স্বপ্ন শুনি ম্লেচ্ছমুখ রাঙা টকটকে ,
আগুন ছুটিতে চায় মুখে আর চোখে ।
হানিয়া দক্ষিণ মুষ্টি বাম করতলে
‘ ডেকে এনে পরিহাস ‘ রেগেমেগে বলে ।
ফরাসি পণ্ডিত ছিল , হাস্যোজ্জ্বলমুখে
কহিল নোয়ায়ে মাথা , হস্ত রাখি বুকে ,
‘ স্বপ্ন যাহা শুনিলাম রাজযোগ্য বটে ;
হেন স্বপ্ন সকলের অদৃষ্টে না ঘটে ।
কিন্তু তবু স্বপ্ন ওটা করি অনুমান
যদিও রাজার শিরে পেয়েছিল স্থান ।
অর্থ চাই , রাজকোষে আছে ভূরি ভূরি
রাজস্বপ্নে অর্থ নাই , যত মাথা খুঁড়ি ।
নাই অর্থ কিন্তু তবু কহি অকপট ,
শুনিতে কী মিষ্ট আহা , হিং টিং ছট্ । ‘
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান ,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে , শুনে পুণ্যবান ।
শুনিয়া সভাস্থ সবে করে ধিক্ ধিক্ —
কোথাকার গণ্ডমূর্খ পাষণ্ড নাস্তিক!
স্বপ্ন শুধু স্বপ্নমাত্র মস্তিষ্ক-বিকার ,
এ কথা কেমন করে করিব স্বীকার ।
জগৎ-বিখ্যাত মোরা ‘ ধর্মপ্রাণ ‘ জাতি
স্বপ্ন উড়াইয়া দিবে! — দুপুরে ডাকাতি!
হবুচন্দ্র রাজা কহে পাকালিয়া চোখ —
‘ গবুচন্দ্র , এদের উচিত শিক্ষা হোক ।
হেঁটোয় কণ্টক দাও , উপরে কণ্টক ,
ডালকুত্তাদের মাঝে করহ বণ্টন । ‘
সতেরো মিনিট কাল না হইতে শেষ ,
ম্লেচ্ছ পণ্ডিতের আর না মিলে উদ্দেশ ।
সভাস্থ সবাই ভাসে আনন্দাশ্রুনীরে ,
ধর্মরাজ্যে পুনর্বার শান্তি এল ফিরে ।
পণ্ডিতেরা মুখ চক্ষু করিয়া বিকট
পুনর্বার উচ্চারিল — ‘ হিং টিং ছট্ । ‘
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান ,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে , শুনে পুণ্যবান ।
অতঃপর গৌড় হতে এল হেন বেলা
যবন পণ্ডিতদের গুরুমারা চেলা ।
নগ্নশির , সজ্জা নাই , লজ্জা নাই ধড়ে —
কাছা-কোঁচা শতবার খসে খসে পড়ে ।
অস্তিত্ব আছে না আছে , ক্ষীণ খর্বদেহ ,
বাক্য যবে বাহিরায় না থাকে সন্দেহ ।
এতটুকু যন্ত্র হতে এত শব্দ হয়
দেখিয়া বিশ্বের লাগে বিষম বিস্ময় ।
না জানে অভিবাদন , না পুছে কুশল ,
পিতৃনাম শুধাইলে উদ্যত মুষল ।
সগর্বে জিজ্ঞাসা করে , ‘ কী লয়ে বিচার ,
শুনিলে বলিতে পারি কথা দুই-চার ,
ব্যাখ্যায় করিতে পারি উলট-পালট । ‘
সমস্বরে কহে সবে — ‘ হিং টিং ছট্ । ‘
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান ,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে , শুনে পুণ্যবান ।
স্বপ্নকথা শুনি মুখ গম্ভীর করিয়া
কহিল গৌড়ীয় সাধু প্রহর ধরিয়া ,
‘ নিতান্ত সরল অর্থ , অতি পরিষ্কার ,
বহু পুরাতন ভাব , নব আবিষ্কার ।
ত্র্যম্বকের ত্রিনয়ন ত্রিকাল ত্রিগুণ
শক্তিভেদে ব্যক্তিভেদ দ্বিগুণ বিগুণ ।
বিবর্তন আবর্তন সম্বর্তন আদি
জীবশক্তি শিবশক্তি করে বিসম্বদী ।
আকর্ষণ বিকর্ষণ পুরুষ প্রকৃতি
আণব চৌম্বকবলে আকৃতি বিকৃতি ।
কুশাগ্রে প্রবহমান জীবাত্মবিদ্যুৎ
ধারণা পরমা শক্তি সেথায় উদ্ভূত ।
ত্রয়ী শক্তি ত্রিস্বরূপে প্রপজ্ঞে প্রকট —
সংক্ষেপে বলিতে গেলে , হিং টিং ছট্ । ‘
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান ,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে , শুনে পুণ্যবান ।
‘ সাধু সাধু ‘ রবে কাঁপে চারিধার ,
সবে বলে — পরিষ্কার অতি পরিষ্কার ।
দুর্বোধ যা-কিছু ছিল হয়ে গেল জল ,
শূন্য আকাশের মতো অত্যন্ত নির্মল ।
হাঁপ ছাড়ি উঠিলেন হবুচন্দ্ররাজ ,
আপনার মাথা হতে খুলি লয়ে তাজ
পরাইয়া দিল ক্ষীণ বাঙালির শিরে ,
ভারে তার মাথাটুকু পড়ে বুঝি ছিঁড়ে ।
বহুদিন পরে আজ চিন্তা গেল ছুটে ,
হাবুডুবু হবু-রাজ্য নড়িচড়ি উঠে ।
ছেলেরা ধরিল খেলা , বৃদ্ধেরা তামুক ,
এক দণ্ডে খুলে গেল রমণীর মুখ ।
দেশজোড়া মাথাধরা ছেড়ে গেল চট্ ,
সবাই বুঝিয়া গেল — হিং টিং ছট্ ।
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান ,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে , শুনে পুণ্যবান ।
যে শুনিবে এই স্বপ্নমঙ্গলের কথা ,
সর্বভ্রম ঘুচে যাবে নহিবে অন্যথা ।
বিশ্বে কভু বিশ্ব ভেবে হবে না ঠকিতে ,
সত্যেরে সে মিথ্যা বলি বুঝিবে চকিতে ।
যা আছে তা নাই আর নাই যাহা আছে ,
এ কথা জাজ্বল্যমান হবে তার কাছে ।
সবাই সরলভাবে দেখিবে যা কিছু ,
সে আপন লেজুড় জুড়িবে তার পিছু ।
এসো ভাই , তোলো হাই , শুয়ে পড়ো চিত ,
অনিশ্চিত এ সংসারে এ কথা নিশ্চিত —
জগতে সকলি মিথ্যা সব মায়াময় ,
স্বপ্ন শুধু সত্য আর সত্য কিছু নয় ।
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান ,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে , শুনে পুণ্যবান ।
হৃদয়যমুনা
যদি ভরিয়া লইবে কুম্ভ , এসো ওগো , এসো মোর
হৃদয়নীরে ।
তলতল ছলছল কাঁদিবে গভীর জল
ওই দুটি সুকোমল চরণ ঘিরে ।
আজি বর্ষা গাঢ়তম , নিবিড়কুন্তলসম
মেঘ নামিয়াছে মম দুইটি তীরে ।
ওই যে শবদ চিনি নূপুর-রিনিকিঝিনি ,
কে গো তুমি একাকিনী আসিছ ধীরে ।
যদি ভরিয়া লইবে কুম্ভ , এসো ওগো , এসো মোর
হৃদয়নীরে ।
যদি কলস ভাসায়ে জলে বসিয়া থাকিতে চাও
আপনা ভুলে —
হেথা শ্যাম দূর্বাদল , নবনীল নভস্তল ,
বিকশিত বনস্থল বিকচ ফুলে ।
দুটি কালো আঁখি দিয়া মন যাবে বাহিরিয়া
অঞ্চল খসিয়া গিয়া পড়িবে খুলে ।
চাহিয়া বঞ্জুলবনে কী জানি পড়িবে মনে
বসি কুঞ্জে তৃণাসনে শ্যামল কূলে!
যদি কলস ভাসায়ে জলে বসিয়া থাকিতে চাও
আপনা ভুলে ।
যদি গাহন করিতে চাহ , এসো নেমে এসো হেথা
গহনতলে ।
নীলাম্বরে কিবা কাজ , তীরে ফেলে এসো আজ ,
ঢেকে দিবে সব লাজ সুনীল জলে ।
সোহাগ-তরঙ্গরাশি অঙ্গখানি দিবে গ্রাসি ,
উচ্ছ্বসি পড়িবে আসি উরসে গলে —
ঘুরে ফিরে চারি পাশে কভু কাঁদে কভু হাসে ,
কুলুকুলু কলভাষে কত কী ছলে!
যদি গাহন করিতে চাহ , এসো নেমে এসো হেথা
গহনতলে ।