মেয়ের নীরব মুখে
কী দেখে মা , শেল বাজে তার বুকে ।
না-বলা কোন্ গোপন কথার মায়া
মঞ্জুলিকার কালো চোখে ঘনিয়ে তোলে জলভরা এক ছায়া ;
অশ্রু-ভেজা গভীর প্রাণের ব্যথা
এনে দিল অধরে তার শরৎনিশির স্তব্ধ ব্যাকুলতা ।
মায়ের মুখে অন্ন রোচে নাকো —
কেঁদে বলে , “ হায় ভগবান , অভাগীরে ফেলে কোথায় থাক ো । ”
একদা বাপ দুপুরবেলায় ভোজন সাঙ্গ করে
গুড়গুড়িটার নলটা মুখে ধরে ,
ঘুমের আগে , যেমন চিরাভ্যাস ,
পড়তেছিলেন ইংরেজি এক প্রেমের উপন্যাস ।
মা বললেন , বাতাস করে গায়ে ,
কখনো বা হাত বুলিয়ে পায়ে ,
“ যার খুশি সে নিন্দে করুক , মরুক বিষে জ্বরে
আমি কিন্তু পারি যেমন করে
মঞ্জুলিকার দেবই দেব বিয়ে । ”
বাপ বললেন , কঠিন হেসে , “ তোমরা মায়ে ঝিয়ে
এক লগ্নেই বিয়ে কো রো আমার মরার পরে ,
সেই কটা দিন থাকো ধৈর্য ধরে । ”
এই বলে তাঁর গুড়গুড়িতে দিলেন মৃদু টান ।
মা বললেন , “ উঃ কী পাষাণ প্রাণ ,
স্নেহমায়া কিচ্ছু কি নেই ঘটে । ”
বাপ বললেন , “ আমি পাষাণ বটে ।
ধর্মের পথ কঠিন বড়ো , ননির পুতুল হলে
এতদিনে কেঁদেই যেতেম গলে । ”
মা বললেন , “ হায় রে কপাল । বোঝাবই বা কারে ।
তোমার এ সংসারে
ভরা ভোগের মধ্যখানে দুয়ার এঁটে
পলে পলে শুকিয়ে মরবে ছাতি ফেটে
একলা কেবল একটুকু ওই মেয়ে ,
ত্রিভুবনে অধর্ম আর নেই কিছু এর চেয়ে ।
তোমার পুঁথির শুকনো পাতায় নেই তো কোথাও প্রাণ ,
দরদ কোথায় বাজে সেটা অন্তর্যামী জানেন ভগবান । ”
বাপ একটু হাসল কেবল , ভাবলে , “ মেয়েমানুষ
হৃদয়তাপের ভাপে-ভরা ফানুস ।
জীবন একটা কঠিন সাধন — নেই সে ওদের জ্ঞান । ”
এই বলে ফের চলল পড়া ইংরেজি সেই প্রেমের উপাখ্যান ।
দুখের তাপে জ্বলে জ্বলে অবশেষে নিবল মায়ের তাপ ;
সংসারেতে একা পড়লেন বাপ ।
বড়ো ছেলে বাস করে তার স্ত্রীপুত্রদের সাথে
বিদেশে পাটনাতে ।
দুই মেয়ে তার কেউ থাকে না কাছে ,
শ্বশুরবাড়ি আছে ।
একটি থাকে ফরিদপুরে ,
আরেক মেয়ে থাকে আরো দূরে
মাদ্রাজে কোন্ বিন্ধ্যগিরির পার ।
পড়ল মঞ্জুলিকার ‘ পরে বাপের সেবা – ভার ।
রাঁধুনে ব্রাহ্মণের হাতে খেতে করেন ঘৃণা ,
স্ত্রীর রান্না বিনা
অন্নপানে হত না তার রুচি ।
সকালবেলায় ভাতের পালা , সন্ধ্যাবেলায় রুটি কিংবা লুচি ;
ভাতের সঙ্গে মাছের ঘটা ,
ভাজাভুজি হত পাঁচটা-ছটা ;
পাঁঠা হত রুটি-লুচির সাথে ।
মঞ্জুলিকা দুবেলা সব আগাগোড়া রাঁধে আপন হাতে ।
একাদশী ইত্যাদি তার সকল তিথিতেই
রাঁধার ফর্দ এই ।
বাপের ঘরটি আপনি মোছে ঝাড়ে ,
রৌদ্রে দিয়ে গরম পোশাক আপনি তোলে পাড়ে ।
ডেস্কে বাক্সে কাগজপত্র সাজায় থাকে থাকে ,
ধোবার বাড়ির ফর্দ টুকে রাখে ।
গয়লানী আর মুদির হিসাব রাখতে চেষ্টা করে ,
ঠিক দিতে ভুল হলে তখন বাপের কাছে ধমক খেয়ে মরে ।
কাসুন্দি তার কোনোমতেই হয় না মায়ের মতো ,
তাই নিয়ে তার কত
নালিশ শুনতে হয় ।
তা ছাড়া তার পান-সাজাটা মনের মতো নয় ।
মায়ের সঙ্গে তুলনাতে পদে – পদেই ঘটে যে তার ত্রুটি ।
মোটামুটি —
আজকালকার মেয়েরা কেউ নয় সেকালের মতো ।
হয়ে নীরব নত
মঞ্জুলী সব সহ্য করে , সর্বদাই সে শান্ত ,
কাজ করে অক্লান্ত ।
যেমন করে মাতা বারংবার
শিশু ছেলের সহস্র আবদার
হেসে সকল বহন করেন স্নেহের কৌতুকে ,
তেমনি করেই সুপ্রসন্ন মুখে
মঞ্জুলী তার বাপের নালিশ দন্ডে দন্ডে শোনে ,
হাসে মনে মনে ।
বাবার কাছে মায়ের স্মৃতি কতই মূল্যবান
সেই কথাটা মনে করে গর্বসুখে পূর্ণ তাহার প্রাণ ।
“ আমার মায়ের যত্ন যে-জন পেয়েছে একবার
আর কিছু কি পছন্দ হয় তার । ”
হোলির সময় বাপকে সেবার বাতে ধরল ভারি ।
পাড়ায় পুলিন করছিল ডাক্তারি ,
ডাকতে হল তারে ।
হৃদয়যন্ত্র বিকল হতে পারে
ছিল এমন ভয় ।
পুলিনকে তাই দিনের মধ্যে বারেবারেই আসতে যেতে হয় ।
মঞ্জুলী তার সনে
সহজভাবেই কইবে কথা যতই করে মনে
ততই বাধে আরো ।
এমন বিপদ কারো
হয় কি কোনোদিন ।
গলাটি তার কাঁপে কেন , কেন এতই ক্ষীণ ,
চোখের পাতা কেন
কিসের ভারে জড়িয়ে আসে যেন ।
ভয়ে মরে বিরহিণী
শুনতে যেন পাবে কেহ রক্তে যে তার বাজে রিনিরিনি ।
পদ্মপাতায় শিশির যেন , মনখানি তার বুকে
দিবারাত্রি টলছে কেন এমনতরো ধরা-পড়ার মুখে ।
ব্যামো সেরে আসছে ক্রমে ,
গাঁঠের ব্যথা অনেক এল কমে ।
রোগী শয্যা ছেড়ে
একটু এখন চলে হাত-পা নেড়ে ।
এমন সময় সন্ধ্যাবেলা
হাওয়ায় যখন যূথীবনের পরানখানি মেলা ,
আঁধার যখন চাঁদের সঙ্গে কথা বলতে যেয়ে
চুপ করে শেষ তাকিয়ে থাকে চেয়ে ,
তখন পুলিন রোগী-সেবার পরামর্শ-ছলে
মঞ্জুলিরে পাশের ঘরে ডেকে বলে —
“ জানো তুমি তোমার মায়ের সাধ ছিল এই চিতে
মোদের দোঁহার বিয়ে দিতে ।
সে ইচ্ছাটি তাঁর ই
পুরাতে চাই যেমন করেই পারি ।
এমন করে আর কেন দিন কাটাই মিছিমিছি । ”
“ না না , ছি ছি , ছি ছি । ”
এই ব ‘ লে সে মঞ্জুলিকা দু-হাত দিয়ে মুখখানি তার ঢেকে
ছুটে গেল ঘরের থেকে ।
আপন ঘরে দুয়ার দিয়ে পড়ল মেঝের ‘ পরে —
ঝরঝরিয়ে ঝরঝরিয়ে বুক ফেটে তার অশ্রু ঝরে পড়ে ।
ভাবলে , “ পোড়া মনের কথা এড়ায় নি ওঁর চোখ ।
আর কেন গো । এবার মরণ হ ো ক । ”