একদা এক বিষম ঘোর স্বরে
বজ্র আসি পড়িল মোর ঘরে ।
বেদনা এক তীক্ষ্মতম
পশিল গিয়ে হৃদয়ে মম ,
অগ্নিময় সর্পসম
কাটিল অন্তরে ।
বজ্র আসি পড়িল মোর ঘরে ।
পাষাণরাশি সহসা গেল টুটি ,
গৃহের মাঝে দিবস উঠে ফুটি ।
নীরব ধ্যান করিয়া চুর
কঠিন বাঁধ করিয়া দূর
সংসারের অশেষ সুর
ভিতরে এল ছুটি ।
পাষাণরাশি সহসা গেল টুটি ।
দেবতা-পানে চাহিনু একবার ,
আলোক আসি পড়েছে মুখে তাঁর ।
নূতন এক মহিমারাশি
ললাটে তাঁর উঠেছে ভাসি ,
জাগিছে এক প্রসাদহাসি
অধর-চারিধার ।
দেবতা-পানে চাহিনু একবার ।
শরমে দীপ মলিন একেবারে
লুকাতে চাহে চির-অন্ধকারে ।
শিকলে বাঁধা স্বপ্নমতো
ভিত্তি-আঁকা চিত্র যত
আলোক দেখি লজ্জাহত
পালাতে নাহি পারে ।
শরমে দীপ মলিন একেবারে ।
যে গান আমি নারিনু রচিবারে
সে গান আজি উঠিল চারি ধারে ।
আমার দীপ জ্বালিল রবি ,
প্রকৃতি আসি আঁকিল ছবি ,
গাঁথিল গান শতেক কবি
কতই ছন্দ-হারে ।
কী গান আজি উঠিল চারি ধারে ।
দেউলে মোর দুয়ার গেল খুলি —
ভিতরে আর বাহিরে কোলাকুলি ,
দেবের করপরশ লাগি
দেবতা মোর উঠিল জাগি ,
বন্দী নিশি গেল সে ভাগি
আঁধার পাখা তুলি ।
দেউলে মোর দুয়ার গেল খুলি ।
নদীপথে
গগন ঢাকা ঘন মেঘে ,
পবন বহে খর বেগে ।
অশনি ঝনঝন
ধ্বনিছে ঘন ঘন ,
নদীতে ঢেউ উঠে জেগে ।
পবন বহে খর বেগে ।
তীরেতে তরুরাজি দোলে
আকুল মর্মর-রোলে ।
চিকুর চিকিমিকে
চকিয়া দিকে দিকে
তিমির চিরি যায় চলে ।
তীরেতে তরুরাজি দোলে ।
ঝরিছে বাদলের ধারা
বিরাম-বিশ্রামহারা ।
বারেক থেমে আসে ,
দ্বিগুণ উচ্ছ্বাসে
আবার পাগলের পারা
ঝরিছে বাদলের ধারা ।
মেঘেতে পথরেখা লীন ,
প্রহর তাই গতিহীন ।
গগন-পানে চাই ,
জানিতে নাহি পাই
গেছে কি নাহি গেছে দিন ;
প্রহর তাই গতিহীন ।
তীরেতে বাঁধিয়াছি তরী ,
রয়েছি সারা দিন ধরি ।
এখনো পথ নাকি
অনেক আছে বাকি ,
আসিছে ঘোর বিভাবরী ।
তীরেতে বাঁধিয়াছি তরী ।
বসিয়া তরণীর কোণে
একেলা ভাবি মনে মনে —
মেঝেতে শেজ পাতি
সে আজি জাগে রাতি ,
নিদ্রা নাহি দুনয়নে ।
বসিয়া ভাবি মনে মনে ।
মেঘের ডাক শুনে কাঁপে ,
হৃদয় দুই হাতে চাপে ।
আকাশ-পানে চায় ,
ভরসা নাহি পায় ,
তরাসে সারা নিশি যাপে ,
মেঘের ডাক শুনে কাঁপে ।
কভু বা বায়ুবেগভরে
দুয়ার ঝনঝনি পড়ে ।
প্রদীপ নিবে আসে ,
ছায়াটি কাঁপে ত্রাসে ,
নয়নে আঁখিজল ঝরে ,
বক্ষ কাঁপে থরথরে ।
চকিত আঁখি দুটি তার
মনে আসিছে বার বার ।
বাহিরে মহা ঝড় ,
বজ্র কড়মড় ,
আকাশ করে হাহাকার ।
মনে পড়িছে আঁখি তার ।
গগন ঢাকা ঘন মেঘে ,
পবন বহে খর বেগে ।
অশনি ঝনঝন
ধ্বনিছে ঘন ঘন ,
নদীতে ঢেউ উঠে জেগে ।
পবন বহে আজি বেগে ।
নিদ্রিতা
রাজার ছেলে ফিরেছি দেশে দেশে
সাত সমুদ্র তেরো নদীর পার।
যেখানে যত মধুর মুখ আছে
বাকি তো কিছু রাখি নি দেখিবার।
কেহ বা ডেকে কয়েছে দুটো কথা,
কেহ বা চেয়ে করেছে আঁখি নত,
কাহারো হাসি ছুরির মতো কাটে
কাহারো হাসি আঁখিজলেরই মতো।
গরবে কেহ গিয়েছে নিজ ঘর,
কাঁদিয়া কেহ চেয়েছে ফিরে ফিরে।
কেহ বা কারে কহে নি কোনো কথা,
কেহ বা গান গেয়েছে ধীরে ধীরে।
এমনি করে ফিরেছি দেশে দেশে।
অনেক দূরে তেপান্তর-শেষে
ঘুমের দেশে ঘুমায় রাজবালা,
তাহারি গলে এসেছি দিয়ে মালা।
একদা রাতে নবীন যৌবনে
স্বপ্ন হতে উঠিনু চমকিয়া,
বাহিরে এসে দাঁড়ানু একবার
ধরার পানে দেখিনু নিরখিয়া।
শীর্ণ হয়ে এসেছে শুকতারা,
পূর্বতটে হতেছে নিশি ভোর।
আকাশ-কোণে বিকাশে জাগরণ,
ধরণীতলে ভাঙে নি ঘুমঘোর।
সমুখে পড়ে দীর্ঘ রাজপথ,
দু-ধারে তারি দাঁড়ায়ে তরুসার,
নয়ন মেলি সুদূর-পানে চেয়ে
আপন মনে ভাবিনু একবার—
আমারি মতো আজি এ নিশিশেষে
ধরার মাঝে নূতন কোন্ দেশে,
দুগ্ধফেনশয়ন করি আলা
স্বপ্ন দেখে ঘুমায়ে রাজবালা।
অশ্ব চড়ি তখনি বাহিরিনু,
কত যে দেশ-বিদেশ হনু পার।
একদা এক ধূসর সন্ধ্যায়
ঘুমের দেশে লভিনু পুরদ্বার।
সবাই সেথা অচল অচেতন,
কোথাও জেগে নাইকো জনপ্রাণী,
নদীর তীরে জলের কলতানে
ঘুমায়ে আছে বিপুল পুরীখানি।
ফেলিতে পদ সাহস নাহি মানি,
নিমেষে পাছে সকল দেশ জাগে।
প্রাসাদমাঝে পশিনু সাবধানে,
শঙ্কা মোর চলিল আগে আগে।
ঘুমায় রাজা, ঘুমায় রানীমাতা,
কুমার-সাথে ঘুমায় রাজভ্রাতা;
একটি ঘরে রত্নদীপ জ্বালা,
ঘুমায়ে সেথা রয়েছে রাজবালা।
কমলফুলবিমল শেজখানি,
নিলীন তাহে কোমল তনুলতা।
মুখের পানে চাহিনু অনিমেষে,
বাজিল বুকে সুখের মতো ব্যথা।
মেঘের মতো গুচ্ছ কেশরাশি
শিথান ঢাকি পড়েছে ভারে ভারে;
একটি বাহু বক্ষ-’পরে পড়ি,
একটি বাহু লুটায় এক ধারে।
আঁচলখানি পড়েছে খসি পাশে,
কাঁচলখানি পড়িবে বুঝি টুটি;
পত্রপুটে রয়েছে যেন ঢাকা
অনাঘ্রাত পূজার ফুল দুটি।
দেখিনু তারে, উপমা নাহি জানি—
ঘুমের দেশে স্বপন একখানি,
পালঙ্কেতে মগন রাজবালা
আপন ভরা-লাবণ্যে নিরালা।
ব্যাকুল বুকে চাপিনু দুই বাহু,
না মানে বাধা হৃদয়কম্পন।
ভূতলে বসি আনত করি শির
মুদিত আঁখি করিনু চুম্বন।
পাতার ফাঁকে আঁখির তারা দুটি,
তাহারি পানে চাহিনু একমনে,
দ্বারের ফাঁকে দেখিতে চাহি যেন
কী আছে কোথা নিভৃত নিকেতনে।
ভূর্জপাতে কাজলমসী দিয়া
লিখিয়া দিনু আপন নামধাম।
লিখিনু, “অয়ি নিদ্রানিমগনা,
আমার প্রাণ তোমারে সঁপিলাম।”
যতন করি কনক-সুতে গাঁথি
রতন-হারে বাঁধিয়া দিনু পাঁতি।
ঘুমের দেশে ঘুমায় রাজবালা,
তাহারি গলে পরায়ে দিনু মালা।