মহাছন্দে বাঁধা হয়ে যুগ যুগ যুগ যুগান্তর
পড়িল নিয়ম-পাঠশালে
অসীম জগৎ-চরাচর।
শ্রান্ত হয়ে এল কলেবর,
নিদ্রা আসে নয়নে তাহার,
আকর্ষণ হতেছে শিথিল,
উত্তাপ হতেছে একাকার।
জগতের প্রাণ হতে
উঠিল রে বিলাপসংগীত,
কাঁদিয়া উঠিল চারি ভিত ।
পুরবে বিলাপ উঠে, পশ্চিমে বিলাপ উঠে,
কাঁদিল রে উত্তর দক্ষিণ,
কাঁদে গ্রহ, কাঁদে তারা, শ্রান্তদেহে কাঁদে রবি–
জগৎ হইল শান্তিহীন।
চারি দিক হতে উঠিতেছে
আকুল বিশ্বের কণ্ঠস্বর,
‘‘জাগো জাগো জাগো মহাদেব,
কবে মোরা পাব অবসর?
অলঙ্ঘ্য নিয়মপথে ভ্রমি
হয়েছে হে শ্রান্ত কলেবর।
নিয়মের পাঠ সমাপিয়া
সাধ গেছে খেলা করিবারে,
একবার ছেড়ে দাও, দেব,
অনন্ত এ আকাশ-মাঝারে।’’
জগতের আত্মা কহে কাঁদি,
‘‘আমারে নূতন দেহ দাও–
প্রতিদিন বাড়িছে হৃদয়,
প্রতিদিন বাড়িতেছে আশা,
প্রতিদিন টুটিতেছে দেহ,
প্রতিদিন ভাঙিতেছে বল।
গাও দেব মরণসংগীত
পাব মোরা নূতন জীবন।’’
জগৎ কাঁদিল উচ্চরবে
জাগিয়া উঠিল মহেশ্বর,
তিন কাল ত্রিনয়ন মেলি,
হেরিলেন দিক দিগন্তর।
প্রলয়বিষাণ তুলি করে ধরিলেন শূলী,
পদতলে জগৎ চাপিয়া,
জগতের আদি অন্ত থরথর থরথর
একবার উঠিল কাঁপিয়া।
বিষাণেতে পুরিলা নিশ্বাস,
ছিঁড়িয়া পড়িয়া গেল
জগতের সমস্ত বাঁধন।
উঠিল রে মহাশূন্যে গরজিয়া তরঙ্গিয়া
ছন্দোমুক্ত জগতের উন্মত্ত আনন্দকোলাহল।
ছিঁড়ে গেল রবি শশী গ্রহ তারা ধূমকেতু,
কে কোথায় ছুটে গেল,
ভেঙে গেল, টুটে গেল,
চন্দ্রে সূর্যে গুঁড়াইয়া
চূর্ণ চূর্ণ হয়ে গেল।
মহা অগ্নি জ্বলিল রে,
আকাশের অনন্ত হৃদয়
অগ্নি, অগ্নি, শুধু অগ্নিময়।
মহা অগ্নি উঠিল জ্বলিয়া
জগতের মহা চিতানল।
খণ্ড খণ্ড রবি শশী, চূর্ণ চূর্ণ গ্রহ তারা
বিন্দু বিন্দু আঁধারের মতো
বরষিছে চারি দিক হতে,
অনলের তেজোময় গ্রাসে
নিমেষেতে যেতেছে মিশায়ে।
সৃজনের আরম্ভসময়ে
আছিল অনাদি অন্ধকার,
সৃজনের ধ্বংসযুগান্তরে
রহিল অসীম হুতাশন।
অনন্ত আকাশগ্রাসী অনলসমুদ্রমাঝে
মহাদেব মুদি ত্রিনয়ান
করিতে লাগিলা মহাধ্যান।
স্নেহ উপহার
শ্রীমতী ইন্দিরা প্রাণাধিকাসু।
বাব্লা।
আয় রে বাছা কোলে বসে চা ‘ মোর মুখ – পানে ,
হাসিখুশি প্রাণখানি তোর প্রভাত ডেকে আনে।
আমার দেখে আসিস ছুটে , আমায় বাসিস ভালো ,
কোথা হতে পড়লি প্রাণে তুই রে উষার আলো।
দেখ্ রে প্রাণে স্নেহের মতো সাদা সাদা জুঁই ফুটেছে।
দেখ্ রে , আমার গানের সাথে ফুলের গন্ধ জড়িয়ে গেছে।
গেথেছি রে গানের মালা , ভোরের বেলা বনে এসে
মনে বড়ো সাধ হয়েছে পরাব তোর এলোকেশে।
গানের সাথে ফুলের সাথে মুখখানি মানাবে ভালো ,
আয় রে তবে আয় রে মেয়ে দেখ্ রে চেয়ে রাত পোহালো।
কচিমুখটি ঘিরে দেব ললিতরাগিণী দিয়ে ,
বাপের কাছে মায়ের কাছে দেখিয়ে আসবি ছুটে গিয়ে।
চাঁদনি রাতে বেড়াই ছাতে মুখখানি তোর মনে পড়ে ,
তোর কথাটাই কিলিবিলি মনের মধ্যে নড়েচড়ে।
হাসি হাসি মুখখানি তোর ভেসে ভেসে বেড়ায় কাছে ,
হাসি যেন এগিয়ে এল , মুখটি যেন পিছিয়ে আছে।
কচি প্রাণের আনন্দ তোর ভাঙা বুকে দে ছড়িয়ে ,
ছোটো দুটি হাত দিয়ে তোর গলাটি মোর ধর জড়িয়ে।
বিজন প্রাণের দ্বারে বসে করবি রে তুই ছেলেখেলা ,
চুপ করে তাই বসে বসে দেখব আমি সন্ধেবেলা।
কোথায় আছিস , সাড়া দে রে , বুকের কাছে আয় রে তবে ,
তোর মুখেতে গানগুলি মোর কেমন শোনায় শুনতে হবে।
আমি যেন দাঁড়িয়ে আছি একটা বাবলা গাছের মতো
বড়ো বড়ো কাঁটার ভয়ে তফাত থাকে লতা যত।
সকাল হলে মনের সুখে ডালে ডালে ডাকে পাখি ,
আমার কাঁটা – ডালে কেউ ডাকে না চুপ করে তাই দাঁড়িয়ে থাকি !
নেই বা লতা এল কাছে , নেই বা পাখি বসল শাখে ,
যদি আমার বুকের কাছে বাবলা ফুলটি ফুটে থাকে।
বাতাসেতে দুলে দুলে ছড়িয়ে দেয় রে মিষ্টি হাসি ,
কাঁটা – জন্ম ভুলে গিয়ে তাই দেখে হরষে ভাসি !
দূর কর ছাই , ঝোঁকের মাথায় বলে ফেললাম কত কী যে ?
কথাগুলো ঠেকছে যেন চোখের জলে ভিজে ভিজে !
স্রোত
জগৎ-স্রোতে ভেসে চলো, যে যেথা আছ ভাই!
চলেছে যেথা রবি শশী চল্ রে সেথা যাই।
কোথায় চলে কে জানে তা, কোথায় যাবে শেষে,
জগৎ-স্রোত বহে গিয়ে কোন্ সাগরে মেশে।
অনাদি কাল চলে স্রোত অসীম আকাশেতে,
উঠেছে মহা কলরব অসীমে যেতে যেতে।
উঠিছে ঢেউ, পড়ে ঢেউ, গনিবে কেবা কত!
ভাসিছে শত গ্রহ তারা, ডুবিছে শত শত।
ঢেউয়ের ‘পরে খেলা করে আলোকে আঁধারেতে,
জলের কোলে লুকাচুরি জীবনে মরণেতে।
শতেক কোটি গ্রহ তারা যে স্রোতে তৃণপ্রায়
সে স্রোত-মাঝে অবহেলে ঢালিয়া দিব কায়,
অসীম কাল ভেসে যাব অসীম আকাশেতে,
জগৎ- কলকলরব শুনিব কান পেতে।
দেখিব ঢেউ–উঠে ঢেউ, দেখিব মিশে যায়,
জীবন-মাঝে উঠে ঢেউ মরণ-গান গায়।
দেখিব চেয়ে চারি দিকে, দেখিব তুলে মুখ–
কত-না আশা, কত হাসি, কত-না সুখ দুখ,
বিরাগ দ্বেষ ভালোবাসা, কত-না হায়-হায়–
তপন ভাসে, তারা ভাসে, তা’রাও ভেসে যায়।
কত-না যায়, কত চায়, কত-না কাঁদে হাসে–
আমি তো শুধু ভেসে যাব, দেখিব চারি পাশে।
অবোধ ওরে, কেন মিছে করিস ‘আমি আমি’।
উজানে যেতে পারিবি কি সাগরপথগামী?
জগৎ-পানে যাবি নে রে, আপনা-পানে যাবি–
সে যে রে মহামরুভূমি, কী জানি কী যে পাবি।
মাথায় করে আপনারে, সুখ-দুখের বোঝা,
ভাসাতে চাস প্রতিকূলে– সে তো রে নহে সোজা ।
অবশ দেহ, ক্ষীণ বল, সঘনে বহে শ্বাস,
লইয়া তোর সুখ-দুখ এখনি পাবি নাশ।
জগৎ হয়ে রব আমি, একেলা রহিব না।
মরিয়া যাব একা হলে একটি জলকণা।
আমার নাহি সুখ দুখ, পরের পানে চাই–
যাহার পানে চেয়ে দেখি তাহাই হয়ে যাই।
তপন ভাসে, তারা ভাসে, আমিও যাই ভেসে–
তাদের গানে আমার গান, যেতেছি এক দেশে।
প্রভাত সাথে গাহি গান, সাঁঝের সাথে গাই,
তারার সাথে উঠি আমি–তারার সাথে যাই।
ফুলের সাথে ফুটি আমি, লতার সাথে নাচি,
বায়ুর সাথে ঘুরি শুধু ফুলের কাছাকাছি।
মায়ের প্রাণে স্নেহ হয়ে শিশুর পানে ধাই,
দুখীর সাথে কাঁদি আমি সুখীর সাথে গাই।
সবার সাথে আছি আমি, আমার সাথে নাই,
জগৎ-স্রোতে দিবানিশি ভাসিয়া চলে যাই।