ঝুলন
আমি পরানের সাথে খেলিব আজিকে
মরণখেলা
নিশীথবেলা ।
সঘন বরষা , গগন আঁধার ,
হেরো বারিধারে কাঁদে চারি ধার ,
ভীষণ রঙ্গে ভবতরঙ্গে
ভাসাই ভেলা ;
বাহির হয়েছি স্বপ্ন-শয়ন
করিয়া হেলা
রাত্রিবেলা ।
ওগো , পবনে গগনে সাগরে আজিকে
কী কল্লোল ,
দে দোল্ দোল্ ।
পশ্চাৎ হতে হা হা ক ‘ রে হাসি
মত্ত ঝটিকা ঠেলা দেয় আসি ,
যেন এ লক্ষ যক্ষশিশুর
অট্টরোল ।
আকাশে পাতালে পাগলে মাতালে
হট্টগোল ।
দে দোল্ দোল্ ।
আজি জাগিয়া উঠিয়া পরান আমার
বসিয়া আছে
বুকের কাছে ।
থাকিয়া থাকিয়া উঠিছে কাঁপিয়া ,
ধরিছে আমার বক্ষ চাপিয়া ,
নিঠুর নিবিড় বন্ধনসুখে
হৃদয় নাচে ;
ত্রাসে উল্লাসে পরান আমার
ব্যাকুলিয়াছে
বুকের কাছে ।
হায় , এতকাল আমি রেখেছিনু তারে
যতনভরে
শয়ন ‘ -পরে ।
ব্যথা পাছে লাগে — দুখ পাছে জাগে
নিশিদিন তাই বহু অনুরাগে
বাসরশয়ন করেছি রচন
কুসুম-থরে ;
দুয়ার রুধিয়া রেখেছিনু তারে
গোপন ঘরে
যতনভরে ।
কত সোহাগ করেছি চুম্বন করি
নয়নপাতে
স্নেহের সাথে ।
শুনায়েছি তারে মাথা রাখি পাশে
কত প্রিয় নাম মৃদু মধুভাষে ,
গুঞ্জরতান করিয়াছি গান
জ্যোৎস্নারাতে ।
যা-কিছু মধুর দিয়েছিনু তার
দুখানি হাতে
স্নেহের সাথে ।
শেষে সুখের শয়নে শ্রান্ত পরান
আলস-রসে
আবেশবশে ।
পরশ করিলে জাগে না সে আর ,
কুসুমের হার লাগে গুরুভার ,
ঘুমে জাগরণে মিশি একাকার
নিশিদিবসে ।
বেদনাবিহীন অসাড় বিরাগ
মরমে পশে
আবেশবশে ।
ঢালি মধুরে মধুর বধূরে আমার
হারাই বুঝি ,
পাই নে খুঁজি ।
বাসরের দীপ নিবে নিবে আসে —
ব্যাকুল নয়নে হেরি চারি পাশে
শুধু রাশি রাশি শুষ্ক কুসুম
হয়েছে পুঁজি ।
অতল স্বপ্নসাগরে ডুবিয়া
মরি যে যুঝি
কাহারে খুঁজি ।
তাই ভেবেছি আজিকে খেলিতে হইবে
নূতন খেলা
রাত্রিবেলা ।
মরণদোলায় ধরি রশিগাছি
বসিব দুজনে বড়ো কাছাকাছি ,
ঝঞ্ঝা আসিয়া অট্ট হাসিয়া
মারিবে ঠেলা
আমাতে প্রাণেতে খেলিব দুজনে
ঝুলনখেলা
নিশীথবেলা ।
দে দোল্ দোল্ ।
দে দোল্ দোল্ ।
এ মহাসাগরে তুফান তোল্ ।
বধূরে আমার পেয়েছি আবার —
ভরেছে কোল ।
প্রিয়ারে আমার তুলেছে জাগায়ে
প্রলয়রোল ।
বক্ষ-শোণিতে উঠেছে আবার
কী হিল্লোল!
ভিতরে বাহিরে জেগেছে আমার
কী কল্লোল!
উড়ে কুন্তল , উড়ে অঞ্চল ,
উড়ে বনমালা বায়ুচঞ্চল ,
বাজে কঙ্কণ বাজে কিঙ্কিণী
মত্ত-বোল ।
দে দোল্ দোল্ ।
আয় রে ঝঞ্ঝা , পরান-বধূর
আবরণরাশি করিয়া দে দূর ,
করি লুণ্ঠন অবগুণ্ঠন-
বসন খোল্ ।
দে দোল্ দোল্ ।
প্রাণেতে আমাতে মুখোমুখি আজ
চিনি লব দোঁহে ছাড়ি ভয়-লাজ ,
বক্ষে বক্ষে পরশিব দোঁহে
ভাবে বিভোল ।
দে দোল্ দোল্ ।
স্বপ্ন টুটিয়া বাহিরেছে আজ
দুটো পাগল ।
দে দোল্ দোল্ ।
তোমরা ও আমরা
তোমরা হাসিয়া বহিয়া চলিয়া যাও
কুলুকুলুকল নদীর স্রোতের মতো।
আমরা তীরেতে দাঁড়ায়ে চাহিয়া থাকি,
মরমে গুমরি মরিছে কামনা কত।
আপনা-আপনি কানাকানি কর সুখে,
কৌতুকছটা উছসিছে চোখে মুখে,
কমলচরণ পড়িছে ধরণী-মাঝে,
কনকনূপুর রিনিকি ঝিনিকি বাঝে।
অঙ্গে অঙ্গ বাঁধিছে রঙ্গপাশে,
বাহুতে বাহুতে জড়িত ললিত লতা।
ইঙ্গিতরসে ধ্বনিয়া উঠিছে হাসি,
নয়নে নয়নে বহিছে গোপন কথা।
আঁখি নত করি একেলা গাঁথিছ ফুল,
মুকুর লইয়া যতনে বাঁধিছ চুল।
গোপন হৃদয়ে আপনি করিছ খেলা,
কী কথা ভাবিছ, কেমন কাটিছে বেলা।
চকিতে পলকে অলক উড়িয়া পড়ে,
ঈষৎ হেলিয়া আঁচল মেলিয়া যাও—
নিমেষ ফেলিতে আঁখি না মেলিতে,ত্বরা
নয়নের আড়ে না জানি কাহারে চাও।
যৌবনরাশি টুটিতে লুটিতে চায়,
বসনে শাসনে বাঁধিয়া রেখেছ তায়।
তবু শতবার শতধা হইয়া ফুটে,
চলিতে ফিরিতে ঝলকি চলকি উঠে।
আমরা মূর্খ কহিতে জানি নে কথা,
কী কথা বলিতে কী কথা বলিয়া ফেলি।
অসময়ে গিয়ে লয়ে আপনার মন,
পদতলে দিয়ে চেয়ে থাকি আঁখি মেলি।
তোমরা দেখিয়া চুপি চুপি কথা কও,
সখীতে সখীতে হাসিয়া অধীর হও,
বসন-আঁচল বুকেতে টানিয়া লয়ে
হেসে চলে যাও আশার অতীত হয়ে।
আমরা বৃহৎ অবোধ ঝড়ের মতো
আপন আবেগে ছুটিয়া চলিয়া আসি।
বিপুল আঁধারে অসীম আকাশ ছেয়ে
টুটিবারে চাহি আপন হৃদয়রাশি।
তোমরা বিজুলি হাসিতে হাসিতে চাও,
আঁধার ছেদিয়া মরম বিঁধিয়া দাও,
গগনের গায়ে আগুনের রেখা আঁকি
চকিতে চরণে চলে যাও দিয়ে ফাঁকি।
অযতনে বিধি গড়েছে মোদের দেহ,
নয়ন অধর দেয় নি ভাষায় ভরে।
মোহন মধুর মন্ত্র জানি নে মোরা,
আপনা প্রকাশ করিব কেমন করে?
তোমরা কোথায় আমরা কোথায় আছি,
কোনো সুলগনে হব না কি কাছাকাছি।
তোমরা হাসিয়া বহিয়া চলিয়া যাবে,
আমরা দাঁড়ায়ে রহিব এমনি ভাবে!
দরিদ্রা
দরিদ্রা বলিয়া তোরে বেশি ভালোবাসি
হে ধরিত্রী , স্নেহ তোর বেশি ভালো লাগে—
বেদনাকাতর মুখে সকরুণ হাসি ,
দেখে মোর মর্ম-মাঝে বড়ো ব্যথা জাগে ।
আপনার বক্ষ হতে রসরক্ত নিয়ে
প্রাণটুকু দিয়েছিস সন্তানের দেহে ,
অহর্নিশি মুখে তার আছিস তাকিয়ে ,
অমৃত নারিস দিতে প্রাণপণ স্নেহে ।
কত যুগ হতে তুই বর্ণগন্ধগীতে
সৃজন করিতেছিস আনন্দ-আবাস ,
আজো শেষ নাহি হল দিবসে নিশীথে —
স্বর্গ নাই , রচেছিস স্বর্গের আভাস ।
তাই তোর মুখখানি বিষাদকোমল ,
সকল সৌন্দর্যে তোর ভরা অশ্রুজল ।