ব্যাপারটা কী ঘটেছিল অল্প লোকেই জানে ,
বলে রাখি সেকথা এইখানে ।
বারো বছর পরে
অপূর্ব রায় দেখা দিল কানাইদাদার ঘরে ।
একে একে তিনটে থিয়েটার
ভাঙাগড়া শেষ করে সে হল ক্যাশিয়ার
সদাগরের আপিসেতে । সেখানে আজ শেষে
তবিল-ভাঙার জাল হিসাবে দায়ে ঠেকেছে সে ।
হাতে বেড়ি পড়ল বুঝি ; তাই সে এল ছুটে
উকিল দাদার ঘরে , সেথায় পড়ল মাথা কুটে ।
কানাই বললে , “ মনে কি নেই ?” অপূর্ব কয় নতমুখে
“ অনেকদিন সে গেছে চুকেবুকে । ”
“ চুকে গেছে ?” কানাই উঠল বিষম রাগে জ্বলে ,
“ এতদিনের পর যেন আশা হচ্ছে চুকে যাবে বলে । ”
নিচের তলায় বলাই আপিস করে —
অপূর্ব রায় ভয়ে ভয়ে ঢুকল তারি ঘরে ।
বললে , “ আমায় রক্ষা করো । ”
বলাই কেঁপে উঠল থরো থরো ।
অধিক কথা কয় না সে যে ; ঘন্টা নেড়ে ডাকল দারোয়ানে ।
অপূর্ব তার মেজাজ দেখে বে রিয়ে এল মানে মানে ।
অপূর্বদের মা তিনি হন মস্ত ঘরের গৃহিণী যে ;
এদের ঘরে নিজে
আসতে গেলে হয় যে তাঁদের মাথা নত ।
অনেক রকম করে ইতস্তত
পত্র দিয়ে পূর্ণকে তাই পাঠিয়ে দিলেন কাশী ।
পূর্ণ বললে , “ রক্ষা করো মাসি । ”
এরি পরে কাশী থেকে মা আসলেন ফিরে ।
কানাই তাঁরে বললে ধীরে ধীরে —
“ জান তো মা , তোমার বাক্য মোদের শিরোধার্য ,
এটা কিন্তু নিতান্ত অকার্য ।
বিধি তাদের দেবেন শাস্তি , আমরা করব রক্ষে ,
উচিত নয় মা সেটা কারো পক্ষে । ”
কানাই যদি নরম হয় বা , বলাই রইল রুখে
অপ্রসন্ন মুখে ।
বললে , “ হেথায় নিজে এসে মাসি তোমার পড়ুন পায়ে ধরে
দেখব তখন বিবেচনা করে । ”
মা বললেন , “ তোরা বলিস কী এ ।
একটা দুঃখ দূর করতে গিয়ে
আরেক দুঃখে বিদ্ধ করবি মর্ম!
এই কি তোদের ধর্ম! ”
এত বলি বাহির হয়ে চলেন তাড়াতাড়ি ;
তারা বলে , “ যাচ্ছ কোথায় । ” মা বললেন , “ অপূর্বদের বাড়ি ।
দুঃখে তাদের বক্ষ আমার ফাটে ;
রইব আমি তাদের ঘরে যতদিন না বিপদ তাদের কাটে । ”
“ রো সো , রো সো , থামো , থামো , করছ এ কী ।
আচ্ছা , ভেবে দেখি ।
তোমার ইচ্ছা যবে
আচ্ছা না হয় যা বলছ তাই হবে । ”
আর কি থামেন তিনি ?
গেলেন একীকিনী
অপূর্বদের ঘরে তাদের মাসি ।
ছিল না আর দোবে চোবে , ছিল না চাপরাসি ।
প্রণাম করল লুটিয়ে পায়ে বিপিনের মা , পুরোনো সেই দাসী ।
মুক্তি
ডাক্তারে যা বলে বলুক নাকো ,
রাখো রাখো খুলে রাখো ,
শিয়রের ওই জানলা দুটো — গায়ে লাগুক হাওয়া ।
ওষুধ ? আমার ফুরিয়ে গেছে ওষুধ খাওয়া ।
তিতো কড়া কত ওষুধ খেলেম এ জীবনে ,
দিনে দিনে ক্ষণে ক্ষণে ।
বেঁচে থাকা , সেই যেন এক রোগ ;
কত রকম কবিরাজি , কতই মুষ্টিযোগ ,
একটুমাত্র অসাবধানেই , বিষম কর্মভোগ ।
এইটে ভালো , ওই টে মন্দ , যে যা বলে সবার কথা মেনে ,
নামিয়ে চক্ষু , মাথায় ঘোমটা টেনে ,
বাইশ বছর কাটিয়ে দিলেম এই তোমাদের ঘরে ।
তাই তো ঘরে পরে ,
সবাই আমায় বললে লক্ষ্মী , সতী ,
ভালোমানুষ অতি!
এ সংসারে এসেছিলেম ন-বছরের মেয়ে ,
তার পরে এই পরিবারের দীর্ঘ গলি বেয়ে
দশের ইচ্ছা বোঝাই-করা এই জীবনটা টেনে টেনে শেষে
পৌঁছিনু আজ পথের প্রান্তে এসে ।
সুখের দুখের কথা
একটুখানি ভাবব এমন সময় ছিল কোথা ।
এই জীবনটা ভালো , কিংবা মন্দ , কিংবা যা-হ ো ক একটা-কিছু
সে-কথাটা বুঝব কখন , দেখব কখন ভেবে আগুপিছু ।
একটানা এক ক্লান্ত সুরে
কাজের চাকা চলছে ঘুরে ঘুরে ।
বাইশ বছর রয়েছি সেই এক-চাকাতেই বাঁধা
পাকের ঘোরে আঁধা ।
জানি নাই তো আমি যে কী , জানি নাই এ বৃহৎ বসুন্ধরা
কী অর্থে যে ভরা ।
শুনি নাই তো মানুষের কী বাণী
মহাকালের বীণায় বাজে । আমি কেবল জানি ,
রাঁধার পরে খাওয়া , আবার খাওয়ার পরে রাঁধা ,
বাইশ বছর এক-চাকাতেই বাঁধা ।
মনে হচ্ছে সেই চাকাটা — ঐ যে থামল যেন ;
থামুক তবে । আবার ওষুধ কেন ।
বসন্তকাল বাইশ বছর এসেছিল বনের আঙিনায় ।
গন্ধে বিভোল দক্ষিণ বায়
দিয়েছিল জলস্থলের মর্ম-দোলায় দোল ;
হেঁকেছিল , “ খোল্ রে দুয়ার খোল্ । ”
সে যে কখন আসত যেত জানতে পেতেম না যে ।
হয়তো মনের মাঝে
সংগোপনে দিত নাড়া ; হয়তো ঘরের কাজে
আচম্বিতে ভুল ঘটাত ; হয়তো বাজত বুকে
জন্মান্তরের ব্যথা ; কারণ-ভোলা দুঃখে সুখে
হয়তো পরান রইত চেয়ে যেন রে কার পায়ের শব্দ শুনে ,
বিহ্বল ফাল্গুনে ।
তুমি আসতে আপিস থেকে , যেতে সন্ধ্যাবেলায়
পাড়ায় কোথা শতরঞ্জ খেলায় ।
থাক্ সে-কথা ।
আজকে কেন মনে আসে প্রাণের যত ক্ষণিক ব্যাকুলতা ।
প্রথম আমার জীবনে এই বাইশ বছর পরে
বসন্তকাল এসেছে মোর ঘরে ।
জানলা দিয়ে চেয়ে আকাশ পানে
আনন্দে আজ ক্ষণে ক্ষণে জেগে উঠছে প্রাণে —
আমি নারী , আমি মহীয়সী ,
আমার সুরে সুর বেঁধেছে জ্যোৎস্না-বীণায় নিদ্রাবিহীন শশী ।
আমি নইলে মিথ্যা হত সন্ধ্যাতারা ওঠা ,
মিথ্যা হত কাননে ফুল-ফোটা ।
বাইশ বছর ধরে
মনে ছিল বন্দী আমি অনন্তকাল তোমাদের এই ঘরে ।
দুঃখ তবু ছিল না তার তরে ,
অসাড় মনে দিন কেটেছে , আরো কাটত আরো বাঁচলে পরে ।
যেথায় যত জ্ঞাতি
লক্ষ্মী ব ‘ লে করে আমার খ্যাতি ;
এই জীবনে সেই যেন মোর পরম সার্থকতা —
ঘরের কোণে পাঁচের মুখের কথা!
আজকে কখন মোর
কাটল বাঁধন-ডোর ।
জনম মরণ এক হয়েছে ওই যে অকূল বিরাট মোহানায় ,
ঐ অতলে কোথায় মিলে যায়
ভাঁড়ার-ঘরের দেয়াল যত
একটু ফেনার মতো ।