বাজল বিয়ের বাঁশি ,
অনাদরের ঘর ছেড়ে হায় বিদায় হল দুষ্টু সর্বনাশী ।
যাবার বেলা বলে গেল , ‘ দাদা , তোমার রইল নিমন্ত্রণ ,
তিন-সত্যি — যেয়ো যেয়ো । ‘ ‘ যাব , যাব , যাব বই কি বোন । ‘
আর কিছু না বলে
আশীর্বাদের মোতির মালা পরিয়ে দিলেম গলে ।
চতুর্থ দিন প্রাতে
খবর এল , ইরাবতীর সাগর-মোহানাতে
ওদের জাহাজ ডুবে গেছে কিসের ধাক্কা খেয়ে ।
আবার ভাগ্য নেয়ে
শৈলরে তার সঙ্গে নিয়ে কোন্ পারে হায় গেল নৌকো বেয়ে
কেন এল কেনই গেল কেই বা তাহা জানে ।
নিমন্ত্রণটি রেখে গেল শুধু আমার প্রাণে ।
যাব যাব যাব , দিদি , অধিক দেরি নাই ,
তিন-সত্যি আছে তোমার , সে-কথা কি ভুলতে পারি ভাই ।
আরো একটি চিহ্ন তাহার রেখে গেছে ঘরে
খবর পেলেম পরে ।
গালিয়ে বুকের ব্যথা
লিখে রাখি এইখানে সেই কথা —
দিনের পরে দিন চলে যায় ওদের বাড়ি যাই নে আমি আর ।
নিয়ে আপন একলা প্রাণের ভার
আপন মনে
থাকি আপন কোণে ।
হেনকালে একদা মোর ঘরে
সন্ধ্যাবেলায় বাপ এল তার কিসের তরে ।
বললে , “ খুড়ো একটা কথা আছে ,
বলি তোমার কাছে ।
শৈল যখন ছোটো ছিল , একদা মোর বাক্স খুলে দেখি
হিসাব-লেখা খাতার ‘ পরে এ কী
হিজিবিজি কালির আঁচড় । মাথায় যেন পড়ল ক্রোধের বাজ ।
বোঝা গেল শৈলরি ই এ কাজ ।
মারা-ধরা গালিমন্দ কিছুতে তার হয় না কোনো ফল —
হঠাৎ তখন মনে এল শাস্তির কৌশল ।
মানা করে দিলেম তারে
তোমার বাড়ি যাওয়া একেবারে ।
সবার চেয়ে কঠিন দন্ড! চুপ করে সে রইল বাক্যহীন
বিদ্রোহিণী বিষম ক্রোধে । অবশেষে বারো দিনের দিন
গরবিনী গর্ব ভেঙে বললে এসে , ‘ আমি
আর কখনো করব না দুষ্টামি । ‘
আঁচড়-কাটা সেই হিসাবের খাতা ,
সেই কখানা পাতা ,
আজকে আমার মুখের পানে চেয়ে আছে তারি চোখের মতো ।
হিসাবের সেই অঙ্কগুলার সময় হল গত
সে শাস্তি নেই , সে দুষ্টু নেই ;
রইল শুধু এই
চিরদিনের দাগা
শিশু-হাতের আঁচড় কটি আমার বুকে লাগা ।
ছিন্ন পত্র
কর্ম যখন দেবতা হয়ে জুড়ে বসে পূজার বেদী ,
মন্দিরে তার পাষাণ-প্রাচীর অভ্রভেদী
চতুর্দিকেই থাকে ঘিরে ;
তারই মধ্যে জীবন যখন শুকিয়ে আসে ধীরে ধীরে
পায় না আলো , পায় না বাতাস , পায় না ফাঁকা , পায় না কোনো রস ,
কেবল টাকা , কেবল সে পায় যশ ,
তখন সে কোন্ মোহের পাকে
মরণ – দশা ঘটেছে তার , সেই কথাটাই ভুলে থাকে ।
আমি ছিলেম জড়িয়ে পড়ে সেই বিপাকের ফাঁসে ;
বৃহৎ সর্বনাশে
হারিয়েছিলেম বিশ্বজগৎখানি ।
নীল আকাশের সোনার বাণী
সকাল-সাঁঝের বীণার তারে
পৌঁছত না মোর বাতায়ন-দ্বারে ।
ঋতুর পরে আসত ঋতু শুধু কেবল পঞ্জিকারই পাতে ,
আমার আঙিনাতে
আনত না তার রঙিন পাতার ফুলের নিমন্ত্রণ ।
অন্তরে মোর লুকিয়ে ছিল কী যে সে ক্রন্দন
জানব এমন পাই নি অবকাশ ।
প্রাণের উপবাস
সংগোপনে বহন করে কর্মরথে
সমারোহে চলতেছিলেম নিষ্ফলতার মরুপথে ।
তিনটে চারটে সভা ছিল জুড়ে আমার কাঁধ ;
দৈনিকে আর সাপ্তাহিকে ছাড়তে হত নকল সিংহনাদ ;
বীডন কুঞ্জে মীটিং হলে আমি হতেম বক্তা ;
রিপোর্ট লিখতে হত তক্তা তক্তা ;
যুদ্ধ হত সেনেট-সিন্ডিকেটে ,
তার উপরে আপিস আছে , এমনি করে কেবল খেটে খেটে
দিনরাত্রি যেত কোথায় দিয়ে ।
বন্ধুরা সব বলত , “ করছ কী এ ।
মারা যাবে শেষে! ”
আমি বলতেম হেসে ,
“ কী করি ভাই , খাটতে কি হয় সাধে ।
একটু যদি ঢিল দিয়েছি অমনি গলদ বাধে ,
কাজ বেড়ে যায় আরো —
কী করি তার উপায় বলতে পার ো ?”
বিশ্বকর্মার সদর আপিস ছিল যেন আমার ‘ পরেই ন্যস্ত ,
অহোরাত্রি এমনি আমার ভাবটা ব্যতিব্যস্ত ।
সেদিন তখন দু-তিন রাত্রি ধরে
গত সনের রিপোর্টখানা লিখেছি খুব জোরে ।
বাছাই হবে নতুন সনের সেক্রেটারি ,
হপ্তা তিনেক মরতে হবে ভোট কুড়োতে তার ই ।
শীতের দিনে যেমন পত্রভার
খসিয়ে ফেলে গাছগুলো সব কেবল শাখা-সার ,
আমার হল তেমনি দশা ;
সকাল হতে সন্ধ্যা-নাগাদ এক টেবিলেই বসা ;
কেবল পত্র রওনা করা ,
কেবল শুকিয়ে মরা ।
খবর আসে “ খাবার তৈরি ”, নিই নে কথা কানে ,
আবার যদি খবর আনে ,
বলি ক্রোধের ভরে
“ মরি এমন নেই অবসর , খাওয়া তো থাক ্ পরে । ”
বেলা যখন আড়াইটে প্রায় , নিঝুম হল পাড়া ,
আর-সকলে স্তব্ধ কেবল গোটাপাঁচেক চড়ুই পাখি ছাড়া ;
এমন সময় বেহারাটা ডাকের পত্র নিয়ে
হাতে গেল দিয়ে ।
জরুরি কোন্ কাজের চিঠি ভেবে
খুলে দিখি বাঁকা লাইন , কাঁচা আখর চলছে উঠে নেবে ,
নাইকো দাঁড়ি-কমা ,
শেষ লাইনে নাম লেখা তার মনোরমা ।
আর হল না পড়া ,
মনে হল কোন্ বিধবার ভিক্ষাপত্র মিথ্যা কথায় গড়া ,
চিঠিখানা ছিঁড়ে ফেলে আবার লাগি কাজে ।
এমনি করে কোন্ অতলের মাঝে
হপ্তা তিনেক গেল ডুবে ।
সূর্য ওঠে পশ্চিমে কি পুবে ,
সেই কথাটাই ভুলে গেছি , চলছি এমন চোটে ।
এমন সময় ভোটে
আমার হল হার ,
শত্রুদলে আসন আমার করলে অধিকার ;
তাহার পরে খালি
কাগজপত্রে চলল গালাগালি ।
কাজের মাঝে অনেকটা ফাঁক হঠাৎ পড়ল হাতে ,
সেটা নিয়ে কী করব তাই ভাবছি বসে আরাম – কেদারাতে ;
এমন সময় হঠাৎ দখিন-পবনভরে
ছেঁড়া চিঠির টুকরো এসে পড়ল আমার কোলের ‘ পরে ।
অন্যমনে হাতে তুলে
এই কথাটা পড়ল চোখে , “ মনুরে কি গেছ এখন ভুলে । ”
মনু ? আমার মনোরমা ? ছেলেবেলার সেই মনু কি এই ।
অমনি হঠাৎ এক নিমেষেই
সকল শূন্য ভরে ,
হারিয়ে-যাওয়া বসন্ত মোর বন্যা হয়ে ডুবিয়ে দিল মোরে ।
সেই তো আমার অনেক কালের পড়োশিনী ,
পায়ে পায়ে বাজাত মল রিনিঝিনি ।
সেই তো আমার এই জনমের ভোর-গগনের তারা
অসীম হতে এসেছে পথহারা ;
সেই তো আমার শিশুকালের শিউলিফুলের কোলে
শুভ্র শিশির দোলে ;
সেই তো আমার মুগ্ধ চোখের প্রথম আলো ,
এই ভুবনের সকল ভালোর প্রথম ভালো ।
মনে পড়ে , ঘুমের থেকে যেমনি জেগে ওঠা
অমনি ওদের বাড়ির পানে ছোটা ।
ওর ই সঙ্গে শুরু হত দিনের প্রথম খেলা ;
মনে পড়ে , পিঠের ‘ পরে চুলটি মেলা
সেই আনন্দমূর্তিখানি , স্নিগ্ধ ডাগর আঁখি ,
কণ্ঠ তাহার সুধায় মাখামাখি ।
অসীম ধৈর্যে সইত সে মোর হাজার অত্যাচার
সকল কথায় মানত মনু হার ।
উঠে গাছের আগডালেতে দোলা খেতেম জোরে ,
ভয় দেখাতেম পড়ি-পড়ি ক ‘ রে ,
কাঁদো-কাঁদো কণ্ঠে তাহার করুণ মিনতি সে ,
ভুলতে পারি কি সে ।
মনে পড়ে , নীরব ব্যথা তার ,
বাবার কাছে যখন খেতেম মার ;
ফেলেছে সে কত চোখের জল ,
মোর অপরাধ ঢাকা দিতে খুঁজত কত ছল ।
আরো কিছু বড়ো হলে
আমার কাছে নিত সে তার বাংলা পড়া বলে ।
নামতাটা তার কেবল যেত বেধে ,
তাই নিয়ে মোর একটু হাসি সইত না সে , উঠত লাজে কেঁদে ।
আমার হাতে মোটা মোটা ইংরেজি বই দেখে
ভাবত মনে , গেছে যেন কোন্ আকাশে ঠেকে
রাশীকৃত মোর বিদ্যার বোঝা ।
যা-কিছু সব বিষম কঠিন , আমার কাছে যেন নেহাত সোজা ।
হেনকালে হঠাৎ সেবার ,
দশমীতে দ্বারিগ্রামে ঠাকুর ভাসান দেবার
রাস্তা নিয়ে দুই পক্ষের চাকর-দরোয়ানে
বকাবকি লাঠালাঠি বেধে গেল গলির মধ্যখানে ।
তাই নিয়ে শেষ বাবার সঙ্গে মনুর বাবার বাধল মকদ্দমা ,
কেউ কাহারে করলে না আর ক্ষমা ।
দুয়ার মোদের বন্ধ হল ,
আকাশ যেন কালো মেঘে অন্ধ হল ,
হঠাৎ এল কোন্ দশমী সঙ্গে নিয়ে ঝঞ্ঝার গর্জন ,
মোর প্রতিমার হল বিসর্জন ।
দেখাশোনা ঘুচল যখন এলেম যখন দূরে ,
তখন প্রথম শুনতে পেলেম কোন্ প্রভাতী সুরে
প্রাণের বীণা বেজেছিল কাহার হাতে ।
নিবিড় বেদনাতে
মুখখানি তার উঠল ফুটে আঁধার পটে সন্ধ্যাতারার মতো ;
একই সঙ্গে জানিয়ে দিলে সে যে আমার কত ,
সে যে আমার কতখানিই নয়!
প্রেমের শিখা জ্বলল তখন , নিবল যখন চোখের পরিচয় ।