মৃত্যুর নেপথ্য হতে আরবার এলে তুমি ফিরে
মৃত্যুর নেপথ্য হতে আরবার এলে তুমি ফিরে
নূতন বধূর সাজে হৃদয়ের বিবাহমন্দিরে
নিঃশব্দ চরণপাতে। ক্লান্ত জীবনের যত গ্লানি
ঘুচেছে মরণস্নানে। অপরূপ নব রূপখানি
লভিয়াছ এ বিশ্বের লক্ষ্মীর অক্ষয় কৃপা হতে।
স্মিতস্নিগ্ধমুগ্ধমুখে এ চিত্তের নিভৃত আলোতে
নির্বাক দাঁড়ালে আসি। মরণের সিংহদ্বার দিয়া
সংসার হইতে তুমি অন্তরে পশিলে আসি, প্রিয়া।
আজি বাজে নাই বাদ্য, ঘটে নাই জনতা-উৎসব,
জ্বলে নাই দীপমালা আজিকার আনন্দগৌরব
প্রশান্ত গভীর স্তব্ধ বাক্যহারা অশ্রুনিমগন,
আজিকার এই বার্তা জানে নি, শোনে নি কোনো জন।
আমার অন্তর শুধু জ্বেলেছে প্রদীপ একখানি–
আমার সংগীত শুধু একা গাঁথে মিলনের বাণী।
শান্তিনিকেতন, ৮ পৌষ, ১৩০৯
যত দিন কাছে ছিলে বলো কী উপায়ে
যত দিন কাছে ছিলে বলো কী উপায়ে
আপনারে রেখেছিলে এমন লুকায়ে?
ছিলে তুমি আপনার কর্মের পশ্চাতে
অন্তর্যামী বিধাতার চোখের সাক্ষাতে।
প্রতি দণ্ড-মুহূর্তের অন্তরাল দিয়া
নি:শব্দে চলিয়া গেছ নম্র-নত-হিয়া।
আপন সংসারখানি করিয়া প্রকাশ
আপনি ধরিয়াছিলে কী অঞ্জাত বাস!
আজি যবে চলি গেলে খুলিয়া দুয়ার
পরিপূর্ণ রূপখানি দেখালে তোমার।
জীবনের সব দিন সব খণ্ড কাজ
ছিন্ন হয়ে পদতলে পড়ি গেল আজ।
তব দৃষ্টিখানি আজি বহে চিরদিন
চির-জনমের দেখা পলকবিহীন।
যে ভাবে রমণীরূপে আপন মাধুরী
যে ভাবে রমণীরূপে আপন মাধুরী
আপনি বিশ্বের নাথ করিছেন চুরি
যে ভাবে সুন্দর তিনি সর্ব চরাচরে,
যে ভাবে আনন্দ তাঁর প্রেমে খেলা করে,
যে ভাবে লতার ফুল, নদীতে লহরী,
যে ভাবে বিরাজে লক্ষ্মী বিশ্বের ঈশ্বরী,
যে ভাবে নবীন মেঘ বৃষ্টি করে দান,
তটিনী ধরারে স্তন্য করাইছে পান,
যে ভাবে পরম-এক আনন্দে উৎসুক
আপনারে দুই করি লভিছেন সুখ,
দুইয়ের মিলনাঘাতে বিচিত্র বেদনা
নিত্য বর্ণ গন্ধ গীত করিছে রচনা,
হে রমণী, ক্ষণকাল আসি মোর পাশে
চিত্ত ভরি দিলে সেই রহস্য আভাসে।
শান্তিনিকেতন, ১ মাঘ, ১৩০৯
সংসার সাজায়ে তুমি আছিলে রমণী
সংসার সাজায়ে তুমি আছিলে রমণী,
আমার জীবন আজি সাজাও তেমনি
নির্মল সুন্দর করে। ফেলি দাও বাছি
যেথা আছে যত ক্ষুদ্র তৃণকুটাগাছি–
অনেক আলস্যক্লান্ত দিনরজনীর
উপেক্ষিত ছিন্নক্ষণ্ড যত। আনো নীর,
সকল কলঙ্ক আজি করো গো মার্জনা,
বাহিরে ফেলিয়া দাও যত আবর্জনা।
যেথা মোর পূজাগৃহ নিভৃত মন্দিরে
সেথায় নীরবে এসো দ্বার খুলি ধীরে-
মঙ্গলকনকঘটে পুণ্যতীর্থজল
সযত্নে ভরিয়া রাখো, পূজাশতদল
স্বহস্তে তুলিয়া আনো। সেথা দুইজনে
দেবতার সম্মুখেতে বসি একাসনে।
৭ পৌষ, ১৩০৯
সে যখন বেঁচে ছিল গো
সে যখন বেঁচে ছিল গো , তখন
যা দিয়েছে বারবার
তার প্রতিদান দিব যে এখন
সে সময় নাহি আর ।
রজনী তাহার হয়েছে প্রভাত ,
তুমি তারে আজি লয়েছ হে নাথ —
তোমারি চরণে দিলাম সঁপিয়া
কৃতজ্ঞ উপহার ।
তার কাছে যত করেছিনু দোষ ,
যত ঘটেছিল ত্রুটি ,
তোমা – কাছে তার মাগি লব ক্ষমা
চরণের তলে লুটি ।
তারে যাহা – কিছু দেওয়া হয় নাই ,
তারে যাহা – কিছু সঁপিবারে চাই ,
তোমারি পূজার থালায় ধরিনু
আজি সে প্রেমের হার ।
স্বল্প-আয়ু এ জীবনে যে-কয়টি আনন্দিত দিন
স্বল্প-আয়ু এ জীবনে যে-কয়টি আনন্দিত দিন
কম্পিত-পুলকভরে, সংগীতের-বেদনা-বিলীন,
লাভ করেছিলে, লক্ষ্মী, সে কি তুমি নষ্ট করি যাবে?
সে আজি কোথায় তুমি যত্ন করি রাখিছ কী ভাবে
তাই আমি খুঁজিতেছি। সূর্যাস্তের স্বর্ণমেঘস্তরে
চেয়ে দেখি একদৃষ্টে — সেথা কোন্ করুণ অক্ষরে
লিখিয়াছ সে জন্মের সায়াহ্নের হারানো কাহিনী!
আজি এই দ্বিপ্রহরে পল্লবের মর্মররাগিণী
তোমার সে কবেকার দীর্ঘশ্বাস করিছে প্রচার!
আতপ্ত শীতের রৌদ্রে নিজহস্তে করিছ বিস্তার
কত শীতমধ্যাহ্নের সুনিবিড় সুখের স্তব্ধতা!
আপনার পানে চেয়ে বসে বসে ভাবি এই কথা–
কত তব রাত্রিদিন কত সাধ মোরে ঘিরে আছে,
তাদের ক্রন্দন শুনি ফিরে ফিরে ফিরিতেছ কাছে।
শন্তিনিকেতন, ৩ পৌষ, ১৩০৯
হে লক্ষ্মী, তোমার আজি নাই অন্তঃপুর
হে লক্ষ্মী, তোমার আজি নাই অন্তঃপুর
সরস্বতীরূপ আজি ধরেছ মধুর,
দাঁড়ায়েছ সংগীতের শতদলদলে।
মানসসরসী আজি তব পদতলে
নিখিলের প্রতিবিম্বে রঞ্জিছে তোমায়।
চিত্তের সৌন্দর্য তব বাধা নাহি পায়–
সে আজি বিশ্বের মাঝে মিশিছে পুলকে
সকল আনন্দে আর সকল আলোকে
সকল মঙ্গল-সাথে। তোমার কঙ্কণ
কোমল কল্যাণপ্রভা করেছে অর্পণ
সকল সতীর করে। স্নেহাতুর হিয়া
নিখিল নারীর চিত্তে গিয়েছে লাগিয়া।
সেই বিশ্বমূর্তি তব আমারি অন্তরে
লক্ষ্মী-সরস্বতী-রূপে পূর্ণরূপ ধরে।