কালো মেয়ে
মরচে-পড়া গরাদে ওই , ভাঙা জানলাখানি ;
পাশের বাড়ির কালো মেয়ে নন্দরানী
ওই খানেতে বসে থাকে একা ,
শুকনো নদীর ঘাটে যেন বিনা কাজে নৌকোখানি ঠেকা ।
বছর বছর করে ক্রমে
বয়স উঠছে জমে ।
বর জোটে না , চিন্তিত তার বাপ ;
সমস্ত এই পরিবারের নিত্য মমস্তাপ
দীর্ঘশ্বাসের ঘূর্ণি হাওয়ায় আছে যেন ঘিরে
দিবসরাত্রি কালো মেয়েটিরে ।
সামনে-বাড়ির নিচের তলায় আমি থাকি “ মেস ” -এ ।
বহুকষ্টে শেষে
কলেজেতে পার হয়েছি একটা পরীক্ষায় ।
আর কি চলা যায়
এমন করে এগ্জামিনের লগি ঠেলে ঠেলে ।
দুই বেলাতেই পড়িয়ে ছেলে
একটা বেলা খেয়েছি আধ – পেটা
ভিক্ষা করা সেটা
সইত না একেবারে ,
তবু গেছি প্রিন্সিপালের দ্বারে
বিনি মাইনেয় , নেহাত পক্ষে , আধা মাইনেয় , ভর্তি হবার জন্যে ।
এক সময়ে মনে ছিল আধেক রাজ্য এবং রাজার কন্যে
পাবার আমার ছিল দাবি ,
মনে ছিল ধনমানের রুদ্ধ ঘরের সোনার চাবি
জন্মকালে বিধি যেন দিয়েছিলেন রেখে
আমার গোপন শক্তিমাঝে ঢেকে ।
আজকে দেখি , নব্যবঙ্গে
শক্তিটা মোর ঢাকাই রইল , চাবিটা তার সঙ্গে ।
মনে হচ্ছে ময়নাপাখির খাঁচায়
অদৃষ্ট তার দারুণ রঙ্গে ময়ূরটাকে নাচায় ;
পদে পদে পুচ্ছে বাধে লোহার শলা ,
কোন্ কৃপণের রচনা এই নাট্যকলা ।
কোথায় মুক্ত অরণ্যানী , কোথায় মত্ত বাদল-মেঘের ভেরী ।
এ কী বাঁধন রাখল আমায় ঘেরি ।
ঘুরে ঘুরে উমেদারির ব্যর্থ আশে
শুকিয়ে মরি রোদ্দুরে আর উপবাসে ।
প্রাণটা হাঁপায় , মাথা ঘোরে ,
তক্তপোষে শুয়ে পড়ি ধপাস করে ।
হাতপাখাটার বাতাস খেতে খেতে
হঠাৎ আমার চোখ পড়ে যায় উপরেতে —
মরচে-পড়া গরাদে ওই , ভাঙা জানলাখানি ,
বসে আছে পাশের বাড়ির কালো মেয়ে নন্দরানী ।
মনে হয় যে , রোদের পরে বৃষ্টিভরা থমকে-যাওয়া মেঘে
ক্লান্ত পরান জুড়িয়ে গেল কালো পরশ লেগে ।
আমি যে ওর হৃদয়খানি চোখের ‘ পরে স্পষ্ট দেখি আঁকা ;
ও যেন জুঁইফুলের বাগান সন্ধ্যা-ছায়ায় ঢাকা ;
একটুখানি চাঁদের রেখা কৃষ্ণপক্ষে স্তব্ধ নিশীথ রাতে
কালো জলের গহন কিনারাতে ।
লাজুক ভীরু ঝরনাখানি ঝিরি ঝিরি
কালো পাথর বেয়ে বেয়ে লুকিয়ে ঝরে ধীরি ধীরি ।
রাত-জাগা এক পাখি ,
মৃদু করুণ কাকুতি তার তারার মাঝে মিলায় থাকি থাকি ।
ও যেন কোন্ ভোরের স্বপন কান্নাভরা ,
ঘন ঘুমের নীলাঞ্চলের বাঁধন দিয়ে ধরা ।
রাখাল ছেলের সঙ্গে বসে বটের ছায়ে
ছেলেবেলার বাঁশের বাঁশি বাজিয়েছিলেম গাঁয়ে ।
সেই বাঁশিটির টান
ছুটির দিনে হঠাৎ কেমন আকুল করল প্রাণ ।
আমি ছাড়া সকল ছেলেই গেছে যে যার দেশে ,
একলা থাকি “ মেস্ ” -এ ।
সকাল – সাঁঝে মাঝে মাঝে বাজাই ঘরের কোণে
মেঠো গানের সুর যা ছিল মনে ।
ওই যে ওদের কালো মেয়ে নন্দরানী
যেমনতরো ওর ভাঙা ঐ জানলাখানি ,
যেখানে ওর কালো চোখের তারা
কালো আকাশতলে দিশেহারা ;
যেখানে ওর এলোচুলের স্তরে স্তরে
বাতাস এসে করত খেলা আলস – ভরে ;
যেখানে ওর গভীর মনের নীরব কথাখানি
আপন দোসর খুঁজে পেত আলোর নীরব বাণী ;
তেমনি আমার বাঁশের বাঁশি আপনভোলা ,
চারদিকে মোর চাপা দেয়াল , ওই বাঁশিটি আমার জানলা খোলা ।
ওই খানেতেই গুটিকয়েক তান
ওই মেয়েটির সঙ্গে আমার ঘুচিয়ে দিত অসীম ব্যবধান ।
এ সংসারে অচেনাদের ছায়ার মতন আনাগোনা
কেবল বাঁশির সুরের দেশে দুই অজানার রইল জানাশোনা ।
যে-কথাটা কান্না হয়ে বোবার মতন ঘুরে বেড়ায় বুকে
উঠল ফুটে বাঁশির মুখে ।
বাঁশির ধারেই একটু আলো , একটুখানি হাওয়া ,
যে-পাওয়াটি যায় না দেখা স্পর্শ-অতীত একটুকু সেই পাওয়া ।
চিরদিনের দাগা
ওপার হতে এপার পানে খেয়া-নৌকো বেয়ে
ভাগ্য নেয়ে
দলে দলে আনছে ছেলে মেয়ে ।
সবাই সমান তারা
এক সাজিতে ভরে-আনা চাঁপা ফুলের পারা ।
তাহার পরে অন্ধকারে
কোন্ ঘরে সে পৌঁছিয়ে দেয় কারে!
তখন তাদের আরম্ভ হয় নব নব কাহিনী-জাল বোনা —
দুঃখে সুখে দিনমুহূর্ত গোনা ।
একে একে তিনটি মেয়ের পরে
শৈল যখন জন্মাল তার বাপের ঘরে ,
জননী তার লজ্জা পেল ; ভাবল কোথা থেকে
অবাঞ্ছিত কাঙালটারে আনল ঘরে ডেকে ।
বৃষ্টিধারা চাইছে যখন চাষি
নামল যেন শিলাবৃষ্টিরাশি ।
বিনা-দোষের অপরাধে শৈলবালার জীবন হল শুরু ,
পদে পদে অপরাধের বোঝা হল গুরু ।
কারণ বিনা যে-অনাদর আপনি ওঠে জেগে
বেড়েই চলে সে যে আপন বেগে ।
মা তারে কয় ‘ পোড়ারমুখী ‘ , শাসন করে বাপ —
এ কোন্ অভিশাপ
হতভাগী আনলি বয়ে — শুধু কেবল বেঁচে-থাকার পাপ ।
যতই তারা দিত ওরে গালি
নির্মলারে দেখত মলিন মাখিয়ে তারে আপন কথার কালি ।
নিজের মনের বিকারটিরেই শৈল ওরা কয় ,
ওদের শৈল বিধির শৈল নয় ।
আমি বৃদ্ধ ছিনু ওদের প্রতিবেশী ।
পাড়ায় কেবল আমার সঙ্গে দুষ্টু মেয়ের ছিল মেশামেশি ।
‘ দাদা ‘ বলে
গলা আমার জড়িয়ে ধরে বসত আমার কোলে ।
নাম শুধালে শৈল আমায় বলত হাসি হাসি —
‘ আমার নাম যে দুষ্টু , সর্বনাশী! ‘
যখন তারে শুধাতেম তার মুখটি তুলে ধরে
‘ আমি কে তোর বল দেখি ভাই মোরে ? ‘
বলত ‘ দাদা , তুই যে আমার বর! ‘ —
এমনি করে হাসাহাসি হত পরস্পর ।
বিয়ের বয়স হল তবু কোনোমতে হয় না বিয়ে তার —
তাহে বাড়ায় অপরাধের ভার ।
অবশেষে বর্মা থেকে পাত্র গেল জুটি ।
অল্পদিনের ছুটি ;
শুভকর্ম সেরে তাড়াতাড়ি
মেয়েটিরে সঙ্গে নিয়ে রেঙ্গুনে তার দিতে হবে পাড়ি ।
শৈলকে যেই বলতে গেলেম হেসে —
‘ বুড়ো বরকে হেলা করে নবীনকে , ভাই , বরণ করলি শেষে ? ‘
অমনি যে তার দু-চোখ গেল ভেসে
ঝরঝরিয়ে চোখের জলে । আমি বলি , ‘ ছি ছি ,
কেন , শৈল , কাঁদিস মিছিমিছি ,
করিস অমঙ্গল । ‘
বলতে গিয়ে চক্ষে আমার রাখতে নারি জল ।