দেখিলাম খানকয়েক পুরাতন চিঠি
দেখিলাম খানকয়েক পুরাতন চিঠি–
স্নেহমুগ্ধ জীবনের চিহ্ন দু-চারিটি
স্মৃতির খেলনা-ক’টি বহু যত্নভরে
গোপনে সঞ্চয় করি রেখেছিলে ঘরে।
যে প্রবল কালস্রোতে প্রলয়ের ধারা
ভাসাইয়া যায় কত রবিচন্দ্রতারা,
তারি কাছ হতে তুমি বহু ভয়ে ভয়ে
এই ক’টি তুচ্ছ বস্তু চুরি করে লয়ে
লুকায়ে রাখিয়াছিলে, বলেছিলে মনে,
“অধিকার নাই কারো আমার এ ধনে’।
আশ্রয় আজিকে তারা পাবে কার কাছে?
জগতের কারো নয়, তবু তারা আছে।
তাদের যেমন তব রেখেছিল স্নেহ,
তোমারে তেমনি আজ রাখে নি কি কেহ?
বোলপুর, ২ পৌষ, ১৩০৯
পাগল বসন্তদিন কতবার অতিথির বেশে
পাগল বসন্তদিন কতবার অতিথির বেশে
তোমার আমার দ্বারে বীণা হাতে এসেছিল হেসে
লয়ে তার কত গীত, কত মন্ত্র মন ভুলাবার,
জাদু করিবার কত পুষ্পপত্র আয়োজন-ভার।
কুহুতানে হেঁকে গেছে, খোলো ওগো, খোলো দ্বার খোলো।
কাজকর্ম ভোলো আজি, ভোলো বিশ্ব, আপনারে ভোলো।
এসে এসে কত দিন চলে গেছে দ্বারে দিয়ে নাড়া-
আমি ছিনু কোন্ কাজে, তুমি তারে দাও নাই সাড়া।
আজ তুমি চলে গেছ, সে এল দক্ষিণবায়ু বাহি-
আজ তারে ক্ষণকাল ভুলে থাকি হেন সাধ্য নাহি।
আনিছে সে দৃষ্টি তব, তোমার প্রকাশহীন বাণী,
মর্মরি তুলিছে কুঞ্জে তোমার আকুল চিত্তখানি।
মিলনের দিনে যারে কতবার দিয়েছিনু ফাঁকি
তোমার বিচ্ছেদ তারে শূন্যঘরে আনে ডাকি ডাকি।
শান্তিনিকেতন, ২৫ পৌষ, ১৩০৯
প্রেম এসেছিল , চলে গেল সে যে খুলি দ্বার
প্রেম এসেছিল , চলে গেল সে যে খুলি দ্বার —
আর কভু আসিবে না ।
বাকি আছে শুধু আরেক অতিথি আসিবার ,
তারি সাথে শেষ চেনা ।
সে আসি প্রদীপ নিবাইয়া দিবে এক দিন ,
তুলি লবে মোরে রথে —
নিয়ে যাবে মোরে গৃহ হতে কোন্ গৃহহীন
গ্রহতারকার পথে ।
ততকাল আমি একা বসি রব খুলি দ্বার ,
কাজ করি লব শেষ ।
দিন হবে যবে আরেক অতিথি আসিবার
পাবে না সে বাধালেশ ।
পূজা – আয়োজন সব সারা হবে একদিন ,
প্রস্তুত হয়ে রব —
নীরবে বাড়ায়ে বাহু – দুটি সেই গৃহহীন
অতিথিরে বরি লব ।
যে জন আজিকে ছেড়ে চলে গেল খুলি দ্বার
সেই বলে গেল ডাকি ,
‘ মোছো আঁখিজল , আরেক অতিথি আসিবার
এখনো রয়েছে বাকি । ‘
সেই বলে গেল , ‘ গাঁথা সেরে নিয়ো একদিন
জীবনের কাঁটা বাছি ,
নবগৃহ – মাঝে বহি এনো , তুমি গৃহহীন ,
পূর্ণ মালিকাগাছি । ‘
বজ্র যথা বর্ষণেরে আনে অগ্রসরি
বজ্র যথা বর্ষণেরে আনে অগ্রসরি
কে জানিত তব শোক সেইমতো করি
আনি দিবে অকস্মাৎ জীবনে আমার
বাধাহীন মিলনের নিবিড় সঞ্চার!
মোর অশ্রুবিন্দুগুলি কুড়ায়ে আদরে
গাঁথিয়া সীমন্তে পরি ব্যর্থশোক-‘পরে
নীরবে হানিছ তব কৌতুকের হাসি।
ক্রমে সবা হতে যত দূরে গেলে ভাসি
তত মোর কাছে এলে। জানি না কী করে
সবারে বঞ্চিয়া তব সব দিলে মোরে।
মৃত্যু-মাঝে আপনারে করিয়া হরণ
আমার জীবনে তুমি ধরেছ জীবন,
আমার নয়নে তুমি পেতেছ আলোক–
এই কথা মনে জানি নাই মোর শোক।
শন্তিনিকেতন, ৬ পৌষ, ১৩০৯
বহুরে যা এক করে, বিচিত্রেরে করে যা সরস
বহুরে যা এক করে, বিচিত্রেরে করে যা সরস,
প্রভূতেরে করি আনে নিজ ক্ষুদ্র তর্জনীর বশ,
বিবিধপ্রয়াসক্ষুব্ধ দিবসেরে লয়ে আসে ধীরে
সুপ্তিসুনিবিড় শান্ত স্বর্ণময় সন্ধ্যার তিমিরে
ধ্রুবতারাদীপদীপ্ত সুতৃপ্ত নিভৃত অবসানে,
বহুবাক্যব্যাকুলতা ডুবায় যা একখানি গানে
বেদনার সুধারসে-সে প্রেম হতে মোরে, প্রিয়া,
রেখো না বঞ্চিত করি; প্রতিদিন থাকিয়ো জাগিয়া;
আমার দিনান্ত-মাঝে কঙ্কণের কনককিরণ
নিদ্রার আঁধারপটে আঁকি দিবে সোনার স্বপন;
তোমার চরণপাত মোর স্তব্ধ সায়াহ্ন-আকাশে
নিঃশব্দে পড়িবে ধরা আরক্তিম অলক্ত-আভাসে;
এ জীবন নিয়ে যাবে অনিমেষ নয়নের টানে
তোমার আপন কক্ষে পরিপূর্ণ মরণের পানে।
শান্তিনিকেতন, ১৬ পৌষ, ১৩০৯
ভালো তুমি বেসেছিলে এই শ্যাম ধরা
ভালো তুমি বেসেছিলে এই শ্যাম ধরা,
তোমার হাসিটি ছিল বড়ো সুখে ভরা
মিলি নিখিলের স্রোতে
জেনেছিলে খুশি হতে,
হৃদয়টি ছিল তাই হৃদিপ্রাণহরা।
তোমার আপন ছিল এই শ্যাম ধরা।
আজি এ উদাস মাঠে আকাশ বাহিয়া
তোমার নয়ন যেন ফিরিছে চাহিয়া।
তোমার যে হাসিটুক,
সে চেয়ে-দেখার সুখ
সবারে পরশি চলে বিদায় গাহিয়া
এই তালবন গ্রাম প্রান্তর বাহিয়া।
তোমার সে ভালো-লাগা মোর চোখে আঁকি
আমার নয়নে তব দৃষ্টি গেছ রাখি।
আজি আমি একা-একা
দেখি দু-জনের দেখা–
তুমি করিতেছ ভোগ মোর মনে থাকি
আমার তারায় তব মুগ্ধ দৃষ্টি আঁকি।
এই-যে শীতের আলো শিহরিছে বনে,
শিরীষের পাতাগুলি ঝরিছে পবনে–
তোমার আমার মন
খেলিতেছে সারাক্ষণ
এই ছায়া-অলোকের আকুল কম্পনে
এই শীতমধ্যাহ্নের মর্মরিত বনে।
আমার জীবন তুমি বাঁচো, ওগো বাঁচো।
তোমার কামনা মোর চিত্ত দিয়ে যাচো–
যেন আমি বুঝি মনে
অতিশয় সংগোপনে
তুমি আজি মোর মাঝে আমি হয়ে আছ।
আমারি জীবনে তুমি বাঁচো, ওগো বাঁচো!
১ পৌষ, ১৩০৯
মিলন সম্পূর্ণ আজি হল তোমা-সনে
মিলন সম্পূর্ণ আজি হল তোমা-সনে
এ বিচ্ছেদবেদনার নিবিড় বন্ধনে।
এসেছ একান্ত কাছে, ছাড়ি দেশকাল
হৃদয়ে মিশায়ে গেছ ভাঙি অন্তরাল।
তোমারি নয়নে আজ হেরিতেছি সব,
তোমারি বেদনা বিশ্বে করি অনুভব।
তোমার অদৃশ্য হাত হেরি মোর কাজে,
তোমারি কামনা মোর কামনার মাঝে।
দুজনের কথা দোঁহে শেষ করি লব
সে রাত্রে ঘটে নি হেন অবকাশ তব।
বাণীহীন বিদায়ের সেই বেদনায়
চারি দিকে চাহিয়াছি ব্যর্থ বাসনায়।
আজি এ হৃদয়ে সর্ব-ভাবনার নীচে
তোমার আমার বাণী একত্রে মিলিছে।