দুই পক্ষে মিলে একেবারে আত্মহারা
অবোধ অজ্ঞান । সৌন্দর্যের দস্যু তারা
লুটেপুটে নিতে চায় সব । এত গীতি ,
এত ছন্দ , এত ভাবে উচ্ছ্বাসিত প্রীতি ,
এত মধুরতা দ্বারের সম্মুখ দিয়া
বহে যায় — তাই তারা পড়েছে আসিয়া
সবে মিলি কলরবে সেই সুধাস্রোতে ।
সমুদ্রবাহিনী সেই প্রেমধারা হতে
কলস ভরিয়া তারা লয়ে যায় তীরে
বিচার না করি কিছু , আপন কুটিরে
আপনার তরে । তুমি মিছে ধর দোষ ,
সে সাধু পণ্ডিত , মিছে করিতেছ রোষ ।
যাঁর ধন তিনি ওই অপার সন্তোষে
অসীম স্নেহের হাসি হাসিছেন বসে ।
ব্যর্থ যৌবন
আজি যে রজনী যায় ফিরাইব তায়
কেমনে ?
কেন নয়নের জল ঝরিছে বিফল
নয়নে!
এ বেশভূষণ লহ সখী , লহ ,
এ কুসুমমালা হয়েছে অসহ —
এমন যামিনী কাটিল বিরহ
শয়নে ।
আজি যে-রজনী যায় ফিরাইব তায়
কেমনে ।
আমি বৃথা অভিসারে এ যমুনাপারে
এসেছি ।
বহি বৃথা মনোআশা এত ভালোবাসা
বেসেছি ।
শেষে নিশিশেষে বদন মলিন ,
ক্লান্ত চরণ , মন উদাসীন ,
ফিরিয়া চলেছি কোন্ সুখহীন
ভবনে!
হায় , যে-রজনী যায় ফিরাইব তায়
কেমনে ?
কত উঠেছিল চাঁদ নিশীথ-অগাধ
আকাশে!
বনে দুলেছিল ফুল গন্ধব্যাকুল
বাতাসে ।
তরুমর্মর নদীকলতান
কানে লেগেছিল স্বপ্নসমান ,
দূর হতে আসি পশেছিল গান
শ্রবণে ।
আজি সে রজনী যায় , ফিরাইব তায়
কেমনে ।
মনে লেগেছিল হেন , আমারে সে যেন
ডেকেছে ।
যেন চিরযুগ ধরে মোরে মনে করে
রেখেছে ।
সে আনিবে বহি ভরা অনুরাগ ,
যৌবননদী করিবে সজাগ ,
আসিবে নিশীথে , বাঁধিবে সোহাগ-
বাঁধনে ।
আহা , সে রজনী যায় , ফিরাইব তায়
কেমনে ।
ওগো , ভোলা ভালো তবে , কাঁদিয়া কী হবে
মিছে আর ?
যদি যেতে হল হায় , প্রাণ কেন চায়
পিছে আর ?
কুঞ্জদুয়ারে অবোধের মতো
রজনীপ্রভাতে বসে রব কত!
এবারের মতো বসন্ত গত
জীবনে ।
হায় যে রজনী যায় ফিরাইব তায়
কেমনে ।
ভরা ভাদরে
নদী ভরা কূলে কূলে , খেতে ভরা ধান ।
আমি ভাবিতেছি বসে কী গাহিব গান ।
কেতকী জলের ধারে
ফুটিয়াছে ঝোপে ঝাড়ে ,
নিরাকুল ফুলভারে
বকুল-বাগান ।
কানায় কানায় পূর্ণ আমার পরান ।
ঝিলিমিলি করে পাতা , ঝিকিমিকি আলো
আমি ভাবিতেছি কার আঁখিদুটি কালো ।
কদম্ব গাছের সার ,
চিকন পল্লবে তার
গন্ধে-ভরা অন্ধকার
হয়েছে ঘোরালো ।
কারে বলিবারে চাহি কারে বাসি ভালো ।
অম্লান উজ্জ্বল দিন , বৃষ্টি অবসান ।
আমি ভাবিতেছি আজি কী করিব দান ।
মেঘখণ্ড থরে থরে
উদাস বাতাস-ভরে
নানা ঠাঁই ঘুরে মরে
হতাশ-সমান ।
সাধ যায় আপনারে করি শতখান ।
দিবস অবশ যেন হয়েছে আলসে ।
আমি ভাবি আর কেহ কী ভাবিছে বসে ।
তরুশাখে হেলাফেলা
কামিনীফুলের মেলা ,
থেকে থেকে সারাবেলা
পড়ে খ ‘ সে খ ‘ সে ।
কী বাঁশি বাজিছে সদা প্রভাতে প্রদোষে ।
পাখির প্রমোদগানে পূর্ণ বনস্থল ।
আমি ভাবিতেছি চোখে কেন আসে জল ।
দোয়েল দুলায়ে শাখা
গাহিছে অমৃতমাখা ,
নিভৃত পাতায় ঢাকা
কপোতযুগল ।
আমারে সকলে মিলে করেছে বিকল
মানসসুন্দরী
আজ কোনো কাজ নয়— সব ফেলে দিয়ে
ছন্দ বন্ধ গ্রন্থ গীত— এসো তুমি প্রিয়ে,
আজন্ম-সাধন-ধন সুন্দরী আমার
কবিতা, কল্পনালতা। শুধু একবার
কাছে বোসো। আজ শুধু কূজন গুঞ্জন
তোমাতে আমাতে; শুধু নীরবে ভুঞ্জন
এই সন্ধ্যা-কিরণের সুবর্ণ মদিরা—
যতক্ষণ অন্তরের শিরা-উপশিরা
লাবণ্যপ্রবাহভরে ভরি নাহি উঠে,
যতক্ষণে মহানন্দে নাহি যায় টুটে
চেতনাবেদনাবন্ধ, ভুলে যাই সব—
কী আশা মেটে নি প্রাণে, কী সংগীতরব
গিয়েছে নীরব হয়ে, কী আনন্দসুধা
অধরের প্রান্তে এসে অন্তরের ক্ষুধা
না মিটায়ে গিয়াছে শুকায়ে। এই শান্তি,
এই মধুরতা, দিক সৌম্য ম্লান কান্তি
জীবনের দুঃখ দৈন্য অতৃপ্তির ‘পর
করুণকোমল আভা গভীর সুন্দর।
বীণা ফেলে দিয়ে এসো, মানসসুন্দরী—
দুটি রিক্ত হস্ত শুধু আলিঙ্গনে ভরি
কণ্ঠে জড়াইয়া দাও— মৃণাল-পরশে
রোমা’ অঙ্কুরি উঠে মর্মান্ত হরষে,
কম্পিত চঞ্চল বক্ষ, চক্ষু ছলছল,
মুগ্ধ তনু মরি যায়, অন্তর কেবল
অঙ্গের সীমান্ত-প্রান্তে উদ্ভাসিয়া উঠে,
এখনি ইন্দ্রিয়বন্ধ বুঝি টুটে টুটে।
অর্ধেক অঞ্চল পাতি বসাও যতনে
পার্শ্বে তব; সমধুর প্রিয়সম্বোধনে
ডাকো মোরে, বলো, প্রিয়, বলো, ‘প্রিয়তম’—
কুন্তল-আকুল মুখ বক্ষে রাখি মম
হৃদয়ের কানে কানে অতি মৃদু ভাষে
সংগোপনে বলে যাও যাহা মুখে আসে
অর্থহারা ভাবে-ভরা ভাষা। অয়ি প্রিয়া,
চুম্বন মাগিব যবে, ঈষৎ হাসিয়া
বাঁকায়ো না গ্রীবাখানি, ফিরায়ো না মুখ,
উজ্জ্বল রক্তিমবর্ণ সুধাপূর্ণ সুখ
রেখো ওষ্ঠাধরপুটে, ভক্ত ভৃঙ্গ তরে
সম্পূর্ণ চুম্বন এক, হাসি স্তরে স্তরে
সরস সুন্দর; নবষ্ফুট পুষ্প-সম
হেলায়ে বঙ্কিম গ্রীবা বৃন্ত নিরুপম
মুখখানি তুলে ধোরো; আনন্দ-আভায়
বড়ো বড়ো দুটি চক্ষু পল্লবপ্রচ্ছায়
রেখো মোর মুখপানে প্রশান্ত বিশ্বাসে,
নিতান্ত নির্ভরে। যদি চোখে জল আসে
কাঁদিব দুজনে; যদি ললিত কপোলে
মৃদু হাসি ভাসি উঠে, বসি মোর কোলে,
বক্ষ বাঁধি বাহুপাশে, স্কন্ধে মুখ রাখি
হাসিয়ো নীরবে অর্ধ-নিমীলিত আঁখি।
যদি কথা পড়ে মনে তবে কলস্বরে
বলে যেয়ো কথা, তরল আনন্দভরে
নির্ঝরের মতো, অর্ধেক রজনী ধরি
কত-না কাহিনী স্মৃতি কল্পনালহরী—
মধুমাখা কণ্ঠের কাকলি। যদি গান
ভালো লাগে, গেয়ো গান। যদি মুগ্ধপ্রাণ
নিঃশব্দ নিস্তব্ধ শান্ত সম্মুখে চাহিয়া
বসিয়া থাকিতে চাও, তাই রব প্রিয়া।
হেরিব অদূরে পদ্মা, উচ্চতটতলে
শ্রান্ত রূপসীর মতো বিস্তীর্ণ অঞ্চলে
প্রসারিয়া তনুখানি, সায়াহ্ন-আলোকে
শুয়ে আছে; অন্ধকার নেমে আসে চোখে
চোখের পাতার মতো; সন্ধ্যাতারা ধীরে
সন্তর্পণে করে পদার্পণ, নদীতীরে
অরণ্যশিয়রে; যামিনী শয়ন তার
দেয় বিছাইয়া, একখানি অন্ধকার
অনন্ত ভুবনে। দোঁহে মোরা রব চাহি
অপার তিমিরে; আর কোথা কিছু নাহি,
শুধু মোর করে তব করতলখানি,
শুধু অতি কাছাকাছি দুটি জনপ্রাণী,
অসীম নির্জনে; বিষণ্ন বিচ্ছেদরাশি
চরাচরে আর সব ফেলিয়াছে গ্রাসি—
শুধু এক প্রান্তে তার প্রলয় মগন
বাকি আছে একখানি শঙ্কিত মিলন,
দুটি হাত, ত্রস্ত কপোতের মতো দুটি
বক্ষ দুরুদুরু, দুই প্রাণে আছে ফুটি
শুধু একখানি ভয়, একখানি আশা,
একখানি অশ্রুভরে নম্র ভালোবাসা।
আজিকে এমনি তবে কাটিবে যামিনী
আলস্য-বিলাসে। অয়ি নিরভিমানিনী,
অয়ি মোর জীবনের প্রথম প্রেয়সী,
মোর ভাগ্য-গগনের সৌন্দর্যের শশী,
মনে আছে কবে কোন্ ফুল্ল যূথীবনে,
বহু বাল্যকালে, দেখা হত দুই জনে
আধো-চেনাশোনা? তুমি এই পৃথিবীর
প্রতিবেশিনীর মেয়ে, ধরার অস্থির
এক বালকের সাথে কী খেলা খেলাতে
সখী, আসিতে হাসিয়া, তরুণ প্রভাতে
নবীন বালিকামূর্তি, শুভ্রবস্ত্র পরি
উষার কিরণধারে সদ্য স্নান করি
বিকচ কুসুম-সম ফুল্ল মুখখানি
নিদ্রাভঙ্গে দেখা দিতে, নিয়ে যেতে টানি
উপবনে কুড়াতে শেফালি। বারে বারে
শৈশব-কর্তব্য হতে ভুলায়ে আমারে,
ফেলে দিয়ে পুঁথিপত্র, কেড়ে নিয়ে খড়ি,
দেখায়ে গোপন পথ দিতে মুক্ত করি
পাঠশালা-কারা হতে; কোথা গৃহকোণে
নিয়ে যেতে নির্জনেতে রহস্যভবনে;
জনশূন্য গৃহছাদে আকাশের তলে
কী করিতে খেলা, কী বিচিত্র কথা বলে
ভুলাতে আমারে, স্বপ্ন-সম চমৎকার
অর্থহীন, সত্য মিথ্যা তুমি জান তার।
দুটি কর্ণে দুলিত মুকুতা, দুটি করে
সোনার বলয়, দুটি কপোলের ‘পরে
খেলিত অলক, দুটি স্বচ্ছ নেত্র হতে
কাঁপিত আলোক, নির্মল নির্ঝর-স্রোতে
চূর্ণরশ্মি-সম। দোঁহে দোঁহা ভালো করে
চিনিবার আগে নিশ্চিন্ত বিশ্বাসভরে
খেলাধুলা ছুটাছুটি দুজনে সতত—
কথাবার্তা বেশবাস বিথান বিতত।
তার পরে একদিন— কী জানি সে কবে—
জীবনের বনে যৌবনবসন্তে যবে
প্রথম মলয়বায়ু ফেলেছে নিশ্বাস,
মুকুলিয়া উঠিতেছে শত নব আশ,
সহসা চকিত হয়ে আপন সংগীতে
চমকিয়া হেরিলাম— খেলা-ক্ষেত্র হতে
কখন অন্তরলক্ষ্মী এসেছ অন্তরে,
আপনার অন্তঃপুরে গৌরবের ভরে
বসি আছ মহিষীর মতো। কে তোমারে
এনেছিল বরণ করিয়া। পুরদ্বারে
কে দিয়াছে হুলুধ্বনি! ভরিয়া অঞ্চল
কে করেছে বরিষন নবপুষ্পদল
তোমার আনম্র শিরে আনন্দে আদরে!
সুন্দর সাহানা-রাগে বংশীর সুস্বরে
কী উৎসব হয়েছিল আমার জগতে,
যেদিন প্রথম তুমি পুষ্পফুল্ল পথে
লজ্জামুকুলিত মুখে রক্তিম অম্বরে
বধূ হয়ে প্রবেশিলে চিরদিনতরে
আমার অন্তর-গৃহে— যে গুপ্ত আলয়ে
অন্তর্যামী জেগে আছে সুখ দুঃখ লয়ে,
যেখানে আমার যত লজ্জা আশা ভয়
সদা কম্পমান, পরশ নাহিকো সয়
এত সুকুমার! ছিলে খেলার সঙ্গিনী
এখন হয়েছ মোর মর্মের গেহিনী,
জীবনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। কোথা সেই
অমূলক হাসি-অশ্রু, সে চাঞ্চল্য নেই,
সে বাহুল্য কথা। স্নিগ্ধ দৃষ্টি সুগম্ভীর
স্বচ্ছ নীলাম্বর-সম; হাসিখানি স্থির
অশ্রুশিশিরেতে ধৌত; পরিপূর্ণ দেহ
মঞ্জরিত বল্লরীর মতো; প্রীতি স্নেহ
গভীর সংগীততানে উঠিছে ধ্বনিয়া
স্বর্ণবীণাতন্ত্রী হতে রনিয়া রনিয়া
অনন্ত বেদনা বহি। সে অবধি প্রিয়ে,
রয়েছি বিস্মিত হয়ে—তোমারে চাহিয়ে
কোথাও না পাই অন্ত। কোন্ বিশ্বপার
আছে তব জন্মভূমি। সংগীত তোমার
কত দূরে নিয়ে যাবে, কোন্ কল্পলোকে
আমারে করিবে বন্দী গানের পুলকে
বিমুগ্ধ কুরঙ্গসম। এই যে বেদনা,
এর কোনো ভাষা আছে? এই যে বাসনা,
এর কোনো তৃপ্তি আছে? এই যে উদার
সমুদ্রের মাঝখানে হয়ে কর্ণধার
ভাসায়েছ সুন্দর তরণী, দশ দিশি
অস্ফুট কল্লোলধ্বনি চির দিবানিশি
কী কথা বলিছে কিছু নারি বুঝিবারে,
এর কোনো কূল আছে? সৌন্দর্য পাথারে
যে বেদনা-বায়ুভরে ছুটে মন-তরী
সে বাতাসে, কত বার মনে শঙ্কা করি,
ছিন্ন হয়ে গেল বুঝি হৃদয়ের পাল;
অভয় আশ্বাসভরা নয়ন বিশাল
হেরিয়া ভরসা পাই বিশ্বাস বিপুল
জাগে মনে— আছে এক মহা উপকূল
এই সৌন্দর্যের তটে, বাসনার তীরে
মোদের দোঁহের গৃহ।