০৪. গোষ্ঠ বিহার
গোষ্ঠ বিহার ।। কামোদ ।।
ব্রজকুল বাল, রাজ পথে আইল,
লইয়া ধেনুর পাল।
সঙ্গে সখাগণ ভায় বলরাম,
শ্রীদাম সুদাম ভাল।।
সুবল সঙ্গেতে, তার কান্দে হাত,
আরপি নাগর রায়।
হাসিতে হাসিতে সঙ্কেত বাঁশীতে,
এ দুই আখর গায়।।
এ কথা আনেতে না পারে বুঝিতে
সুবল কিছু সে জানে।
হৈ হৈ বলি রাজপথে চলি,
কমন গরিছে বণে।।
গবাক্ষে বদন দিয়া প্রেমময়ী,
রূপ নিরীক্ষণ করে।
দোঁহার নয়নে, নয়ন মিলল
হৃদয়ে হৃদয় ধরে।।
দেখিতে শ্রীমুখ মণ্ডল সুন্দর,
ব্যথিত হইলো রাধা।
এ হেন সম্পদ, বনে পাঠাইতে,
তিলেকৈ না করে বাধা।।
কেমন যশোদা মায়ের পরাণ,
পুথলি ছাড়িয়া দিয়া।
কেমনে রয়েছে, গ্রহমাঝে বসি,
চণ্ডীদাসে কহে ইহা।।
——————-
শ্রীদাম, সুদাম, সুবল – শ্রীকৃষ্ণের প্রিয় সখা। রায় – শ্রীকৃষ্ণ। দুই আখর – “রাধা” । আনেতে – অন্যলোকে। প্রেমময়ী – শ্রীরাধিকা। তিলেকৈ – তিলেকের নিমিত্ত।
গোষ্ঠ বিহার ।। ধানশী ।। (গবাক্ষ হইতে শ্রীরাধিকার আক্ষেপোক্তি।)
কি আর বলিব মায়।
কিছু দয়া নাই, তাহার হৃদয়ে,
একথা বলিব কায়।।
মায়ের পরাণ, এমন কঠিন,
এহেন নবীন তনু।
অতি খরতর, বিষম উত্তাপ,
প্রখর গগন ভানু।।
বিপিনে বেকত, ফণি কত শত,
কুশের অঙ্কুর তায়।
ও রাঙা চরণে, ছেদিয়া ভেদিবে,
মোর মনে ইহা ভায়।
ননীর অধিক, শরীর কোমল,
বিষম রবির তাপে।
কি জানি অঙ্গ গলিয়া পড়য়ে,
ভয়ে সদা তনু কাঁপে।।
কেমন যশোদা, নন্দঘোষ পিতা,
এ হেন সম্পদ ছাড়ি।
কেমন হৃদয়, ধরিয়া রয়েছে,
এই মনে আমি ডরি।।
ছারেখারে যাঙ, এ সব সম্পদ,
আনলে পুড়িয়া যাক।
হেন নবীনে, বনে পাঠাইয়া,
পায় কত সুখ পাক।।
চণ্ডীদাস বলে, শুন বিনোদিনি,
সকল সপথ মানি।
যাহার কারণে, বনেতে গমন,
আমি সে কারণ জানি।।
——————-
যাঙ – যাক।
গোষ্ঠ বিহার ।। শ্রীরাগ ।।
ঘন শ্যাম শরীর কেলিরস,
যমুনাক তীর বিহার বনি।
শ্রীদাম সুদাম, ভায়া বলরাম,
সঙ্গে বসুদাম রঙ্গে কিঙ্কিনী।।
ঘন চন্দন ভাল, কাণে ফুল ডাল,
অঙ্গে গিরি লাল, কিয়ে চলনি।
লুফিছে পাঁচনি, বাজিছে কিঙ্কিণী,
পদ নূপুর ঝুনুরুনু শুনি।।
কত যন্ত্র সুতান, কলারস গান,
বাজায়ত মান, করি সুমেলে।
যব বেনু পূরে, মৃগ পাখি ঝুরে,
পুলকে তরু পল্লব পুষ্পফলে।।
কেহ রূপ চাহে, কেহ গুণ গায়ে,
কেহ প্রেমক আনন্দে বোল কহে।
চণ্ডীদাস, মনে অভিলাষ
স্বরূপ অন্তরে জাগি রহে।।
——————-
কিঙ্কিনী – এক সখা। ভাল – গিরি মাটি। কিঙ্কিণী – ঘুঙুর। পূরে – নিনাদ করে।
০৫. রাই রাখাল
রাই রাখাল ।। ধানশী ।।
বন্ধু যদি গেল বনে শুন ওগো সখি।
চূড়া বেন্ধে যাব চল যেথা কমল-আঁখি।।
বিপিনে ভেটিব যেয়া শ্যাম জলধরে।
রাখালের বেশে যাব হরিষ অন্তরে।।
চূড়াটি বান্ধহ শিরে যত সখাগণ।
পাত ধরা পর সবে আনন্দিত মন।।
চণ্ডীদাস বলে শুন রাধা বিনোদিনি।
নয়ানে দেখিব সেই শ্যাম গুণমণি।।
——————-
কমল-আঁখি – শ্রীকৃষ্ণ। যেয়া – যাইয়া।
রাই রাখাল ।। সুহই ।।
কেহ কও দাম, শ্রীদাম সুদাম,
সুবলাদি যত সখা।
চল যাব বনে, নটবর সনে,
কাননে করিবে দেখা।।
পর পীত ধড়া, মাথে বান্ধ চূড়া,
বেণু লও কেহ করে।
হারে রে রে বোন, কর উচ্চ রোল,
যাইব যমুনা তীরে।।
পর ফুল মালা, সাজাহ অবলা,
সবারে যাইতে হবে।
দাম বসুদাম, সাজ বলরাম,
যাইতে হবে সবে।।
যোগমায়া তখন, কহিছে বচন,
রাখাল সাজহ রাই।
চণ্ডীদাসে ভণে, দেখিগে নয়নে,
আমি তব সঙ্গে যাই।।
——————-
রাই রাখাল ।। ধানশী ।।
যোগমায়া পৌর্ণমাসী সাক্ষাতে আসিয়া।
লইল হরের শিঙ্গা আপনি মাগিয়া।।
সাজল রাখাল বেশ রাধা বিনোদিনী।
ললিতারে বলরাম কানাই আপনি।।
বলরামের হেলে শিঙ্গা বলে রাম কানু।
মুরলী নহিলে কে ফিরাইবে ধেনু।।
চণ্ডীদাসে বলে যদি রাই বনমালী।
সলিল আনিয়া পত্রে করহ মুরলী।।
————–
পৌর্ণমাসী – বৃন্দাবনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী।
রাই রাখাল ।। বরাড়ী ।।
আনন্দিত হৈয়া সবে পোরে শিঙ্গা বেনু।
পাতাল হইতে উঠে নব লক্ষ ধেনু।।
চৌদিকে ধেনুর পাল হাম্বা হাম্বা করে।
তা দেখিয়া আনন্দিত সবার অন্তরে।।
ইন্দ্র আইল ঐরাবতে দেখয়ে নয়নে।
হংস বাহনে ব্রহ্মা আনন্দিত মনে।।
বৃষভ বাহনে শিব বলে ভালি ভালি।
মুখ বাদ্য করে নাচে দিয়া করতালি।।
চণ্ডীদাসের মনে আন নাহি ভায়।
দেখিয়া সবার রূপ নয়ান জুড়ায়।।
————–
পোরে – নিদান করে।
রাই রাখাল ।। বিভাষ ।।
গায়ে রাঙা মাটী, কটিতটে ধটি,
মাথায় শোভিত চূড়া।
চরণে নূপুর, বাজে সবাকার,
গলে গুঞ্জমালা বেড়া।।
সবাকার কুচ, হইয়াছে উচ,
এ বড় বিষম জ্বালা।
কলমের ফুল, গাঁথি সত দল,
সবাই গাঁথিল মালা।।
ঠারে ঠারে চুড়া, গলে দিল মালা,
নাসিয়ে পড়েছে বুকে।
ফুলের চাপানে, কুচ ঢাকা গেল,
চলিল পরম সুখে।।
কেহ পীত ধটি, কেহ লয়ে লাঠি,
গর্জ্জন শব্দে ধায়।
চণ্ডীদাসে ভণে, গহন কাননে,
শ্যাম ভেটিবারে যায়।।
————–
কুচ – স্তন। উচ – উচ্চ। নাসিয়ে পড়েছে বুকে – বুকে হেলিয়া পড়িয়াছে। অদ্যপি কৃষকেরা নিম্ন জমীকে নাসা জমী বলিয়া থাকে।
রাই রাখাল ।। বিভাষ ।।
যমুনার তীরে সবে যায় নানা রঙ্গে।
সাঙলী ধবলী বলী আনন্দিত অঙ্গে।।
আসিয়া নিভৃত কুঞ্জে সবে দাঁড়াইল।
রাখাল দেখিয়া শ্যাম চমকি উঠিল।।
কোন্ গ্রামে বসতিরে কোন্ গ্রামে ঘর।
আমার কুঞ্জেতে কেন হরিষ অন্তর।।
কাহার নন্দন তোরা সত্য করি বল।
মুখে হেসে বাক্য কহে অন্তরে বিভোল।।
রাধা অঙ্গের গন্ধে কৃষ্ণের নাসিকা মাতায়।
আপাদ মস্তক কৃষ্ণ ঘন ঘন চায়।।
ললিতা হাসিয়া বলে শুন শ্যাম ধন।
রাধারে না চেন তুমি রসিক কেমন।।
চণ্ডীদাস বলে শুন রাধা বিনোদিনি।
হের গো শ্যামের রূপ জুড়াবে পরাণি।।
————–
সাঙলী ধবলী বলী – গাভীগণের নাম।