মঞ্জুলিকা বাপের সেবায় লাগল দ্বিগুণ ক ‘ রে
অষ্টপ্রহর ধরে ।
আবশ্যকটা সারা হলে তখন লাগে অনাবশ্যক কাজে ,
যে-বাসনটা মাজা হল আবার সেটা মাজে ।
দু-তিন ঘন্টা পর
একবার যে-ঘর ঝেড়েছে ফের ঝাড়ে সেই ঘর ।
কখন যে স্নান , কখন যে তার আহার ,
ঠিক ছিল না তাহার ।
কাজের কামাই ছিল নাকো যতক্ষণ না রাত্রি এগারোটায়
শ্রান্ত হয়ে আপনি ঘুমে মেঝের ‘ পরে লোটায় ।
যে দেখল সে-ই অবাক হয়ে রইল চেয়ে ,
বললে , “ ধন্যি মেয়ে । ”
বাপ শুনে কয় বুক ফুলিয়ে , “ গর্ব করি নেকো ,
কিন্তু তবু আমার মেয়ে সেটা স্মরণ রেখো ।
ব্রহ্ম চর্য- ব্রত
আমার কাছেই শিক্ষা যে ওর । নইলে দেখতে অন্যরকম হত ।
আজকালকার দিনে
সংযমের ই কঠোর সাধন বিনে
সমাজেতে রয় না কোনো বাঁধ ,
মেয়েরা তাই শিখছে কেবল বিবিয়ানার ছাঁদ । ”
স্ত্রীর মরণের পরে যবে
সবেমাত্র এগারো মাস হবে ,
গুজব গেল শোনা
এই বাড়িতে ঘটক করে আনাগোনা ।
প্রথম শুনে মঞ্জুলিকার হয় নিকো বিশ্বাস ,
তার পরে সব রকম দেখে ছাড়লে সে নিশ্বাস ।
ব্যস্ত সবাই , কেমনতরো ভাব
আসছে ঘরে নানা রকম বিলিতি আসবাব ।
দেখলে বাপের নতুন করে সাজসজ্জা শুরু ,
হঠাৎ কালো ভ্রমরকৃষ্ণ ভুরু ,
পাকাচুল সব কখন হল কটা ,
চাদরেতে যখন-তখন গন্ধ মাখার ঘটা ।
মার কথা আজ মঞ্জুলিকার পড়ল মনে
বুক – ভাঙা এক বিষম ব্যথার সনে ।
হো ক না মৃত্যু , তবু
এ-বাড়ির এই হাওয়ার সঙ্গে বিরহ তাঁর ঘটে নাই তো কভু ।
কল্যাণী সেই মূর্তিখানি সুধামাখা
এ সংসারের মর্মে ছিল আঁকা ;
সাধ্বীর সেই সাধনপুণ্য ছিল ঘরের মাঝে ,
তাঁরি পরশ ছিল সকল কাজে ।
এ সংসারে তাঁর হবে আজ পরম মৃত্যু , বিষম অপমান —
সেই ভেবে যে মঞ্জুলিকার ভেঙে পড়ল প্রাণ ।
ছেড়ে লজ্জাভয়
কন্যা তখন নিঃসংকোচে কয়
বাপের কাছে গিয়ে ,—
“ তুমি নাকি করতে যাবে বিয়ে ।
আমরা তোমার ছেলেমেয়ে নাতনী-নাতি যত
সবার মাথা করবে নত ?
মায়ের কথা ভুলবে তবে ?
তোমার প্রাণ কি এত কঠিন হবে । ”
বাবা বললে শুষ্ক হাসে ,
“ কঠিন আমি কেই বা জানে না সে ?
আমার পক্ষে বিয়ে করা বিষম কঠোর কর্ম ,
কিন্তু গৃহধর্ম
স্ত্রী না হলে অপূর্ণ যে রয়
মনু হতে মহাভারত সকল শাস্ত্রে কয় ।
সহজ তো নয় ধর্মপথে হাঁটা ,
এ তো কেবল হৃদয় নিয়ে নয়কো কাঁদাকাটা ।
যে করে ভয় দুঃখ নিতে , দুঃখ দিতে ,
সে কাপুরুষ কেনই আসে পৃথিবীতে । ”
বাখরগঞ্জে মেয়ের বাপের ঘর ।
সেথায় গেলেন বর
বিয়ের কদিন আগে , বৌকে নিয়ে শেষে
যখন ফিরে এলেন দেশে
ঘরেতে নেই মঞ্জুলিকা । খবর পেলেন চিঠি পড়ে ,
পুলিন তাকে বিয়ে করে
গেছে দোঁহা ফরাক্কাবাদ চলে ,
সেইখানেতে ই ঘর পাতবে ব ‘ লে ।
আগুন হয়ে বাপ
বারে বারে দিলেন অভিশাপ ।
পলাতকা
ওই যেখানে শিরীষ গাছে
ঝুরু-ঝুরু কচি পাতার নাচে
ঘাসের ‘ পরে ছায়াখানি কাঁপায় থরথর
ঝরা ফুলের গন্ধে ভরভর —
ওই খানে মোর পোষা হরিণ চরত আপন মনে
হেনা-বেড়ার কোণে
শীতের রোদে সারা সকালবেলা ।
তার ই সঙ্গে করত খেলা
পাহাড়-থেকে-আনা
ঘন রাঙা রোঁয়ায় ঢাকা একটি কুকুর – ছানা ।
যেন তারা দুই বিদেশের দুটি ছেলে
মিলেছে এক পাঠশালাতে , একসাথে তাই বেড়ায় হেসে খেলে ।
হাটের দিনে পথের কত লোকে
বেড়ার কাছে দাঁড়িয়ে যেত , দেখত অবাক-চোখে ।
ফাগুন মাসে জাগল পাগল দখিন হাওয়া ,
শিউরে ওঠে আকাশ যেন কোন্ প্রেমিকের রঙিন-চিঠি-পাওয়া ।
শালের বনে ফুলের মাতন হল শুরু ,
পাতায় পাতায় ঘাসে ঘাসে লাগল কাঁপন দুরুদুরু ।
হরিণ যে কার উদাস-করা বাণী
হঠাৎ কখন শুনতে পেলে আমরা তা কি জানি ।
তাই যে কালো চোখের কোণে
চাউনি তাহার উতল হল অকারণে ;
তাই সে থেকে থেকে
হঠাৎ আপন ছায়া দেখে
চমকে দাঁড়ায় বেঁকে ।
একদা এক বিকালবেলায়
আমলকীবন অধীর যখন ঝিকিমিকি আলোর খেলায় ,
তপ্ত হাওয়া ব্যথিয়ে ওঠে আমের বোলের বাসে ,
মাঠের পরে মাঠ হয়ে পার ছুটল হরিণ নিরুদ্দেশের আশে ।
সম্মুখে তার জীবনমরণ সকল একাকার ,
অজানিতের ভয় কিছু নেই আর ।
ভেবেছিলেম , আঁধার হলে পরে
ফিরবে ঘরে
চেনা হাতের আদর পাবার তরে ।
কুকুর – ছানা বারে বারে এসে
কাছে ঘেঁষে ঘেঁষে
কেঁদে-কেঁদে চোখের চাওয়ায় শুধায় জনে জনে ,
‘ কোথায় গেল , কোথায় গেল , কেন তারে না দেখি অঙ্গনে । ‘
আহার ত্যেজে বেড়ায় সে যে , এল না তার সাথি ।
আঁধার হল , জ্বলল ঘরে বাতি ;
উঠল তারা ; মাঠে-মাঠে নামল নীরব রাতি ।
আতুর চোখের প্রশ্ন নিয়ে ফেরে কুকুর বাইরে ঘরে ,
‘ নাই সে কেন , যায় কেন সে , কাহার তরে । ‘
কেন যে তা সে-ই কি জানে । গেছে সে যার ডাকে
কোনো কালে দেখে নাই যে তাকে ।
আকাশ হতে , আলোক হতে , নতুন পাতার কাঁচা সবুজ হতে
দিশাহারা দখিন হাওয়ার স্রোতে
রক্তে তাহার কেমন এলোমেলো
কিসের খবর এল ।
বুকে যে তার বাজল বাঁশি বহুযুগের ফাগুন-দিনের সুরে —
কোথায় অনেক দূরে
রয়েছে তার আপন চেয়ে আরো আপন জন ।
তারেই অন্বেষণ ।
জন্ম হতে আছে যেন মর্মে তারি লেগে ,
আছে যেন ছুটে চলার বেগে ,
আছে যেন চল-চপল চোখের কোণে জেগে ।
কোনো কালে চেনে নাই সে যারে
সেই তো তাহার চেনাশোনার খেলাধুলা ঘোচায় একেবারে ।
আঁধার তারে ডাক দিয়েছে কেঁদে ,
আলোক তারে রাখল না আর বেঁধে ।