ছুরি
বিগত শেষ-সংশয়; স্বপ্ন ক্রমে ছিন্ন,
আচ্ছাদন উন্মোচন করেছে যত ঘৃণ্য,
শঙ্কাকুল শিল্পীপ্রাণ, শঙ্কাকুল কৃষ্টি,
দুর্দিনের অন্ধকারে ক্রমশ খোলে দৃষ্টি।
হত্যা চলে শিল্পীদের, শিল্প আক্রান্ত,
দেশকে যারা অস্ত্র হানে, তারা তো নয় ভ্রান্ত।
বিদেশী-চর ছুরিকা তোলে দেশের হৃদয়-বৃন্তে
সংস্কৃতির শত্রুদের পেরেছি তাই চিনতে।
শিল্পীদের রক্তস্রোতে এসেছে চৈতন্য
গুপ্তঘাতী শত্রুদের করি না আজ গণ্য।
ভুলেছে যারা সভ্য-পথ,সম্মুখীন যুদ্ধ,
তাদের আজ মিলিত মুঠি করুক শ্বাসরুদ্ধ,
শহীদ-খুন আগুন জ্বালে, শপথ অক্ষুণঃ
এদেশ অতি শীঘ্র হবে বিদেশী-চর শূন্য।
বাঁচাব দেশ, আমার দেশ, হানবো প্রতিপ,
এ জনতার অন্ধ চোখে আনবো দৃঢ় লক্ষ্য।
বাইরে নয় ঘরেও আজ মৃত্যু ঢালে বৈরী,
এদেশে-জন বাহিনী তাই নিমেষে হয় তৈরী।।
জনতার মুখে ফোটে বিদ্যুৎবাণী
কত যুগ, কত বর্ষান্তের শেষে
জনতার মুখে ফোটে বিদ্যুৎবাণী;
আকাশে মেঘের তাড়াহুড়ো দিকে দিকে
বজ্রের কানাকানি।
সহসা ঘুমের তল্লাট ছেড়ে
শান্তি পালাল আজ।
দিন ও রাত্রি হল অস্থির
কাজ, আর শুধু কাজ!
জনসিংহের ক্ষুদ্ধ নখর
হয়েছে তীক্ষ্ণ, হয়েছে প্রখর
ওঠে তার গর্জন-
প্রতিশোধ, প্রতিশোধ!
হাজার হাজার শহীদ ও বীর
স্বপ্নে নিবিড় স্মরণে গভীর
ভুলি নি তাদের আত্মবিসর্জন।
ঠোঁটে ঠোঁটে কাঁপে প্রতিজ্ঞা দুর্বোধঃ
কানে বাজে শুধু শিকলের ঝন্ঝন্;
প্রশ্ন নয়কো পারা না পারার,
অত্যাচারীর রুদ্ধ কারার
দ্বার ভাঙা আজ পণ;
এতদিন ধ’রে শুনেছি কেবল শিকলের ঝন্ঝন্
ওরা বীর, ওরা আকাশে জাগাত ঝড়,
ওদের কাহিনী বিদেশীর খুনে
গুলি, বন্দুক, বোমার আগুনে
আজো রোমাঞ্চকর;
ওদের স্মৃতিরা শিরায় শিরায়
কে আছে আজকে ওদের ফিরায়
কে ভাবে ওদের পর?
ওরা বীর, আকাশে জাগাত ঝড়!
নিদ্রায়, কাজকর্মের ফাঁকে
ওরা দিনরাত আমাদের ডাকে
ওদের ফিরাব কবে?
কবে আমাদের বাহুর প্রতাপে
কোটি মানুষের দুর্বার চাপে
শৃঙ্খল গত হবে?
কবে আমাদের প্রাণকোলাহলে
কোটি জনতার জোয়ারের জলে
ভেসে যাবে কারাগার।
কবে হবে ওরা দুঃখসাগর পার?
মহাজন ওরা, আমরা ওদের চিনি;
ওরা আমাদের রক্ত দিয়েছে,
বদলে দুহাতে শিকল নিয়েছে
গোপনে করেছে ঋণী।
মহাজন ওরা, আমরা ওদের চিনি!
হে খাতক নির্বোধ,
রক্ত দিয়েই সব ঋণ করো শোধ!
শোনো, পৃথিবীর মানুষেরা শোনো,
শোনো স্বদেশের ভাই,
রক্তের বিনিময় হয় হোক
আমরা ওদের চাই।।
জনরব
পাখি সব করে রব, রাত্রি শেষ ঘোষণা চৌদিকে,
ভোরের কাকলি শুনি; অন্ধকার হয়ে আসে ফিকে,
আমার ঘরেও রুদ্ধ অন্ধকার, ষ্পস্ট নয় আলো,
পাখিরা ভোরের বার্তা অকস্মাৎ আমাকে শোনালো।
স্বপ্ন ভেঙে জেগে উঠি, অন্ধকারে খাড়া করি কান-
পাখিদের মাতামাতি, শুনি মুখরিত ঐকতান;
আজ এই রাত্রিশেষে বাইরে পাখির কলরবে
রুদ্ধ ঘরে ব’সে ভাবি, হয়তো কিছু বা শুরু হবে,
হয়তো এখনি কোনো মুক্তিদূত দুরন্ত রাখাল,
মুক্তির অবাদ মাঠে নিয়ে যাবে জনতার পাল;
স্বপ্নের কুসুমকলি হয়তো বা ফুটেছে কাননে,
আমি কি খবর রাখি? আমি বদ্ধ থাকি গৃহকোণে,
নির্বাসিত মন চিরকাল অন্ধকারে বাসা,
তাইতো মুক্তির স্বপ্ন আমাদের নিতান্ত দুরাশা।
জন-পাখিদের কণ্ঠে তবুও আলোর অভ্যর্থনা.
দিকে দিকে প্রতিদিন অবিশ্রান্ত শুধু যায় শোনা;
এরা তো নগণ্য জানি, তুচ্ছ বলে ক’রে থাকি ঘৃণা,
আলোর খবর এরা কি ক’রে যে পায় তা জানি না।
এদের মিলিত সুরে কেন যেন বুক ওঠে দুলে,
অকস্মাৎ পূর্বদিকে মনের জানালা দিই খুলেঃ
হঠাৎ বন্দর ছাড়া বাঁশি বুঝি বাজায় জাহাজ,
চকিতে আমার মনে বিদ্যুৎ বিদীর্ণ হয় আজ।
অদূরে হঠাৎ বাজে কারখানার পঞ্চজন্যধ্বনি,
দেখি দলে দলে লোক ঘুম ভেঙে ছুটছে তখনি,
মনে হয়, যদি বাজে মুক্তি-কারখানার তীব্র শাঁখ
তবে কি হবে না জমা সেখানে জনতা লাখে লাখ?
জন-পাখিদের গানে মুখরিত হবে কি আকাশ?
– ভাবে নির্বাসিত মন, চিরকাল অন্ধকারে বাস।
পখিদের মাতামাতি; বুঝি মুক্তি নয় অসম্ভব,
যদিও ওঠে নি সূর্য, তবু আজ শুনি জনরব।।
দিক্প্রান্তে
ভাঙন নেপথ্য পৃথিবীতে;
অদৃশ্য কালের শত্রু প্রচ্ছন্ন জোয়ারে,
অনেক বিপন্ন জীব ক্ষয়িষ্ণু খোঁয়াড়ে
উন্মুখ নিঃশেষে কেড়ে নিতে,
দুর্গম বিষণ্ণ শেষ শীতে।
বীভৎস প্রাণের কোষে কোষে
নিঃশব্দে ধ্বংসের বীজ নির্দিষ্ট আয়ুতে
পশেছে আঁদার রাত্রে- প্রত্যেক স্নায়ুতে;-
গোপনে নক্ষত্র গেছে খসে
আরক্তিম আদিম প্রদোষে।।
দিনের নীলাভ শেষ আলো
জানাল আসন্ন রাত্রি দুর্লক্ষ্য সংকেতে।
অনেক কাস্তের শব্দ নিঃস্ব ধানেক্ষেতে
সেই রাত্রে হাওয়ায় মিলাল;
দিক্প্রান্তে সূর্য চমকাল।।
দিনবদলের পালা
আর এক যুদ্ধ শেষ,
পৃথিবীতে তবু কিছু জিজ্ঞাসা উন্মুখ।
উদ্দাম ঢাকের শব্দে
সে প্রশ্নের উত্তর কোথায়?
বিজয়ী বিশ্বের চোখ মুদে আসে,
নামে এক ক্লান্তির জড়তা।
রক্তাক্ত প্রান্তর তার অদৃশ্য দুহাতে
নাড়া দেয় পৃথিবীকে,
সে প্রশ্নের উত্তর কোথায়?
তুষারখচিত মাঠে,
ট্রেঞ্চে, শূন্যে, অরণ্যে, পর্বতে
অস্থির বাতাস ঘোরে দুর্বোধ্য ধাঁধায়,
ভাঙা কামানের মুখে
ধ্বংসস্তূপে উৎকীর্ণ জিজ্ঞাসাঃ
কোথায় সে প্রশ্নের উত্তর?
দিগ্বিজয়ী দুঃশাসন!
বহু দীর্ঘ দীর্ঘতর দিন
তুমি আছ দৃঢ় সিংহাসনে সমাসীন,
হাতে হিসেবের খাতা
উন্মুখর এই পৃথিবীঃ
আজ তার শোধ করো ঋণ।
অনেক নিয়েছ রক্ত, দিয়েছ অনেক অত্যাচার,
আজ হোক তোমার বিচার।
তুমি ভাব, তুমি শুধু নিতে পার প্রাণ,
তোমার সহায় আছে নিষ্ঠুর কামান;
জানো নাকি আমাদেরও উষ্ণ বুক, রক্ত গাঢ় লাল,
পেছনে রয়েছে বিশ্ব, ইঙ্গিত দিয়েছে মহাকাল,
স্পীডোমিটারের মতো আমাদের হৃৎপিণ্ড উদ্দাম,
প্রাণে গতিবেগ আনে, ছেয়ে ফেলে জনপদ-গ্রাম,
বুঝেছি সবাই আমরা আমাদের কী দুঃখ নিঃসীম,
দেখ ঘরে ঘরে আজ জেগে ওঠে এক এক ভীম।
তবুও যে তুমি আজো সিংহাসনে আছ
সে কেবল আমাদের বিরাট মায়।
এখানে অরণ্য স্তব্ধ, প্রতীক্ষা-উৎকীর্ণ চারিদিক,
গঙ্গায় প্লাবন নেই, হিমালয় ধৈর্যের প্রতীক;
এ সুযোগে খুলে দাও ক্রূর শাসনের প্রদর্শনী,
আমরা প্রহর শুধু গনি।
পৃথিবীতে যুদ্ধ শেষ, বন্ধ সৈনিকের রক্ত ঢালাঃ
ভেবেছ তোমার জয়, তোমার প্রাপ্য এ জয়মালা;
জানো না এখানে যুদ্ধ-শুরু দিনবদলের পালা।।