মহাস্বপ্ন
পূর্ণ করি মহাকাল পূর্ণ করি অনন্ত গগন,
নিদ্রামগ্ন মহাদেব দেখিছেন মহান্ স্বপন্।
বিশাল জগৎ এই প্রকাণ্ড স্বপন সেই,
হৃদয়সমুদ্রে তাঁর উঠিতেছে বিম্বের মতন।
উঠিতেছে চন্দ্র সূর্য, উঠিতেছে আলোক আঁধার,
উঠিতেছে লক্ষ লক্ষ নক্ষত্রের জ্যোতি-পরিবার।
উঠিতেছে, ছুটিতেছে গ্রহ উপগ্রহ দলে দলে,
উঠিতেছে ডুবিতেছে রাত্রি দিন, আকাশের তলে ।
একা বসি মহাসিন্ধু চিরদিন গাইতেছে গান,
ছুটিয়া সহস্র নদী পদতলে মিলাইছে প্রাণ।
তটিনীর কলরব, লক্ষ নির্ঝরের ঝর ঝর,
সিন্ধুর গম্ভীর গীত, মেঘের গম্ভীর কণ্ঠস্বর,
ঝটিকা করিছে হা হা আশ্রয়-আলয় তার ছাড়ি
বাজায়ে অরণ্যবীণা ভীমবল শত বাহু নাড়ি,
রুদ্র রাগ আলাপিয়া গড়ায়ে পড়িছে হিমরাশ
পর্বতদৈত্যের যেন ঘনীভূত ঘোর অট্টহাস,
ধীরে ধীরে মহারণ্য নাড়িতেছে জটাময় মাথা–
ঝর ঝর মর মর উঠিতেছে সুগম্ভীর গাথা।
চেতনার কোলাহলে দিবস পুরিছে দশ দিশি,
ঝিল্লিরবে একমন্ত্র জপিতেছে তাপসিনী নিশি,
সমস্ত একত্রে মিলি ধ্বনিয়া ধ্বনিয়া চারি ভিত
উঠাইছে মহা-হৃদে মহা এক স্বপনসংগীত।
স্বপনের রাজ্য এই স্বপন-রাজ্যের জীবগণ
দেহ ধরিতেছে কত মুহুর্মুহু নূতন নূতন।
ফুল হয়ে যায় ফল, ফুল ফল বীজ হয় শেষে,
নব নব বৃক্ষ হয়ে বেঁচে থাকে কানন-প্রদেশে।
বাষ্প হয়, মেঘ হয়, বিন্দু বিন্দু বৃষ্টিবারিধারা
নির্ঝর তটিনী হয়, ভাঙি ফেলে শিলাময় কারা।
নিদাঘ মরিয়া যায়, বরষা শ্মশানে আসি তার
নিবায় জলন্ত চিতা বরষিয়া অশ্রুবারিধার।
বরষা হইয়া বৃদ্ধ শ্বেতকেশ শীত হয়ে যায়,
যযাতির মতো পুন বসন্তযৌবন ফিরে পায়।
এক শুধু পুরাতন, আর সব নূতন নূতন
এক পুরাতন হৃদে উঠিতেছে নূতন স্বপন।
অপূর্ণ স্বপন-সৃষ্ট মানুষেরা অভাবের দাস,
জাগ্রত পূর্ণতা-তরে পাইতেছে কত না প্রয়াস।
চেতনা ছিঁড়িতে চাহে আধো-অচেতন আবরণ–
দিনরাত্রি এই আশা, এই তার একমাত্র পণ।
পূর্ণ আত্মা জাগিবেন, কভু কি আসিবে হেন দিন?
অপূর্ণ জগৎ-স্বপ্ন ধীরে ধীরে হইবে বিলীন?
চন্দ্র-সূর্য-তারকার অন্ধকার স্বপ্নময়ী ছায়া
জ্যোতির্ময় সে হৃদয়ে ধীরে ধীরে মিলাইবে কায়া।
পৃথিবী ভাঙিয়া যাবে, একে একে গ্রহতারাগণ
ভেঙে ভেঙে মিলে যাবে একেকটি বিম্বের মতন।
চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ চেয়ে জ্যোতির্ময় মহান্ বৃহৎ
জীব-আত্মা মিলাইবে একেকটি জলবিম্ববৎ।
কভু কি আসিবে, দেব, সেই মহাস্বপ্ন-ভাঙা দিন
সত্যের সমুদ্র-মাঝে আধো সত্য হয়ে যাবে লীন?
আধেক প্রলয়জলে ডুবে আছে তোমার হৃদয়–
বলো, দেব, কবে হেন প্রলয়ের হইবে প্রলয়।
শরতে প্রকৃতি
কই গো প্রকৃতি রানী , দেখি দেখি মুখখানি ,
কেন গো বিষাদছায়া রয়েছে অধর ছুঁয়ে
মুখখানি মলিন কেন গো ?
এই যে মুহূর্ত আগে হাসিতে ছিলে গো দেখি
পলক না পালটিতে সহসা নেহারি এ কি—
মরনে বিলীন যেন গো !
কেন তনুখানি ঢাকা শুভ্র কুহেলিকা বাসে
মৃদু বিষাদের ভারে সুধীরে মুদিয়া আসে
নয়ন – নলিন হেন গো ?
ওই দেখো চেয়ে দেখো—একবার চেয়ে দেখো—
চাঁদের অধর দুটি হাসিতে ভাসিয়া যায়।
নিশীথের প্রাণে গিয়া সে হাসি মিশিয়া যায়।
সে হাসির কোলে বসি কানন – গোলাপগুলি
আধো আধো কথা কহে সোহাগেতে দুলি দুলি।
সে – হাসির পায়ে পড়ি নদীর লহরীগন
যার যত কথা আছে বলিতে আকুল মন।
সে হাসির শিশুদুটি লতিকামন্ডপে গিয়া
আঁধারে ভাবিয়া সারা বাহিরিবে কোথা দিয়ে
সে – হাসি অলসে ঢলি দিগন্তে পড়িয়া নুয়ে ,
মেঘের অধরপ্রান্ত একটু রয়েছে ছুঁয়ে।
বলো তুমি কেন তবে
এমন মলিন রবে ?
বিষাদ – স্বপন দেখে হাসির কোলেতে শুয়ে।
ঘোমটাটি খোলো খোলো
মুখখানি তোলো তোলো
চাঁদের মুখের পানে চাও একবার।
বলো দেখি কারে হেরি এত হাসি তার !
নিলাজ বসন্ত যবে কুসুমে কুসুমময়
মাতিয়া নিজের রূপে হাসিয়া আকুল হয় ,
মলয় মরমে মরি ,
ফিরে হাহাকার করি—
বনের হৃদয় হতে সৌরভ – উচ্ছাস বয় !
তারে হেরি হয় না সে এমন হরষে ভোর ;
কী চোখে দেখেছে চাঁদ ওই মুখখানি তোর !
তুই তবু কেন কেন
দারুন বিরাগে যেন
চাস নে চা চাঁদের হাসি চাঁদের আদর !
নাই তোর ফুলবাস
নাইক প্রেমের হাস ,
পাপিয়া আড়ালে বসি শুনায় না প্রেম গান !
কী দুখেতে উদাসীনি
যৌবনেতে সন্ন্যাসিনী !
কাহার ধেয়ানে মগ্ন শুভ্র বস্ত্র পরিধান ?
এক – কালে ছিল তোর কুসুমিত মধুমাস—
হৃদয়ে ফুটিত তোর অজস্র ফুলের রাশ ;
যৌবন – উচ্ছাসে ভোর
প্রাণের সুরভি তোর
পথিক সমীরে সব দিলি তুই বিলাইয়া !
শেষে গ্রীষ্মতাপে জ্বলি
শুকাইল ফুল – কলি ,
সর্বস্ব যাহারে দিলি সেও গেল পলাইয়া !
চেতনা পাইয়া শেষে হইয়া সর্বস্ব – হারা
সারাটি বরষা তুই কাঁদিয়া হইলি সারা !
এত দিন পরে বুঝি শুকাইল অশ্রুধারা !
আজ বুঝি মনে মনে করিলি দারুন পণ
যোগিনী হইবি তুই পাষাণে বাঁধিয়া মন !
বসন্তের ছেলেখেলা ভালো নাহি লাগে আর—
চপল চঞ্চল হাসি ফুলময় অলংকার !
এখন যে হাসি হাসো আজি বিরাগের দিন ,
শুভ্র শান্ত সুবিমল বাসনা – লালসাহীন।
এত করিলি পণ
তবুও তো ক্ষণে ক্ষণ
সে দিনের স্মৃতিছায়া হৃদয়ে বেড়ায় ভাসি।
প্রশান্ত মুখের ‘ পরে
কুহেলিকা ছায়া পড়ে—
ভাবনায় মেঘ উঠে সহসা আলোক নাশি—
মুহূর্তে কিসের লাগি
আবার উঠিস জাগি
আবার অধরে ফুটে সেই সে পুরানো হাসি !
ঘুমায়ে পড়িস যবে বিহ্বল রজনীশেষে ,
অতি মৃদু পা টিপিয়া উষা আসে হেসে হেসে ,
অতিশয় সাবধানে দুইটি আঙুল দিয়া
কুয়াশা – ঘোমটা তোর দেয় ধীরে সরাইয়া।
অমনি তরুণ রবি পাশে আসি মৃদুগতি
মুদিত নয়ন তোর চুমে ধীরে ধীরে অতি !
শিহরিয়া কাঁপি উঠি
মেলিস নয়ন দুটি ,
রাঙা হয়ে ওঠে তোর কপোল – কুসুমদল
শরমে আকুল ঝরে শিশির – নয়নজল !
সুদুর আলয় হতে তাড়াতাড়ি খেলা ভুলি
মাঝে মাঝে ছুটে আসে দুদন্ডের মেঘগুলি।
চমকি দাঁড়ায়ে থাকে , ওই মুখপানে চায় ,
কাঁদিয়া কাঁদিয়া শেষে কাঁদিয়া মরিয়া যায় !
কিসের বিরাগ এত , কী তপে আছিস ভোর !
এত করে সেধে সেধে
এত করে কেঁদে কেঁদে
যোগিনী , কিছুতে তবু ভাঙিবে না পণ তোর ?
যোগিনী , কিছুতে কি রে ফিরিবে না মন তোর ?