আমি পৃথিবীর শিশু বসে আছি তব উপকূলে ,
শুনিতেছি ধ্বনি তব । ভাবিতেছি , বুঝা যায় যেন
কিছু কিছু মর্ম তার — বোবার ইঙ্গিতভাষা-হেন
আত্মীয়ের কাছে । মনে হয় , অন্তরের মাঝখানে
নাড়ীতে যে-রক্ত বহে , সেও যেন ওই ভাষা জানে ,
আর কিছু শেখে নাই । মনে হয় , যেন মনে পড়ে
যখন বিলীনভাবে ছিনু ওই বিরাট জঠরে
অজাত ভুবনভ্রূণ-মাঝে , লক্ষকোটি বর্ষ ধ ‘ রে
ওই তব অবিশ্রাম কলতান অন্তরে অন্তরে
মুদ্রিত হইয়া গেছে ; সেই জন্মপূর্বের স্মরণ ,
গর্ভস্থ পৃথিবী ‘ পরে সেই নিত্য জীবনস্পন্দন
তব মাতৃহৃদয়ের — অতি ক্ষীণ আভাসের মতো
জাগে যেন সমস্ত শিরায় , শুনি যবে নেত্র করি নত
বসি জনশূন্য তীরে ওই পুরাতন কলধ্বনি ।
দিক্ হতে দিগন্তরে যুগ হতে যুগান্তর গণি
তখন আছিলে তুমি একাকিনী অখণ্ড অকূল
আত্মহারা , প্রথম গর্ভের মহা রহস্য বিপুল
না বুঝিয়া । দিবারাত্রি গূঢ় এক স্নেহব্যাকুলতা ,
গর্ভিণীর পূর্বরাগ , অলক্ষিতে অপূর্ব মমতা ,
অজ্ঞাত আকাঙ্ক্ষারাশি , নিঃসন্তান শূন্য বক্ষোদেশে
নিরন্তর উঠিত ব্যাকুলি । প্রতি প্রাতে উষা এসে
অনুমান করি যেত মহাসন্তানের জন্মদিন ,
নক্ষত্র রহিত চাহি নিশি নিশি নিমেষবিহীন
শিশুহীন শয়ন-শিয়রে । সেই আদিজননীর
জনশূন্য জীবশূন্য স্নেহচঞ্চলতা সুগভীর ,
আসন্ন প্রতীক্ষাপূর্ণ সেই তব জাগ্রত বাসনা ,
অগাধ প্রাণের তলে সেই তব অজানা বেদনা
অনাগত মহাভবিষ্যৎ লাগি হৃদয়ে আমার
যুগান্তরস্মৃতিসম উদিত হতেছে বারম্বার ।
আমারো চিত্তের মাঝে তেমনি অজ্ঞাতব্যথাভরে ,
তেমনি অচেনা প্রত্যাশায় , অলক্ষ্য সুদূর-তরে
উঠিছে মর্মর স্বর । মানবহৃদয়-সিন্ধুতলে
যেন নব মহাদেশ সৃজন হতেছে পলে পলে ,
আপনি সে নাহি জানে । শুধু অর্ধ-অনুভব তারি
ব্যাকুল করেছে তারে , মনে তার দিয়েছে সঞ্চারি
আকারপ্রকারহীন তৃপ্তিহীন এক মহা আশা —
প্রমাণের অগোচর , প্রত্যক্ষের বাহিরেতে বাসা ।
তর্ক তারে পরিহাসে , মর্ম তারে সত্য বলি জানে ,
সহস্র ব্যাঘাত-মাঝে তবুও সে সন্দেহ না মানে ,
জননী যেমন জানে জঠরের গোপন শিশুরে ,
প্রাণে যবে স্নেহ জাগে , স্তনে যবে দুগ্ধ উঠে পূরে ।
প্রাণভরা ভাষাহরা দিশাহারা সেই আশা নিয়ে
চেয়ে আছি তোমা পানে ; তুমি সিন্ধু , প্রকাণ্ড হাসিয়ে
টানিয়া নিতেছ যেন মহাবেগে কী নাড়ীর টানে
আমার এ মর্মখানি তোমার তরঙ্গ-মাঝখানে
কোলের শিশুর মতো ।
হে জলধি , বুঝিবে কি তুমি
আমার মানবভাষা । জান কি তোমার ধরাভূমি
পীড়ায় পীড়িত আজি ফিরিতেছে এ-পাশ ও-পাশ ,
চক্ষে বহে অশ্রুধারা , ঘন ঘন বহে উষ্ণ শ্বাস ।
নাহি জানে কী যে চায় , নাহি জানে কিসে ঘুচে তৃষা ,
আপনার মনোমাঝে আপনি সে হারায়েছে দিশা
বিকারের মরীচিকা-জালে । অতল গম্ভীর তব
পীড়িয়া নাড়িয়া যেন টুটিয়া ফেলিয়া একেবারে
অসীম অতৃপ্তিমাঝে গ্রাসিতে নাশিতে চাহ তারে
অন্তর হইতে কহ সান্ত্বনার বাক্য অভিনব
আষাঢ়ের জলদমন্দ্রের মতো ; স্নিগ্ধ মাতৃপাণি
চিন্তাতপ্ত ভালে তার তালে তালে বারম্বার হানি ,
সর্বাঙ্গে সহস্রবার দিয়া তারে স্নেহময় চুমা ,
বলো তার ‘ শান্তি , শান্তি ‘ , বলো তারে ‘ ঘুমা , ঘুমা , ঘুমা ‘ ।
সুপ্তোত্থিতা
ঘুমের দেশে ভাঙিল ঘুম,
উঠিল কলস্বর।
গাছের শাখে জাগিল পাখি
কুসুমে মধুকর।
অশ্বশালে জাগিল ঘোড়া,
হস্তিশালে হাতি।
মল্লশালে মল্ল জাগি
ফুলায় পুন ছাতি।
জাগিল পথে প্রহরিদল,
দুয়ারে জাগে দ্বারী।
আকাশে চেয়ে নিরখে বেলা
জাগিয়া নরনারী।
উঠিল জাগি রাজাধিরাজ,
জাগিল রানীমাতা।
কচালি আঁখি কুমার-সাথে
জাগিল রাজভ্রাতা।
নিভৃত ঘরে ধূপের বাস,
রতন-দীপ জ্বালা,
জাগিয়া উঠি শয্যাতলে
শুধাল রাজবালা—
কে পরালে মালা!
খসিয়া-পড়া আঁচলখানি
বক্ষে তুলি দিল।
আপন-পানে নেহারি চেয়ে
শরমে শিহরিল।
ত্রস্ত হয়ে চকিত চোখে
চাহিল চারিদিকে,
বিজন গৃহ, রতন-দীপ
জ্বলিছে অনিমিখে।
গলার মালা খুলিয়া লয়ে
ধরিয়া দুটি করে
সোনার সুতে যতনে গাঁথা
লিখনখানি পড়ে।
পড়িল নাম, পড়িল ধাম,
পড়িল লিপি তার,
কোলের ‘পরে বিছায়ে দিয়ে
পড়িল শতবার।
শয়নশেষে রহিল বসে,
ভাবিল রাজবালা—
আপন ঘরে ঘুমায়েছিনু
নিতান্ত নিরালা—
কে পরালে মালা!
নূতন-জাগা কুঞ্জবনে
কুহরি উঠে পিক,
বসন্তের চুম্বনেতে
বিবশ দশ দিক।
বাতাস ঘরে প্রবেশ করে
ব্যাকুল উচ্ছ্বাসে,
নবীন ফুলমঞ্জরির
গন্ধ লয়ে আসে।
জাগিয়া উঠি বৈতালিক
গাহিছে জয়গান,
প্রাসাদদ্বারে ললিত স্বরে
বাঁশিতে উঠে তান।
শীতলছায়া নদীর পথে
কলসে লয়ে বারি—
কাঁকন বাজে, নূপুর বাজে—
চলিছে পুরনারী।
কাননপথে মর্মরিয়া
কাঁপিছে গাছপালা,
আধেক মুদি নয়ন দুটি
ভাবিছে রাজবালা—
কে পরালে মালা!
বারেক মালা গলায় পরে,
বারেক লহে খুলি,
দুইটি করে চাপিয়া ধরে
বুকের কাছে তুলি।
শয়ন’পরে মেলায়ে দিয়ে
তৃষিত চেয়ে রয়,
এমনি করে পাইবে যেন
অধিক পরিচয়।
জগতে আজ কত-না ধ্বনি
উঠিছে কত ছলে—
একটি আছে গোপন কথা,
সে কেহ নাহি বলে।
বাতাস শুধু কানের কাছে
বহিয়া যায় হূহু,
কোকিল শুধু অবিশ্রাম
ডাকিছে কুহু কুহু।
নিভৃত ঘরে পরান-মন
একান্ত উতালা,
শয়নশেষে নীরবে বসে
ভাবিছে রাজবালা—
কে পরালে মালা!