মোড় ফেরে পদতলে বিধ্বস্ত বার্লিন ,
পশ্চিম সীমান্তে শান্তি, দীর্ঘ হয় পৃথিবীর আয়ু,
দিকে দিকে জয়ধ্বনি, কাঁপে দিন রক্তাক্ত আভায়।
রামরাবণের যুদ্ধে বিক্ষত এ ভারতজটায়ু
মৃতপ্রায়, যুদ্ধাহত, পীড়নে-দুর্ভিক্ষে মৌনমূক।
পূর্বাঞ্চল দীপ্ত ক’রে বিশ্বজন-সমৃদ্ধ সভায়
রবীন্দ্রনাথের বাণী তার দাবি ঘোষণা করুক।
এবারে নতুন রূপে দেখা দিক রবীন্দ্রঠাকুর
বিপ্লবের স্বপ্ন চোখে কণ্ঠে গণ-সংগীতের সুর;
জনতার পাশে পাশে উজ্জ্বল পতাকা নিয়ে হাতে
চলুক নিন্দাকে ঠেলে গ্লানি মুছে আঘাতে আঘাতে।
যদিও সে অনাগত, তবু যেন শুনি তার ডাক।
আমাদেরই মাঝে তাকে জন্ম দাও পঁচিশে বৈশাখ।।
পরিখা
স্বচ্ছ রাত্রি এনেছে প্লাবন, উষ্ণ নিবিড়
ধুলিদাপটের মরুচ্ছায়ায় ঘনায় নীল।
ক্লান্ত বুকের হৃৎস্পন্দন ক্রমেই ধীর
হয়ে আসে তাই শেষ সম্বল তোলো পাঁচিল।
ক্ষণভঙ্গুর জীবনের এই নির্বিরোধ
হতাশা নিয়েই নিত্য তোমার দাদন শোধ?
শ্রান্ত দেহ কি ভীরু বেদনার অন্ধকূপে
ডুবে যেতে কাঁদে মুক্তি মায়ায় ইতস্তত;
কত শিখণ্ডী জন্ম নিয়েছে নূতন রূপে?
দুঃস্বপ্নের প্রায়শ্চিত্ত চোরের মতো।
মৃত ইতিহাস অশুচি ঘুচায় ফল্গু-স্নানে;
গন্ধবিধুর রুধির তবুও জোয়ার আনে।
পথবিভ্রম হয়েছে এবার, আসন্ন মেঘ।
চলে ক্যারাভান ধূসর আঁধারে অন্ধগতি,
সরীসৃপের পথ চলা শুরু প্রমত্ত বেগ
জীবন্ত প্রাণ, বিবর্ণ চোখে অসম্মতি।
অরণ্য মাঝে দাবদাহ কিছু যায় না রেখে।
মনকে বাঁচাও বিপন্ন এই মৃত্যু থেকে।
সঙ্গীবিহনি দুর্জয় এই পরিভ্রমণ
রক্তনেশায় এনেছে কেবলই সুখাস্বাদ,
এইবারে করো মেরুদুর্গম পরিখা খনন
বাইরে চলুক অযথা অধীর মুক্তিবাদ।
দুর্গম পথে যাত্রী সওয়ার ভ্রান্তিবিহীন
ফুরিয়ে এসেছে তন্দ্রানিঝুম ঘুমন্ত দিন।
পালাবে বন্ধু? পিছনে তোমার ধূমন্ত ঝড়
পথ নির্জন, রাত্রি বিছানো অন্ধকারে।
চলো, আরো দূরে? ক্ষুদিত মরণ নিরন্তর,
পুরনো পৃথিবী জেগেছে আবার মৃত্যুপারে,
অহেতুক তাই হয়নি তোমার পরিখা খনন,
থেমে আসে আজ বিড়ম্বনায় শ্রান্ত চরণ।
মরণের আজ সর্পিল গতি বক্রবধির-
পিছনে ঝটিকা, সামনে মৃত্যু রক্তলোলুপ।
বারুদের দুম কালো ছায়া আনে, – তিক্ত রুধির ;
পৃথিবী এখনো নির্জন নয়- জ্বলন্ত ধূপ।
নৈঃশব্দ্যের তীরে তীরে আজ প্রতীক্ষাতে
সহস্র প্রাণ বসে আছে ঘিরে অস্ত্র হাতে।।