- বইয়ের নামঃ সানাই
- লেখকের নামঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- প্রকাশনাঃ বিশ্বভারতী (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অধরা
অধরা মাধুরী ধরা পড়িয়াছে
এ মোর ছন্দবন্ধনে।
বলাকাপাঁতির পিছিয়ে-পড়া ও পাখি,
বাসা সুদূরের বনের প্রাঙ্গণে।
গত ফসলের পলাশের রাঙিমারে
ধরে রাখে ওর পাখা,
ঝরা শিরীষের পেলব আভাস
ওর কাকলিতে মাখা।
শুনে যাও বিদেশিনী,
তোমার ভাষায় ওরে
ডাকো দেখি নাম ধরে।
ও জানে তোমারি দেশের আকাশ
তোমারি রাতের তারা,
তব যৌবন-উৎসবে ও যে
গানে গানে দেয় সাড়া,
ওর দুটি পাখা চঞ্চলি উঠে তব হৃৎকম্পনে।
ওর বাসাখানি তব কুঞ্জের
নিভৃত প্রাঙ্গনে।
অনাবৃষ্টি
প্রাণের সাধন কবে নিবেদন
করেছি চরণতলে,
অভিষেক তার হল না তোমার
করুণ নয়নজলে।
রসের বাদল নামিল না কেন
তাপের দিনে।
ঝরে গেল ফুল মালা পরাই নি
তোমার গলে।
মনে হয়েছিল, দেখেছি করুণা
আঁখির পাতে–
উড়ে গেল কোথা শুকনো যূথীর সাথে।
যদি এ মাটিতে চলিতে চলিতে
পড়িত তোমার দান
এ মাটি লভিত প্রাণ,
একদা গোপনে ফিরে পেতে তারে
অমৃত ফলে।
অবসান
জানি দিন অবসান হবে,
জানি তবু কিছু বাকি রবে।
রজনীতে ঘুমহারা পাখি
এক সুরে গাহিবে একাকী-
যে শুনিবে, সে রহিবে জাগি
সে জানিবে, তারি নীড়হারা
স্বপন খুঁজিছে সেই তারা
যেথা প্রাণ হয়েছে বিবাগী।
কিছু পরে করে যাবে চুপ
ছায়াঘন স্বপনের রূপ।
ঝরে যাবে আকাশকুসুম,
তখন কূজনহীন ঘুম
এক হবে রাত্রির সাথে।
যে-গান স্বপনে নিল বাসা
তার ক্ষীণ গুঞ্জন-ভাষা
শেষ হবে সব-শেষ রাতে।
আহ্বান
জ্বেলে দিয়ে যাও সন্ধ্যাপ্রদীপ
বিজন ঘরের কোণে।
নামিল শ্রাবণ, কালো ছায়া তার
ঘনাইল বনে বনে।
বিস্ময় আনো ব্যগ্র হিয়ার পরশ-প্রতীক্ষায়
সজল পবনে নীল বসনের চঞ্চল কিনারায়,
দুয়ার-বাহির হতে আজি ক্ষণে ক্ষণে
তব কবরীর কবরীমালার বারতা আসুক মনে।
বাতায়ন হতে উৎসুক উই আঁখি
তব মঞ্জীর-ধ্বনি পথ বেয়ে
তোমারে কি যায় ডাকি।
কম্পিত এই মোর বক্ষের ব্যথা
অলকে তোমার আনে কি চঞ্চলতা
বকুলবনের মুখরিত সমীরণে।
উদ্বৃত্ত
তব দক্ষিণ হাতের পরশ
কর নি সমর্পণ।
লেকে আর মোছে তব আলো ছায়া
ভাবনার প্রাঙ্গণে
খনে খনে আলিপন।
বৈশাখে কৃশ নদী
পূর্ণ স্রোতের প্রসাদ না দিল যদি
শুধু কুণ্ঠিত বিশীর্ণ ধারা
তীরের প্রান্তে
জাগালো পিয়াসী মন।
যতটুকু পাই ভীরু বাসনার
অঞ্জলিতে
নাই বা উচ্ছলিল,
সারা দিবসের দৈন্যের শেসে
সঞ্চয় সে যে
সারা জীবনের স্বপ্নের আয়োজন।
কৃপণা
এসেছিনু দ্বারে ঘনবর্ষণ রাতে,
প্রদীপ নিবালে কেন অঞ্চলাঘাতে।
কালো ছায়াখানি মনে পড়ে গেল আঁকা,
বিমুখ মুখের ছবি অন্তরে ঢাকা,
কলঙ্করেখা যেন
চিরদিন চাঁদ বহি চলে সাথে সাথে।
কেন বাধা হল দিতে মাধুরীর কণা
হায় হায়, হে কৃপণ্য।
তব যৌবন-মাঝে
লাবণ্য বিরাজে,
লিপিখানি তার নিয়ে এসে তবু
কেন যে দিলে না হাতে।
গান
যে ছিল আমার স্বপনচারিণী
এতদিন তারে বুঝিতে পারি নি,
দিন চলে গেছে খুঁজিতে।
শুভক্ষণে কাছে ডাকিলে,
লজ্জা আমার ঢাকিলে,
তোমারে পেরেছি বুঝিতে।
কে মোরে ফিরাবে অনাদরে,
কে মোরে ডাকিবে কাচে,
কাহার প্রেমের বেদনার মাঝে
আমার মূল্য আছে,
এ নিরন্তর সংশয়ে আর
পারি না কেবলি যুঝিতে–
তোমারেই শুধু সত্য পেরেছি বুঝিতে।
গানের খেয়া
যে গান আমি গাই
জানি নে সে
কার উদ্দেশে।
যবে জাগে মনে
অকারণে
চপল হাওয়া
সুর যায় ভেসে
কার উদ্দেশে।
ঐ মুখে চেয়ে দেখি,
জানি নে তুমিই সে কি
অতীত কালের মুরতি এসেছ
নতুন কালের বেশে।
কভূ জাগে মনে,
যে আসে নি এ জীবনে
ঘাট খুঁজি খুঁজি
গানের খেয়া সে মাগিতেছে বুঝি
আমার তীরেতে এসে।
গানের জাল
দৈবে তুমি
কখন নেশায় পেয়ে
আপন-মনে
যাও চলে গান গেয়ে।
যে আকাশের সুরের লেখা লেখ
বুঝি না তা, কেবল রহি চেয়ে।
হৃদয় আমার অদৃশ্যে যায় চলে,
প্রতিদিনের ঠিকঠিকানা ভোলে-
মৌমাছিরা আপনা হারায় যেন
গন্ধের পথ বেয়ে।
গানের টানা জালে
নিমেষ-ঘেরা বাঁধন হাতে
টানে অসীম কালে।
মাটির আড়ালে করি ভেদন
স্বর্গলোকের আনে বেদন,
পরান ফেলে ছেয়ে।
ছায়াছবি
আমার প্রিয়ার সচল ছায়াছরি
সজল নীলাকাশে।
আমার প্রিয়া মেঘের ফাঁকে ফাঁকে
সন্ধ্যাতারায় লুকিয়ে দেখে কাকে,
সন্ধ্যাদীপের লুপ্ত আলো স্মরণে তার ভাসে।
বারিঝরা বনের গন্ধ নিয়া
পরশহারা বরণমালা গাঁথে আমার প্রিয়া।
আমার প্রিয়া ঘন শ্রাবণধারায়
আকাশ ছেয়ে মনের কথা হারায়,
আমার প্রিয়ার আঁচল দোলে
নিবিড় বনের শ্যামল উচ্ছ্বাসে।
দ্বিধা
এসেছিলু তবু আস নাই, তাই
জানায়ে গেলে
সমুখের পথে পলাতকা পদ-পতন ফেলে।
তোমার সে উদাসীনতা
উপহাসভরে জানালো কি মোর দীনতা।
সে কি ছল-করা অবহেলা, জানি না সে–
চপল চরণ সত্য কি ঘাসে ঘাসে
গেল উপেক্ষা মেলে।
পাতায় পাতায় ফোঁটা ফোঁটা ঝরে জল,
ছলছল করে শ্যাম বনান্ততল।
তুমি কোথা দুরে কুঞ্জছায়াতে
মিলে গেলে কলমুখর মায়াতে,
পিছে পিছে তব ছায়ারৌদ্রের
খেলা গেলে তুমি খেলে।