কেমন বীর-মুরতি তার
মাধুরী দিয়ে মিশা।
দীপ্তিভরা নয়নমাঝে
তৃপ্তিহীন তৃষা।
স্বপ্নে তারে দেখেছে যেন
এমনি মনে লয়—
ভুলিয়া গেছে, রয়েছে শুধু
অসীম বিস্ময়।
পারশে যেন বসিয়াছিল,
ধরিয়াছিল কর,
এখনো তার পরশে যেন
সরস কলেবর।
চমকি মুখ দু-হাতে ঢাকে,
শরমে টুটে মন,
লজ্জাহীন প্রদীপ কেন
নিভে নি সেই ক্ষণ।
কণ্ঠ হতে ফেলিল হার
যেন বিজুলিজ্বালা,
শয়ন’পরে লুটায়ে পড়ে
ভাবিল রাজবালা—
কে পরালে মালা!
এমনি ধীরে একটি করে
কাটিছে দিন রাতি।
বসন্ত সে বিদায় নিল
লইয়া যূথী-জাতি।
সঘন মেঘে বরষা আসে,
বরষে ঝরঝর্।
কাননে ফুটে নবমালতী
কদম্বকেশর।
স্বচ্ছ হাসি শরৎ আসে
পূর্ণিমামালিকা।
সকল বন আকুল করে
শুভ্র শেফালিকা।
আসিল শীত সঙ্গে লয়ে
দীর্ঘ দুখনিশা।
শিশির-ঝরা কুন্দফুলে
হাসিয়া কাঁদে দিশা।
ফাগুন মাস আবার এল
বহিয়া ফুলডালা।
জানালা-পাশে একেলা বসে
ভাবিছে রাজবালা—
কে পরালে মালা!
সোনার তরী
গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।
রাশি রাশি ভারা ভারা
ধান কাটা হল সারা,
ভরা নদী ক্ষুরধারা
খরপরশা।
কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।
একখানি ছোটো খেত, আমি একেলা,
চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।
পরপারে দেখি আঁকা
তরুছায়ামসীমাখা
গ্রামখানি মেঘে ঢাকা
প্রভাতবেলা—
এ পারেতে ছোটো খেত, আমি একেলা।
গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে,
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ভরা-পালে চলে যায়,
কোনো দিকে নাহি চায়,
ঢেউগুলি নিরুপায়
ভাঙে দু-ধারে—
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ওগো, তুমি কোথা যাও কোন্ বিদেশে,
বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।
যেয়ো যেথা যেতে চাও,
যারে খুশি তারে দাও,
শুধু তুমি নিয়ে যাও
ক্ষণিক হেসে
আমার সোনার ধান কূলেতে এসে।
যত চাও তত লও তরণী-’পরে।
আর আছে?— আর নাই, দিয়েছি ভরে।
এতকাল নদীকূলে
যাহা লয়ে ছিনু ভুলে
সকলি দিলাম তুলে
থরে বিথরে—
এখন আমারে লহ করুণা করে।
ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই— ছোটো সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
শ্রাবণগগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি—
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।
সোনার বাঁধন
বন্দী হয়ে আছ তুমি সুমধুর স্নেহে
অয়ি গৃহলক্ষ্মী, এই করুণক্রন্দন
এই দুঃখদৈন্যে-ভরা মানবের গেহে।
তাই দুটি বাহু’পরে সুন্দরবন্ধন
সোনার কঙ্কণ দুটি বহিতেছে দেহে
শুভচিহ্ন, নিখিলের নয়ননন্দন।
পুরুষের দুই বাহু কিণাঙ্ক-কঠিন
সংসারসংগ্রামে, সদা বন্ধনবিহীন;
যুন্ধ-দ্বন্দ্ব যত কিছু নিদারুণ কাজে
বহ্নিবাণ বজ্রসম সর্বত্র স্বাধীন।
তুমি বদ্ধ স্নেহ-প্রেম-করুণার মাঝে—
শুধু শুভকর্ম, শুধু সেবা নিশিদিন।
তোমার বাহুতে তাই কে দিয়াছে টানি,
দুইটি সোনার গণ্ডি, কাঁকন দুখানি।
হিং টিং ছট্
স্বপ্নমঙ্গল
স্বপ্ন দেখেছেন রাত্রে হবুচন্দ্র ভূপ ,
অর্থ তার ভাবি ভাবি গবুচন্দ্র চুপ ।
শিয়রে বসিয়ে যেন তিনটে বাঁদরে
উকুন বাছিতেছিল পরম আদরে ।
একটু নড়িতে গেলে গালে মারে চড় ,
চোখে মুখে লাগে তার নখের আঁচড় ।
সহসা মিলাল তারা , এল এক বেদে ,
‘ পাখি উড়ে গেছে ‘ ব ‘ লে মরে কেঁদে কেঁদে ;
সম্মুখে রাজারে দেখি তুলি নিল ঘাড়ে ,
ঝুলায়ে বসায়ে দিল উচ্চ এক দাঁড়ে ।
নীচেতে দাঁড়ায়ে এক বুড়ি থুড়্থুড়ি
হাসিয়া পায়ের তলে দেয় সুড়্সুড়ি ।
রাজা বলে , ‘ কী আপদ! ‘ কেহ নাহি ছাড়ে ,
পা দুটা তুলিতে চাহে , তুলিতে না পারে ।
পাখির মতন রাজা করে ঝট্পট্ ,
বেদে কানে কানে বলে — ‘ হিং টিং ছট্ । ‘
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান ,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে , শুনে পুণ্যবান ।
হবুপুর রাজ্যে আজ দিন ছয়-সাত
চোখে কারো নিদ্রা নাই , পেটে নাই ভাত ।
শীর্ণ গালে হাত দিয়ে নত করি শির
রাজ্যসুদ্ধ বালবৃদ্ধ ভেবেই অস্থির ।
ছেলেরা ভুলেছে খেলা , পণ্ডিতেরা পাঠ ,
মেয়েরা করেছে চুপ — এতই বিভ্রাট ।
সারি সারি বসে গেছে কথা নাহি মুখে ,
চিন্তা যত ভারী হয় মাথা পড়ে ঝুঁকে ।
ভুঁইফোঁড়া তত্ত্ব যেন ভূমিতলে খোঁজে ,
সবে যেন বসে গেছে নিরাকার ভোজে ।
মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ছাড়িয়া উৎকট
হঠাৎ ফুকারি উঠে — ‘ হিং টিং ছট্ । ‘
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান ,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে , শুনে পুণ্যবান ।
চারি দিক হতে এল পণ্ডিতের দল —
অযোধ্যা কনোজ কাঞ্চী মগধ কোশল ।
উজ্জয়িনী হতে এল বুধ-অবতংস
কালিদাস-কবীন্দ্রের ভাগিনেয়বংশ ।
মোটা মোটা পুঁথি লয়ে উলটায় পাতা ,
ঘন ঘন নাড়ে বসি টিকিসুদ্ধ মাথা ।
বড়ো বড়ো মস্তকের পাকা শস্যখেত
বাতাসে দুলিছে যেন শীর্ষ-সমেত ।
কেহ শ্রুতি , কেহ স্মৃতি , কেহবা পুরাণ ,
কেহ ব্যাকরণ দেখে , কেহ অভিধান ।
কোনোখানে নাহি পায় অর্থ কোনোরূপ ,
বেড়ে ওঠে অনুস্বর-বিসর্গের স্তূপ ।
চুপ করে বসে থাকে বিষম সংকট ,
থেকে থেকে হেঁকে ওঠে — ‘ হিং টিং ছট্ । ‘
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান ,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে , শুনে পুণ্যবান ।
কহিলেন হতাশ্বাস হবুচন্দ্ররাজ ,
‘ ম্লেচ্ছদেশে আছে নাকি পণ্ডিত-সমাজ ,
তাহাদের ডেকে আনো যে যেখানে আছে —
অর্থ যদি ধরা পড়ে তাহাদের কাছে । ‘
কটাচুল নীলচক্ষু কপিশকপোল ,
যবন পণ্ডিত আসে , বাজে ঢাক ঢোল ।
গায়ে কালো মোটা মোটা ছাঁটাছোঁটা কুর্তি ,
গ্রীষ্মতাপে উষ্মা বাড়ে , ভারি উগ্রমূর্তি ।
ভূমিকা না করি কিছু ঘড়ি খুলি কয় —
‘ সতেরো মিনিট মাত্র রয়েছে সময় ,
কথা যদি থাকে কিছু বলো চট্পট্ । ‘
সভাসুদ্ধ বলি উঠে — ‘ হিং টিং ছট্ । ‘
‘ স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান ,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে , শুনে পুণ্যবান ।