ঘরে যবে ছিলে মোরে ডেকেছিলে ঘরে
ঘরে যবে ছিলে মোরে ডেকেছিলে ঘরে
তোমার করুণাপূর্ণ সুধাকণ্ঠস্বরে।
আজ তুমি বিশ্ব-মাঝে চলে গেলে যবে
বিশ্ব-মাঝে ডাকো মোরে সে করুণ রবে।
খুলি দিয়া গেলে তুমি যে গৃহদুয়ার
সে দ্বার রুধিতে কেহ কহিবে না আর।
বাহিরের রাজপথ দেখালে আমায়,
মনে রয়ে গেল তব নি:শব্দ বিদায়।
আজি বিশ্বদেবতার চরণ-আশ্রয়ে
গৃহলক্ষ্মী দেখা দাও বিশ্বলক্ষ্মী হয়ে।
নিখিল নক্ষত্র হতে কিরণের রেখা
সীমন্তে আঁকিয়া দিক্ সিন্দূরের লেখা।
একান্তে বসিয়া আজি করিতেছি ধ্যান
সবার কল্যাণে হোক তোমার কল্যাণ।
জাগো রে জাগো রে চিত্ত জাগো রে
জাগো রে জাগো রে চিত্ত জাগো রে,
জোয়ার এসেছে অশ্রু-সাগরে।
কূল তার নাহি জানে,
বাঁধ আর নাহি মানে,
তাহারি গর্জনগানে জাগো রে।
তরী তোর নাচে অশ্রু-সাগরে।
আজি এ ঊষার পুণ্য লগনে
উঠেছে নবীন সূর্য গগনে।
দিশাহারা বাতাসেই
বাজে মহামন্ত্র সেই।
অজানা যাত্রার এই লগনে
দিক হতে দিগন্তের গগনে।
জানি না উদার শুভ্র আকাশে
কী জাগে অরুণদীপ্ত আভাসে।
জানি না কিসের লাগি
অতল উঠেছে জাগি,
বাহু তোলে কারে মাগি আকাশে–
পাগল কাহার দীপ্ত আভাসে।
শূন্য মরুময় সিন্ধু-বেলাতে
বন্যা মাতিয়াছে রুদ্র খেলাতে।
হেথায় জাগ্রত দিন
বিহঙ্গের গীতহীন,
শূন্য এ বালুকালীন বেলাতে,
এই ফেন তরঙ্গের খেলাতে।
দুলে রে দুলে রে অশ্রু দুলে রে
আঘাত করিয়া বক্ষ-কূলে রে।
সম্মুখে অনন্ত লোক,
যেতে হবে যেথা হোক–
অকূল আকুল শোক দুলে রে,
ধায় কোন্ দূর স্বর্ণ-কূলে রে।
আঁকড়ি থেকো না অন্ধ ধরণী,
খুলে দে খুলে দে বন্ধ তরণী।
অশান্ত পালের ‘পরে
বায়ু লাগে হাহা ক’রে
দূরে তোর থাক্ পড়ে ধরণী।
আর না রাখিস রুদ্ধ তরণী।
১১ পৌষ, ১৩০৯
জ্বালো ওগো, জ্বালো ওগো, সন্ধ্যাদীপ জ্বালো
জ্বালো ওগো, জ্বালো ওগো, সন্ধ্যাদীপ জ্বালো
হৃদয়ের এক প্রান্তে ওইটুকু আলো
স্বহস্তে জাগায়ে রাখো। তাহারি পশ্চাতে
আপনি বসিয়া থাকো আসন্ন এ রাতে
যতনে বাঁধিয়া বেণী সাজি রক্তাম্বরে
আমার বিক্ষিপ্ত চিত্ত কাড়িবার তরে
জীবনের জাল হতে। বুঝিয়াছি আজি
বহুকর্মকীর্তিখ্যাতি আয়োজনরাজি
শুষ্ক বোঝা হয়ে থাকে, সব হয় মিছে
যদি সেই স্তূপাকার উদ্যোগের পিছে
না থাকে একটি হাসি; নানা দিক হতে
নানা দর্প নানা চেষ্টা সন্ধ্যার আলোতে
এক গৃহে ফিরে যদি নাহি রাখে স্থির
একটি প্রেমের পায়ে শ্রান্ত নতশির।
১৪ পৌষ, ১৩০৯
তখন নিশীথরাত্রি; গেলে ঘর হতে
তখন নিশীথরাত্রি; গেলে ঘর হতে
যে পথে চল নি কভু সে অজানা পথে।
যাবার বেলায় কোনো বলিলে না কথা,
লইয়া গেলে না কারো বিদায়বারতা।
সুপ্তিমগ্ন বিশ্ব-মাঝে বাহিরিলে একা—
অন্ধকারে খুঁজিলাম, না পেলাম দেখা।
মঙ্গলমুরতি সেই চিরপরিচিত
অগণ্য তারার মাঝে কোথায় অন্তর্হিত!
গেলে যদি একেবারে গেলে রিক্ত হাতে?
এ ঘর হইতে কিছু নিলে না কি সাথে?
বিশ বৎসরের তব সুখদুঃখভার
ফেলে রেখে দিয়ে গেলে কোলেতে আমার!
প্রতিদিবসের প্রেমে কতদিন ধরে
যে ঘর বাঁধিলে তুমি সুমঙ্গল-করে
পরিপূর্ণ করি তারে স্নেহের সঞ্চয়ে,
আজ তুমি চলে গেলে কিছু নাহি লয়ে?
তোমার সংসার-মাঝে, হায়, তোমা-হীন
এখনো আসিবে কত সুদিন-দুর্দিন—
তখন এ শূন্য ঘরে চিরাভ্যাস-টানে
তোমারে খুঁজিতে এসে চাব কার পানে?
আজ শুধু এক প্রশ্ন মোর মনে জাগে—
হে কল্যাণী, গেলে যদি, গেলে মোর আগে,
মোর লাগি কোথাও কি দুটি স্নিগ্ধ করে
রাখিবে পাতিয়া শয্যা চিরসন্ধ্যা-তরে?
তুমি মোর জীবনের মাঝে
তুমি মোর জীবনের মাঝে
মিশায়েছ মৃত্যুর মাধুরী।
চিরবিদায়ের আভা দিয়া
রাঙায়ে গিয়েছ মোর হিয়া,
এঁকে গেছে সব ভাবনায়
সূর্যাস্তের বরনচাতুরী।
জীবনের দিক্চক্রসীমা
লভিয়াছে অপূর্ব মহিমা,
অশ্রুধৌত হৃদয়-আকাশে
দেখা যায় দূর স্বর্গপুরী।
তুমি মোর জীবনের মাঝে
মিশায়েছ মৃত্যুর মাধুরী।
তুমি, ওগো কল্যাণরূপিণী,
মরণেরে করেছ মঙ্গল।
জীবনের পরপার হতে
প্রতি ক্ষণে মর্ত্যের আলোতে
পাঠাইছ তব চিত্তখানি
মৌনপ্রেমে সজলকোমল।
মৃত্যুর নিভৃত স্নিগ্ধ ঘরে
বসে আছ বাতায়ন-‘পরে–
জ্বালায়ে রেখেছ দীপখানি
চিরন্তন আশায় উজ্জ্বল।
তুমি ওগো কল্যাণরূপিণী,
মরণেরে করেছ মঙ্গল।
তুমি মোর জীবন মরণ
বাঁধিয়াছ দুটি বাহু দিয়া।
প্রাণ তব করি অনাবৃত
মৃত্যু-মাঝে মিলালে অমৃত,
মরণেরে জীবনের প্রিয়
নিজ হাতে করিয়াছ প্রিয়া।
খুলিয়া দিয়াছ দ্বারখানি,
যবনিকা লইয়াছ টানি,
জন্মমরণের মাঝখানে
নিস্তব্ধ রয়েছ দাঁড়াইয়া।
তুমি মোর জীবন মরণ
বাঁধিয়াছ দুটি বাহু দিয়া।
বোলপুর, শান্তিনিকেতন, ২৯ অগ্রহায়ণ, ১৩০৯
তোমার সকল কথা বল নাই, পার নি বলিতে
তোমার সকল কথা বল নাই, পার নি বলিতে,
আপনারে খর্ব করি রেখেছিলে তুমি, হে লজ্জিতে,
যতদিন ছিলে হেথা। হৃদয়ের গূঢ় আশাগুলি
যখন চাহিত তারা কাঁদিয়া উঠিতে কণ্ঠ তুলি
তর্জনী-ইঙ্গিতে তুমি গোপন করিতে সাবধান
ব্যাকুল সংকোচবশে, পাছে ভুলে পায় অপমান।
আপনার অধিকার নীরবে নির্মম নিজকরে
রেখেছিলে সংসারের সবার পশ্চাতে হেলাভরে।
লজ্জার অতীত আজি মৃত্যুতে হয়েছ মহীয়সী–
মোর হৃদিপদ্মদলে নিখিলের অগোচরে বসি
নতনেত্রে বলো তব জীবনের অসমাপ্ত কথা
ভাষাবাধাহীন বাক্যে। দেহমুক্ত তব বাহুলতা
জড়াইয়া দাও মর্মের মাঝারে একবার–
আমার অন্তরে রাখো তোমার অন্তিম অধিকার।
শান্তিনিকেতন, ৫ পৌষ, ১৩০৯