এতদিনে প্রথম যেন বাজে
বিয়ের বাঁশি বিশ্ব-আকাশ মাঝে ।
তুচ্ছ বাইশ বছর আমার ঘরের কোণের ধুলায় পড়ে থাক ।
মরণ-বাসর ঘরে আমায় যে দিয়েছে ডাক
দ্বারে আমার প্রার্থী সে যে , নয় সে কেবল প্রভু ,
হেলা আমায় করবে না সে কভু ।
চায় সে আমার কাছে
আমার মাঝে গভীর গোপন যে সুধারস আছে
গ্রহতারার সভার মাঝখানে সে
ঐ যে আমার মুখে চেয়ে দাঁড়িয়ে হোথায় রইল নির্নিমেষে ।
মধুর ভুবন , মধুর আমি নারী ,
মধুর মরণ , ওগো আমার অনন্ত ভিখারি ।
দাও , খুলে দাও দ্বার ,
ব্যর্থ বাইশ বছর হতে পার করে দাও কালের পারাবার ।
শেষ গান
যারা আমার সাঁঝ – সকালের গানের দীপে জ্বালিয়ে দিলে আলো
আপন হিয়ার পরশ দিয়ে ; এই জীবনের সকল সাদা কালো
যাদের আলোক-ছায়ার লীলা ; মনের মানুষ বাইরে বেড়ায় যারা
তাদের প্রাণের ঝর্ না-স্রোতে আমার পরান হয়ে হাজার ধারা
চলছে বয়ে চতুর্দিকে । নয় তো কেবল কালের যোগে আয়ু ,
নয় সে কেবল দিনরজনীর সাতনলি হার , নয় সে নিশাস-বায়ু ।
নানান প্রাণের প্রীতির মিলন নিবিড় হয়ে স্বজন – বন্ধুজনে
পরমায়ুর পাত্রখানি জীবন – সুধায় ভরছে ক্ষণে ক্ষণে ।
একের বাঁচন সবার বাঁচার বন্যাবেগে আপন সীমা হারায়
বহু দূরে ; নিমেষগুলির ফলের গুচ্ছ ভরে রসের ধারায় ।
অতীত হয়ে তবুও তারা বর্তমানের বৃন্তদোলায় দোলে —
গর্ভ-বাঁধন কাটিয়ে শিশু তবু যেমন মায়ের বক্ষে কোলে
বন্দী থাকে নিবিড় প্রেমের গ্র ন্থি দিয়ে । তাই তো যখন শেষে
একে একে আপন জনে সূর্য-আলোর অন্তরালের দেশে
আঁখির নাগাল এড়িয়ে পালায় , তখন রিক্ত শুষ্ক জীবন মম
শীর্ণ রেখায় মিলিয়ে আসে বর্ষাশেষের নির্ঝরিণী – সম
শূন্য বালুর একটি প্রান্তে ক্লান্ত সলিল স্রস্ত অবহেলায় ।
তাই যারা আজ রইল পাশে এই জীবনের সূর্য-ডোবার বেলায়
তাদের হাতে হাত দিয়ে তুই গান গেয়ে নে থাকতে দিনের আলো —
ব ‘ লে নে ভাই , এই যে দেখা এই যে ছোঁওয়া , এই ভালো এই ভালো ।
এই ভালো আজ এ সংগমে কান্নাহাসির গঙ্গাযমুনায়
ঢেউ খেয়েছি , ডুব দিয়েছি , ঘট ভরেছি , নিয়েছি বিদায় ।
এই ভালো রে ফুলের সঙ্গে আলোয় জাগা , গান গাওয়া এই ভাষায় ;
তারার সাথে নিশীথ – রাতে ঘুমিয়ে পড়া নূতন প্রাণের আশায় ।
শেষ প্রতিষ্ঠা
এই কথা সদা শুনি , “ গেছে চলে ”, “ গেছে চলে । ”
তবু রাখি বলে
বলো না , “ সে নাই । ”
সে-কথাটা মিথ্যা , তাই
কিছুতেই সহে না যে ,
মর্মে গিয়ে বাজে ।
মানুষের কাছে
যাওয়া-আসা ভাগ হয়ে আছে ।
তাই তার ভাষা
বহে শুধু আধখানা আশা ।
আমি চাই সেইখানে মিলাইতে প্রাণ
যে-সমুদ্রে ‘ আছে ‘ ‘ নাই ‘ পূর্ণ হয়ে রয়েছে সমান ।
হারিয়ে-যাওয়া
ছোট্ট আমার মেয়ে
সঙ্গিনীদের ডাক শুনতে পেয়ে
সিঁড়ি দিয়ে নিচের তলায় যাচ্ছিল সে নেমে
অন্ধকারে ভয়ে ভয়ে থেমে থেমে ।
হাতে ছিল প্রদীপখানি ,
আঁচল দিয়ে আড়াল করে চলছিল সাবধানী ।
আমি ছিলাম ছাতে
তারায় ভরা চৈত্রমাসের রাতে ।
হঠাৎ মেয়ের কান্না শুনে , উঠে
দেখতে গেলেম ছুটে ।
সিঁড়ির মধ্যে যেতে যেতে
প্রদীপটা তার নিবে গেছে বাতাসেতে ।
শুধাই তারে , “ কী হয়েছে , বামী । ”
সে কেঁদে কয় নিচে থেকে , “ হারিয়ে গেছি আমি । ”
তারায় ভরা চৈত্রমাসের রাতে
ফিরে গিয়ে ছাতে
মনে হল আকাশ – পানে চেয়ে
আমার বামীর মতোই যেন অমনি কে এক মেয়ে
নীলাম্বরের আঁচলখানি ঘিরে
দীপশিখাটি বাঁচিয়ে একা চলছে ধীরে ধীরে ।
নিবত যদি আলো , যদি হঠাৎ যেত থামি
আকাশ ভরে উঠত কেঁদে , “ হারিয়ে গেছি আমি ।