দেখিল চাহিয়া জীবনপূর্ণ
সুন্দর লোকালয়
প্রতি দিবসের হরষে বিষাদে
চির-কল্লোলময় ।
স্নেহসুধা লয়ে গৃহের লক্ষ্মী
ফিরিছে গৃহের মাঝে ,
প্রতি দিবসেরে করিছে মধুর
প্রতি দিবসের কাজে ।
সকাল বিকাল দুটি ভাই আসে
ঘরের ছেলের মতো ,
রজনী সবারে কোলেতে লইছে
নয়ন করিয়া নত ।
ছোটো ছোটো ফুল , ছোটো ছোটো হাসি ,
ছোটো কথা , ছোটো সুখ ,
প্রতি নিমেষের ভালোবাসাগুলি ,
ছোটো ছোটো হাসিমুখ
আপনা-আপনি উঠিছে ফুটিয়া
মানবজীবন ঘিরি ,
বিজন শিখরে বসিয়া সে তাই
দেখিতেছে ফিরি ফিরি ।
দেখে বহুদূরে ছায়াপুরী-সম
অতীত জীবন-রেখা ,
অস্তরবির সোনার কিরণে
নূতন বরনে লেখা ।
যাহাদের পানে নয়ন তুলিয়া
চাহে নি কখনো ফিরে ,
নবীন আভায় দেখা দেয় তারা
স্মৃতিসাগরের তীরে ।
হতাশ হৃদয়ে কাঁদিয়া কাঁদিয়া
পুরবীরাগিণী বাজে ,
দু-বাহু বাড়ায়ে ফিরে যেতে চায়
ওই জীবনের মাঝে ।
দিনের আলোক মিলায়ে আসিল
তবু পিছে চেয়ে রহে —
যাহা পেয়েছিল তাই পেতে চায়
তার বেশি কিছু নহে ।
সোনার জীবন রহিল পড়িয়া
কোথা সে চলিল ভেসে ।
শশীর লাগিয়া কাঁদিতে গেল কি
রবিশশীহীন দেশে ।
আত্মসমর্পণ
তোমার আনন্দগানে আমি দিব সুর
যাহা জানি দু-একটি প্রীতিসুমধুর
অন্তরের ছন্দোগাথা ; দুঃখের ক্রন্দনে
বাজিবে আমার কণ্ঠ বিষাদবিধুর
তোমার কণ্ঠের সনে ; কুসুমে চন্দনে
তোমারে পূজিব আমি ; পরাব সিন্দূর
তোমার সীমন্তে ভালে ; বিচিত্র বন্ধনে
তোমারে বাঁধিব আমি , প্রমোদসিন্ধুর
তরঙ্গেতে দিব দোলা নব ছন্দে তানে ।
মানব-আত্মার গর্ব আর নাহি মোর ,
চেয়ে তোর স্নিগ্ধশ্যাম মাতৃমুখ-পানে
ভালোবাসিয়াছি আমি ধূলিমাটি তোর ।
জন্মেছি যে মর্ত-কোলে ঘৃণা করি তারে
ছুটিব না স্বর্গ আর মুক্তি খুঁজিবারে ।
কন্টকের কথা
একদা পুলকে প্রভাত-আলোকে
গাহিছে পাখি ,
কহে কণ্টক বাঁকা কটাক্ষে
কুসুমে ডাকি —
তুমি তো কোমল বিলাসী কমল ,
দুলায় বায়ু ,
দিনের কিরণ ফুরাতে ফুরাতে
ফুরায় আয়ু ;
এ পাশে মধুপ মধুমদে ভোর ,
ও পাশে পবন পরিমল-চোর ,
বনের দুলাল , হাসি পায় তোর
আদর দেখে ।
আহা মরি মরি কী রঙিন বেশ ,
সোহাগহাসির নাহি আর শেষ ,
সারাবেলা ধরি রসালসাবেশ
গন্ধ মেখে ।
হায় কদিনের আদর-সোহাগ ,
সাধের খেলা
ললিত মাধুরী , রঙিন বিলাস ,
মধুপ-মেলা ।
‘ওগো নহি আমি তোদের মতন
সুখের প্রাণী —
হাব ভাব হাস , নানারঙা বাস
নাহিকো জানি ।
রয়েছি নগ্ন , জগতে লগ্ন
আপন বলে ;
কে পারে তাড়াতে , আমারে মাড়াতে
ধরণীতলে ।
তোদের মতন নহি নিমেষের ,
আমি এ নিখিলে চিরদিবসের ,
বৃষ্টি-বাদল ঝড়-বাতাসের
না রাখি ভয় ।
সতত একাকী , সঙ্গীবিহীন —
কারো কাছে কোনো নাহি প্রেম-ঋণ ,
চাটুগান শুনি সারা নিশিদিন
করি না ক্ষয় ।
আসিবে তো শীত , বিহঙ্গগীত
যাইবে থামি ,
ফুলপল্লব ঝরে যাবে সব —
রহিব আমি ।
চেয়ে দেখো মোরে , কোনো বাহুল্য
কোথাও নাই ,
স্পষ্ট সকলি আমার মূল্য
জানে সবাই ।
এ ভীরু জগতে যার কাঠিন্য
জগৎ তারি ।
নখের আঁচড়ে আপন চিহ্ন
রাখিতে পারি ।
কেহ জগতেরে চামর ঢুলায় ,
চরণে কোমল হস্ত বুলায় ,
নতমস্তকে লুটায়ে ধুলায়
প্রণাম করে ।
ভুলাইতে মন কত করে ছল —
কাহারো বর্ণ , কারো পরিমল ,
বিফল বাসরসজ্জা , কেবল
দুদিন-তরে ।
কিছুই করি না , নীরবে দাঁড়ায়ে
তুলিয়া শির
বিঁধিয়া রয়েছি অন্তর-মাঝে
এ পৃথিবীর ।
‘আমারে তোমরা চাহ না চাহিতে
চোখের কোণে ,
গরবে ফাটিয়া উঠেছ ফুটিয়া
আপন মনে ।
আছে তব মধু , থাক্ সে তোমার
আমার নাহি ।
আছে তব রূপ মোর পানে কেহ
দেখে না চাহি ।
কারো আছে শাখা , কারো আছে দল ,
কারো আছে ফুল , কারো আছে ফল ,
আমারি হস্ত রিক্ত কেবল
দিবসযামী ।
ওহে তরু , তুমি বৃহৎ প্রবীণ ,
আমাদের প্রতি অতি উদাসীন —
আমি বড়ো নহি , আমি ছায়াহীন ,
ক্ষুদ্র আমি ।
হই না ক্ষুদ্র , তবুও রুদ্র
ভীষণ ভয় —
আমার দৈন্য সে মোর সৈন্য ,
তাহারি জয় ।’
খেলা
হোক খেলা , এ খেলায় যোগ দিতে হবে
আনন্দকল্লোলাকুল নিখিলের সনে ।
সব ছেড়ে মৌনী হয়ে কোথা বসে রবে
আপনার অন্তরের অন্ধকার কোণে!
জেনো মনে শিশু তুমি এ বিপুল ভবে
অনন্ত কালের কোলে , গগনপ্রাঙ্গণে —
যত জান মনে কর কিছুই জান না ।
বিনয়ে বিশ্বাসে প্রেমে হাতে লহ তুলি
বর্ণগন্ধগীতময় যে মহা-খেলনা
তোমারে দিয়াছে মাতা ; হয় যদি ধূলি
হোক ধূলি , এ ধূলির কোথায় তুলনা!
থেকো না অকালবৃদ্ধ বসিয়া একেলা —
কেমনে মানুষ হবে না করিলে খেলা!
গতি
জানি আমি সুখে দুঃখে হাসি ও ক্রন্দনে
পরিপূর্ণ এ জীবন , কঠোর বন্ধনে
ক্ষতচিহ্ন পড়ে যায় গ্রনিথতে গ্রনিথতে ,
জানি আমি , সংসারের সমুদ্র মনিথতে
কারো ভাগ্যে সুধা ওঠে , কারো হলাহল ।
জানি না কেন এ সব , কোন্ ফলাফল
আছে এই বিশ্বব্যাপী কর্মশৃঙ্খলার ।
জানি না কী হবে পরে , সবি অন্ধকার
আদি অন্ত এ সংসারে — নিখিল দুঃখের
অন্ত আছে কি না আছে , সুখ-বুভুক্ষের
মিটে কি না চির-আশা । পণ্ডিতের দ্বারে
চাহি না এ জনমরহস্য জানিবারে ।
চাহি না ছিঁড়িতে একা বিশ্বব্যাপী ডোর ,
লক্ষ কোটি প্রাণী-সাথে এক গতি মোর ।