- বইয়ের নামঃ সোনার তরী
- লেখকের নামঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- প্রকাশনাঃ বিশ্বসাহিত্য ভবন
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অক্ষমা
যেখানে এসেছি আমি , আমি সেথাকার ,
দরিদ্র সন্তান আমি দীন ধরণীর ।
জন্মাবধি যা পেয়েছি সুখদুঃখভার
বহু ভাগ্য বলে তাই করিয়াছি স্থির ।
অসীম ঐশ্বর্যরাশি নাই তোর হাতে ,
হে শ্যামলা সর্বসহা জননী মৃন্ময়ী ।
সকলের মুখে অন্ন চাহিস জোগাতে ,
পারিস নে কত বার — ‘কই অন্ন কই ‘
কাঁদে তোর সন্তানেরা ম্লান শুষ্ক মুখ ।
জানি মা গো , তোর হাতে অসম্পূর্ণ সুখ —
যা কিছু গড়িয়া দিস ভেঙে ভেঙে যায় ,
সব-তাতে হাত দেয় মৃত্যু সর্বভুক ,
সব আশা মিটাইতে পারিস নে হায়—
তা বলে কি ছেড়ে যাব তোর তপ্ত বুক!
অচল স্মৃতি
আমার হৃদয়ভূমি-মাঝখানে
জাগিয়া রয়েছে নিতি
অচল ধবল শৈল-সমান
একটি অচল স্মৃতি ।
প্রতিদিন ঘিরি ঘিরি
সে নীরব হিমগিরি
আমার দিবস আমার রজনী
আসিছে যেতেছে ফিরি ।
যেখানে চরণ রেখেছে সে মোর
মর্ম গভীরতম —
উন্নত শির রয়েছে তুলিয়া
সকল উচ্চে মম ।
মোর কল্পনা শত
রঙিন মেঘের মতো
তাহারে ঘেরিয়া হাসিছে কাঁদিছে ,
সোহাগে হতেছে নত ।
আমার শ্যামল তরুলতাগুলি
ফুলপল্লবভারে
সরস কোমল বাহুবেষ্টনে
বাঁধিতে চাহিছে তারে ।
শিখর গগনলীন
দুর্গম জনহীন ,
বাসনাবিহগ একেলা সেথায়
ধাইছে রাত্রিদিন ।
চারি দিকে তার কত আসা-যাওয়া ,
কত গীত , কত কথা —
মাঝখানে শুধু ধ্যানের মতন
নিশ্চল নীরবতা ।
দূরে গেলে তবু , একা
সে শিখর যায় দেখা —
চিত্তগগনে আঁকা থাকে তার
নিত্যনীহাররেখা ।
অনাদৃত
তখন তরুণ রবি প্রভাতকালে
আনিছে উষার পূজা সোনার থালে ।
সীমাহীন নীল জল
করিতেছে থলথল্ ,
রাঙা রেখা জ্বলজ্বল্
কিরণমালে ।
তখন উঠিছে রবি গগনভালে ।
গাঁথিতেছিলাম জাল বসিয়া তীরে ।
বারেক অতল-পানে চাহিনু ধীরে —
শুনিনু কাহার বাণী
পরান লইল টানি ,
যতনে সে জালখানি
তুলিয়া শিরে
ঘুরায়ে ফেলিয়া দিনু সুদূর নীরে ।
নাহি জানি কত কী যে উঠিল জালে ।
কোনোটা হাসির মতো কিরণ ঢালে ,
কোনোটা বা টলটল্
কঠিন নয়নজল ,
কোনোটা শরম-ছল
বধূর গালে —
সেদিন সাগরতীরে প্রভাতকালে ।
বেলা বেড়ে ওঠে , রবি ছাড়ি পুরবে
গগনের মাঝখানে ওঠে গরবে ।
ক্ষুধাতৃষ্ণা সব ভুলি
জাল ফেলে টেনে তুলি —
উঠিল গোধূলি-ধূলি
ধূসর নভে ,
গাভীগণ গৃহে ধায় হরষ-রবে ।
লয়ে দিবসের ভার ফিরিনু ঘরে ,
তখন উঠিছে চাঁদ আকাশ- ‘ পরে ।
গ্রামপথে নাহি লোক ,
পড়ে আছে ছায়ালোক ,
মুদে আসে দুটি চোখ
স্বপনভরে ;
ডাকিছে বিরহী পাখি কাতর স্বরে ।
সে তখন গৃহকাজ সমাধা করি
কাননে বসিয়া ছিল মালাটি পরি ।
কুসুম একটি দুটি
তরু হতে পড়ে টুটি ,
সে করিছে কুটিকুটি
নখেতে ধরি ;
আলসে আপন মনে সময় হরি ।
বারেক আগিয়ে যাই , বারেক পিছু ।
কাছে গিয়ে দাঁড়ালেম , নয়ন নিচু ।
যা ছিল চরণে রেখে
ভূমিতল দিনু ঢেকে ,
সে কহিল দেখে দেখে ,
‘ চিনি নে কিছু । ‘ —
শুনি রহিলাম শির করিয়া নিচু ।
ভাবিলাম , সারাদিন সারাটি বেলা
বসে বসে করিয়াছি কী ছেলেখেলা!
না জানি কী মোহে ভুলে
গেনু অকূলের কূলে ,
ঝাঁপ দিনু কুতূহলে —
আনিনু মেলা
অজানা সাগর হতে অজানা ঢেলা ।
যুঝি নাই , খুঁজি নাই হাটের মাঝে —
এমন হেলার ধন দেওয়া কি সাজে!
কোনো দুখ নাহি যার
কোনো তৃষা বাসনার
এ-সব লাগিবে তার
কিসের কাজে!
কুড়ায়ে লইনু পুন মনের লাজে ।
সারাটি রজনী বসি দুয়ারদেশে
একে একে ফেলে দিনু পথের শেষে ।
সুখহীন ধনহীন
চলে গেনু উদাসীন —
প্রভাতে পরের দিন
পথিকে এসে
সব তুলে নিয়ে গেল আপন দেশে ।
আকাশের চাঁদ
হাতে তুলে দাও আকাশের চাঁদ —
এই হল তার বুলি ।
দিবস রজনী যেতেছে বহিয়া ,
কাঁদে সে দু হাত তুলি ।
হাসিছে আকাশ , বহিছে বাতাস ,
পাখিরা গাহিছে সুখে ।
সকালে রাখাল চলিয়াছে মাঠে ,
বিকালে ঘরের মুখে ।
বালক বালিকা ভাই বোনে মিলে
খেলিছে আঙিনা-কোণে ,
কোলের শিশুরে হেরিয়া জননী
হাসিছে আপন মনে ।
কেহ হাটে যায় কেহ বাটে যায়
চলেছে যে যার কাজে —
কত জনরব কত কলরব
উঠিছে আকাশমাঝে ।
পথিকেরা এসে তাহারে শুধায় ,
‘ কে তুমি কাঁদিছ বসি । ‘
সে কেবল বলে নয়নের জলে ,
‘ হাতে পাই নাই শশী । ‘
সকালে বিকালে ঝরি পড়ে কোলে
অযাচিত ফুলদল ,
দখিন সমীর বুলায় ললাটে
দক্ষিণ করতল ।
প্রভাতের আলো আশিস-পরশ
করিছে তাহার দেহে ,
রজনী তাহারে বুকের আঁচলে
ঢাকিছে নীরব স্নেহে ।
কাছে আসি শিশু মাগিছে আদর
কণ্ঠ জড়ায়ে ধরি ,
পাশে আসি যুবা চাহিছে তাহারে
লইতে বন্ধু করি ।
এই পথে গৃহে কত আনাগোনা ,
কত ভালোবাসাবাসি ,
সংসারসুখ কাছে কাছে তার
কত আসে যায় ভাসি ,
মুখ ফিরাইয়া সে রহে বসিয়া ,
কহে সে নয়নজলে ,
‘ তোমাদের আমি চাহি না কারেও ,
শশী চাই করতলে । ‘
শশী যেথা ছিল সেথাই রহিল ,
সেও ব ‘ সে এক ঠাঁই ।
অবশেষে যবে জীবনের দিন
আর বেশি বাকি নাই ,
এমন সময়ে সহসা কী ভাবি
চাহিল সে মুখ ফিরে
দেখিল ধরণী শ্যামল মধুর
সুনীল সিন্ধুতীরে ।
সোনার ক্ষেত্রে কৃষাণ বসিয়া
কাটিতেছে পাকা ধান ,
ছোটো ছোটো তরী পাল তুলে যায় ,
মাঝি বসে গায় গান ।
দূরে মন্দিরে বাজিছে কাঁসর ,
বধূরা চলেছে ঘাটে ,
মেঠো পথ দিয়ে গৃহস্থ জন
আসিছে গ্রামের হাটে ।
নিশ্বাস ফেলি রহে আঁখি মেলি ,
কহে ম্রিয়মাণ মন ,
‘ শশী নাহি চাই যদি ফিরে পাই
আর বার এ জীবন । ‘