কত বছর গেল চলে ,
আবার গ্রামে গিয়েছিলেম পরীক্ষা পাস হলে ।
গিয়ে দেখি , ওদের বাড়ি কিনেছে কোন্ পাটের কুঠিয়াল ,
হল অনেক কাল ।
বিয়ে করে মনুর স্বামী
কোন্ দেশে যে নিয়ে গেছে , ঠিকানা তার খুঁজে না পাই আমি ।
সেই মনু আজ এতকালের অজ্ঞাতবাস টুটে
কোন্ কথাটি পাঠাল তার পত্রপুটে ।
কোন্ বেদনা দিল তারে নিষ্ঠুর সংসার —
মৃত্যু সে কি । ক্ষতি সে কি । সে কি অত্যাচার ।
কেবল কি তার বাল্যসখার কাছে
হৃদয়ব্যথার সান্ত্বনা তার আছে ।
ছিন্ন চিঠির বাকি
বিশ্বমাঝে কোথায় আছে খুঁজে পাব না কি ।
“ মনুরে কি গেছ ভুলে । ”
এ প্রশ্ন কি অনন্ত কাল রইবে দুলে
মোর জগতের চোখের পাতায় একটি ফোঁটা চোখের জলের মতো ।
কত চিঠির জবাব লিখব কত ,
এই কথাটির জবাব শুধু নিত্য বুকে জ্বলবে বহ্নিশিখা ,
অক্ষরেতে হবে না আর লিখা ।
ঠাকুরদাদার ছুটি
তোমার ছুটি নীল আকাশে ,
তোমার ছুটি মাঠে ,
তোমার ছুটি থইহারা ওই
দিঘির ঘাটে ঘাটে ।
তোমার ছুটি তেঁতুলতলায় ,
গোলাবাড়ির কোণে ,
তোমার ছুটি ঝোপেঝাপে
পারুলডাঙার বনে ।
তোমার ছুটির আশা কাঁপে
কাঁচা ধানের খেতে ,
তোমার ছুটির খুশি নাচে
নদীর তরঙ্গেতে ।
আমি তোমার চশমা – পরা
বুড়ো ঠাকুরদাদা ,
বিষয়-কাজের মাকড়সাটার
বিষম জালে বাঁধা ।
আমার ছুটি সেজে বেড়ায়
তোমার ছুটির সাজে ,
তোমার কণ্ঠে আমার ছুটির
মধুর বাঁশি বাজে ।
আমার ছুটি তোমার ই ওই
চপল চোখের নাচে ,
তোমার ছুটির মাঝখানেতেই
আমার ছুটি আছে ।
তোমার ছুটির খেয়া বেয়ে
শরৎ এল মাঝি ।
শিউলি-কানন সাজায় তোমার
শুভ্র ছুটির সাজি ।
শিশির-হাওয়া শিরশিরিয়ে
কখন রাতারাতি
হিমালয়ের থেকে আসে
তোমার ছুটির সাথি ।
আশ্বিনের এই আলো এল
ফুল-ফোটানো ভোরে
তোমার ছুটির রঙে রঙিন
চাদরখানি প ‘ রে ।
আমার ঘরে ছুটির বন্যা
তোমার লাফে-ঝাঁপে ;
কাজকর্ম হিসাবকিতাব
থরথরিয়ে কাঁপে ।
গলা আমার জড়িয়ে ধর ,
ঝাঁপিয়ে পড় কোলে ,
সেই তো আমার অসীম ছুটি
প্রাণের তুফান তোলে ।
তোমার ছুটি কে যে জোগায়
জানি নে তার রীত ,
আমার ছুটি জোগাও তুমি ,
ওই খানে মোর জিত ।
নিষ্কৃতি
মা কেঁদে কয় , “ মঞ্জুলী মোর ওই তো কচি মেয়ে ,
ওর ই সঙ্গে বিয়ে দেবে ?— বয়সে ওর চেয়ে
পাঁচগুনো সে বড়ো ;
তাকে দেখে বাছা আমার ভয়েই জড়সড় ।
এমন বিয়ে ঘটতে দেব নাকো । ”
বাপ বললে , “ কান্না তোমার রাখো!
পঞ্চাননকে পাওয়া গেছে অনেক দিনের খোঁজে ,
জান না কি মস্ত কুলীন ও যে ।
সমাজে তো উঠতে হবে সেটা কি কেউ ভাব ।
ওকে ছাড়লে পাত্র কোথায় পাব । ”
মা বললে , “ কেন , ওই যে চাটুজ্যেদের পুলিন ,
নাই বা হল কুলীন ,—
দেখতে যেমন তেমনি স্বভাবখানি ,
পাস করে ফের পেয়েছে জলপানি ,
সোনার টুকরো ছেলে ।
এক-পাড়াতে থাকে ওরা — ওর ই সঙ্গে হেসে খেলে
মেয়ে আমার মানুষ হল ; ওকে যদি বলি আমি আজই
এক্খনি হয় রাজি । ”
বাপ বললে , “ থামো ,
আরে আরে রামোঃ ।
ওরা আছে সমাজের সব তলায় ।
বামুন কি হয় প ই তে দিলেই গলায় ?
দেখতে শুনতে ভালো হলেই পাত্র হল! রাধে!
স্ত্রীবুদ্ধি কি শাস্ত্রে বলে সাধে । ”
যেদিন ওরা গিনি দিয়ে দেখলে কনের মুখ
সেদিন থেকে মঞ্জুলিকার বুক
প্রতি পলের গোপন কাঁটায় হল রক্তে মাখা ।
মায়ের স্নেহ অন্তর্যামী , তার কাছে তো রয় না কিছুই ঢাকা ;
মায়ের ব্যথা মেয়ের ব্যথা চলতে খেতে শুতে
ঘরের আকাশ প্রতিক্ষণে হানছে যেন বেদনা-বিদ্যুতে ।
অটলতার গভীর গর্ব বাপের মনে জাগে —
সুখে দুঃখে দ্বেষে রাগে
ধর্ম থেকে নড়েন তিনি নাই হেন দৌর্বল্য ।
তাঁর জীবনের রথের চাকা চলল
লোহার বাঁধা রাস্তা দিয়ে প্রতিক্ষণেই ,
কোনোমতেই ইঞ্চি – খানেক এদিক-ওদিক একটু হবার জো নেই ।
তিনি বলেন , তাঁর সাধনা বড়োই সুকঠোর ,
আর কিছু নয় , শুধুই মনের জোর ,
অষ্টাবক্র জমদগ্নি প্রভৃতি সব ঋষির সঙ্গে তুল্য ,
মেয়েমানুষ বুঝবে না তার মূল্য ।
অন্তঃশীলা অশ্রুনদীর নীরব নীরে
দুটি নারীর দিন বয়ে যায় ধীরে ।
অবশেষে বৈশাখে এক রাতে
মঞ্জুলিকার বিয়ে হল পঞ্চাননের সাথে ।
বিদায়বেলায় মেয়েকে বাপ বলে দিলেন মাথায় হস্ত ধরি
“ হও তুমি সাবিত্রীর মতো এই কামনা করি । ”
কিমাশ্চর্যমতঃপরং , বাপের সাধন-জোরে
আশীর্বাদের প্রথম অংশ দু-মাস যেতেই ফলল কেমন করে —
পঞ্চাননকে ধরল এসে যমে ;
কিন্তু মেয়ের কপালক্রমে
ফলল না তার শেষের দিকটা , দিলে না যম ফিরে ;
মঞ্জুলিকা বাপের ঘরে ফিরে এল সিঁদুর মুছে শিরে ।
দুঃখে সুখে দিন হয়ে যায় গত
স্রোতের জলে ঝরে-পড়া ভেসে-যাওয়া ফুলের মতো ,
অবশেষে হল
মঞ্জুলিকার বয়স ভরা ষোলো ।
কখন শিশুকালে
হৃদয়-লতার পাতার অন্তরালে
বেরিয়েছিল একটি কুঁড়ি
প্রাণের গোপন রহস্যতল ফুঁড়ি ;
জানত না তো আপনাকে সে ,
শুধায় নি তার নাম কোনোদিন বাহির হতে খেপা বাতাস এসে ,
সেই কুঁড়ি আজ অন্তরে তার উঠছে ফুটে
মধুর রসে ভরে উঠে ।
সে যে প্রেমের ফুল
আপন রাঙা পাপড়ি – ভারে আপনি সমাকুল ।
আপনাকে তার চিনতে যে আর নাইকো বাকি ,
তাইতো থাকি থাকি
চমকে ওঠে নিজের পানে চেয়ে ।
আকাশপারের বাণী তারে ডাক দিয়ে যায় আলোর ঝরনা বেয়ে ;
রাতের অন্ধকারে
কোন্ অসীমের রোদনভরা বেদন লাগে তারে ।
বাহির হতে তার
ঘুচে গেছে সকল অলংকার ;
অন্তর তার রাঙিয়ে ওঠে স্তরে স্তরে ,
তাই দেখে সে আপনি ভেবে মরে ।
কখন কাজের ফাঁকে
জানলা ধরে চুপ করে সে বাইরে চেয়ে থাকে —
যেখানে ওই শজনে গাছের ফুলের ঝুরি বেড়ার গায়ে
রাশি রাশি হাসির ঘায়ে
আকাশটারে পাগল করে দিবস – রাতি ।
যে ছিল তার ছেলেবেলার খেলাঘরের সাথি
আজ সে কেমন করে
জলস্থলের হৃদয়খানি দিল ভরে ।
অরূপ হয়ে সে যেন আজ সকল রূপে রূপে
মিশিয়ে গেল চুপে চুপে ।
পায়ের শব্দ তার ই
মর্ মরিত পাতায় পাতায় গিয়েছে সঞ্চারি ।
কানে কানে তারি করুণ বাণী
মৌমাছিদের পাখার গুনগুনানি ।