এ কি শুধু বাসনার বিফল মিনতি,
কল্পনার ছল? কার এত দিব্যজ্ঞান,
কে বলিতে পারে মোরে নিশ্চয় প্রমাণ—
পূর্বজন্মে নারীরূপে ছিলে কি না তুমি
আমারি জীবন-বনে সৌন্দর্যে কুসুমি,
প্রণয়ে বিকশি। মিলনে আছিলে বাঁধা
শুধু এক ঠাঁই, বিরহে টুটিয়া বাধা
আজি বিশ্বময় ব্যাপ্ত হয়ে গেছ প্রিয়ে,
তোমারে দেখিতে পাই সর্বত্র চাহিয়ে।
ধূপ দগ্ধ হয়ে গেছে, গন্ধবাষ্প তার
পূর্ণ করি ফেলিয়াছে আজি চারি ধার।
গৃহের বনিতা ছিলে, টুটিয়া আলয়
বিশ্বের কবিতারূপে হয়েছ উদয়—
তবু কোন্ মায়া-ডোরে চিরসোহাগিনী,
হৃদয়ে দিয়েছ ধরা, বিচিত্র রাগিণী
জাগায়ে তুলিছ প্রাণে চিরস্মৃতিময়।
তাই তো এখনো মনে আশা জেগে রয়
আবার তোমারে পাব পরশবন্ধনে।
এমনি সমস্ত বিশ্ব প্রলয়ে সৃজনে
জ্বলিছে নিবিছে, যেন খদ্যোতের জ্যোতি,
কখনো বা ভাবময়, কখনো মুরতি।
রজনী গভীর হল, দীপ নিবে আসে;
পদ্মার সুদূর পারে পশ্চিম আকাশে
কখন যে সায়াহ্নের শেষ স্বর্ণরেখা
মিলাইয়া গেছে; সপ্তর্ষি দিয়েছে দেখা
তিমিরগগনে; শেষ ঘট পূর্ণ ক’রে
কখন বালিকা-বধূ চলে গেছে ঘরে;
হেরি কৃষ্ণপক্ষ রাত্রি, একাদশী তিথি,
দীর্ঘ পথ, শূন্য ক্ষেত্র, হয়েছে অতিথি
গ্রামে গৃহস্থের ঘরে পান্থ পরবাসী;
কখন গিয়েছে থেমে কলরবরাশি
মাঠপারে কৃষিপল্লী হতে; নদীতীরে
বৃদ্ধ কৃষাণের জীর্ণ নিভৃত কুটিরে
কখন জ্বলিয়াছিল সন্ধ্যাদীপখানি,
কখন নিভিয়া গেছে— কিছুই না জানি।
কী কথা বলিতেছিনু, কী জানি, প্রেয়সী,
অর্ধ-অচেতনভাবে মনোমাঝে পশি
স্বপ্নমুগ্ধ-মতো। কেহ শুনেছিলে সে কি,
কিছু বুঝেছিলে প্রিয়ে, কোথাও আছে কি
কোনো অর্থ তার? সব কথা গেছি ভুলে,
শুধু এই নিদ্রাপূর্ণ নিশীথের কূলে
অন্তরের অন্তহীন অশ্রু-পারাবার
উদ্বেলিয়া উঠিয়াছে হৃদয়ে আমার
গম্ভীর নিস্বনে।
এসো সুপ্তি, এসো শান্তি,
এসো প্রিয়ে, মুগ্ধ মৌন সকরুণ কান্তি,
বক্ষে মোরে লহো টানি— শোয়াও যতনে
মরণসুস্নিগ্ধ ও শুভ্র বিস্মৃতিশয়নে।
মায়াবাদ
হা রে নিরানন্দ দেশ , পরি জীর্ণ জরা ,
বহি বি জ্ঞ তার বোঝা , ভাবিতেছ মনে
ঈশ্বরের প্রবঞ্চনা পড়িয়াছে ধরা
সুচতুর সূক্ষ্মদৃষ্টি তোমার নয়নে!
লয়ে কুশাঙ্কুর বুদ্ধি শাণিত প্রখরা
কর্মহীন রাত্রিদিন বসি গৃহকোণে
মিথ্যা ব ‘ লে জানিয়াছ বিশ্ববসুন্ধরা
গ্রহতারাময় সৃষ্টি অনন্ত গগনে ।
যুগযুগান্তর ধ ‘ রে পশু পক্ষী প্রাণী
অচল নির্ভয়ে হেথা নিতেছে নিশ্বাস
বিধাতার জগতেরে মাতৃক্রোড় মানি ;
তুমি বৃদ্ধ কিছুরেই কর না বিশ্বাস!
লক্ষ কোটি জীব লয়ে এ বিশ্বের মেলা
তুমি জানিতেছ মনে , সব ছেলেখেলা ।
মুক্তি
চক্ষু কর্ণ বুদ্ধি মন সব রুদ্ধ করি ,
বিমুখ হইয়া সর্ব জগতের পানে ,
শুদ্ধ আপনার ক্ষুদ্র আত্মাটিরে ধরি
মুক্তি-আশে সন্তরিব কোথায় কে জানে!
পার্শ্ব দিয়ে ভেসে যাবে বিশ্বমহাতরী
অম্বর আকুল করি যাত্রীদের গানে ,
শুভ্র কিরণের পালে দশ দিক ভরি ‘ ,
বিচিত্র সৌন্দর্যে পূর্ণ অসংখ্য পরানে ।
ধীরে ধীরে চলে যাবে দূর হতে দূরে
অখিল ক্রন্দন-হাসি আঁধার-আলোক ,
বহে যাবে শূন্যপথে সকরুণ সুরে
অনন্ত-জগৎ-ভরা যত দুঃখশোক ।
বিশ্ব যদি চলে যায় কাঁদিতে কাঁদিতে
আমি একা বসে রব মুক্তি-সমাধিতে ?
যেতে নাহি দিব
দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি ; বেলা দ্বিপ্রহর ;
হেমন্তের রৌদ্র ক্রমে হতেছে প্রখর ।
জনশূন্য পল্লিপথে ধূলি উড়ে যায়
মধ্যাহ্ন-বাতাসে ; স্নিগ্ধ অশত্থের ছায়
ক্লান্ত বৃদ্ধা ভিখারিণী জীর্ণ বস্ত্র পাতি
ঘুমায়ে পড়েছে ; যেন রৌদ্রময়ী রাতি
ঝাঁ ঝাঁ করে চারি দিকে নিস্তব্ধ নিঃঝুম —
শুধু মোর ঘরে নাহি বিশ্রামের ঘুম ।
গিয়েছে আশ্বিন — পূজার ছুটির শেষে
ফিরে যেতে হবে আজি বহুদূরদেশে
সেই কর্মস্থানে । ভৃত্যগণ ব্যস্ত হয়ে
বাঁধিছে জিনিসপত্র দড়াদড়ি লয়ে ,
হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি এ-ঘরে ও-ঘরে ।
ঘরের গৃহিণী , চক্ষু ছলছল করে ,
ব্যথিছে বক্ষের কাছে পাষাণের ভার ,
তবুও সময় তার নাহি কাঁদিবার
একদণ্ড তরে ; বিদায়ের আয়োজনে
ব্যস্ত হয়ে ফিরে ; যথেষ্ট না হয় মনে
যত বাড়ে বোঝা । আমি বলি , ‘ এ কী কাণ্ড!
এত ঘট এত পট হাঁড়ি সরা ভাণ্ড
বোতল বিছানা বাক্স রাজ্যের বোঝাই
কী করিব লয়ে কিছু এর রেখে যাই
কিছু লই সাথে । ‘
সে কথায় কর্ণপাত
নাহি করে কোনো জন । ‘ কী জানি দৈবাৎ
এটা ওটা আবশ্যক যদি হয় শেষে
তখন কোথায় পাবে বিভুঁই বিদেশে ?
সোনামুগ সরু চাল সুপারি ও পান ;
ও হাঁড়িতে ঢাকা আছে দুই-চারিখান
গুড়ের পাটালি ; কিছু ঝুনা নারিকেল ;
দুই ভাণ্ড ভালো রাই-সরিষার তেল ;
আমসত্ত্ব আমচুর ; সের দুই দুধ —
এই-সব শিশি কৌটা ওষুধবিষুধ ।
মিষ্টান্ন রহিল কিছু হাঁড়ির ভিতরে ,
মাথা খাও , ভুলিয়ো না , খেয়ো মনে করে । ‘
বুঝিনু যুক্তির কথা বৃথা বাক্যব্যয় ।
বোঝাই হইল উঁচু পর্বতের ন্যায় ।
তাকানু ঘড়ির পানে , তার পরে ফিরে
চাহিনু প্রিয়ার মুখে ; কহিলাম ধীরে ,
‘ তবে আসি ‘ । অমনি ফিরায়ে মুখখানি
নতশিরে চক্ষু- ‘ পরে বস্ত্রাঞ্চল টানি
অমঙ্গল অশ্রুজল করিল গোপন ।
বাহিরে দ্বারের কাছে বসি অন্যমন
কন্যা মোর চারি বছরের । এতক্ষণ
অন্য দিনে হয়ে যেত স্নান সমাপন ,
দুটি অন্ন মুখে না তুলিতে আঁখিপাতা
মুদিয়া আসিত ঘুমে ; আজি তার মাতা
দেখে নাই তারে ; এত বেলা হয়ে যায়
নাই স্নানাহার । এতক্ষণ ছায়াপ্রায়
ফিরিতেছিল সে মোর কাছে কাছে ঘেঁষে ,
চাহিয়া দেখিতেছিল মৌন নির্নিমেষে
বিদায়ের আয়োজন । শ্রান্তদেহে এবে
বাহিরের দ্বারপ্রান্তে কী জানি কী ভেবে
চুপিচাপি বসে ছিল । কহিনু যখন
‘ মা গো , আসি ‘ সে কহিল বিষণ্ন-নয়ন
ম্লান মুখে , ‘ যেতে আমি দিব না তোমায় । ‘
যেখানে আছিল বসে রহিল সেথায় ,
ধরিল না বাহু মোর , রুধিল না দ্বার ,
শুধু নিজ হৃদয়ের স্নেহ-অধিকার
প্রচারিল — ‘ যেতে আমি দিব না তোমায় ‘ ।
তবুও সময় হল শেষ , তবু হায়
যেতে দিতে হল ।