ভক্ত করিছে প্রভুর চরণে
ভক্ত করিছে প্রভুর চরণে
জীবন সমর্পণ,
ওরে দীন, তুই জোড়-কর করি
কর্ তাহা দরশন।
মিলনের ধারা পড়িতেছে ঝরি,
বহিয়া যেতেছে অমৃতলহরী,
ভূতলে মাথাটি রাখিয়া লহো রে
শুভাশিস-বরিষন।
ভক্ত করিছে প্রভুর চরণে
জীবন সমর্পণ।
ওই যে আলোক পড়েছে তাঁহার
উদার ললাটদেশে,
সেথা হতে তারি একটি রশ্মি
পড়ুক মাথায় এসে।
চারি দিকে তার শান্তিসাগর
স্থির হয়ে আছে ভরি চরাচর,
ক্ষণকাল তরে দাঁড়াও রে তীরে–
শান্ত করো রে মন।
ভক্ত করিছে প্রভুর চরণে
জীবন সমর্পণ।
মধ্যাহ্নে নগর-মাঝে পথ হতে পথে
মধ্যাহ্নে নগর-মাঝে পথ হতে পথে
কর্মবন্যা ধায় যবে উচ্ছলিত স্রোতে
শত শাখা-প্রশাখায়, নগরের নাড়ী
উঠে স্ফীত তপ্ত হয়ে, নাচে সে আছাড়ি
পাষাণভিত্তির ‘পরে– চৌদিক আকুলি
ধায় পান্থ, ছুটে রথ, উড়ে শুষ্ক ধুলি–
তখন সহসা হেরি মুদিয়া নয়ন
মহাজনারণ্য-মাঝে অনন্ত নির্জন
তোমার আসনখানি– কোলাহল-মাঝে
তোমার নিঃশব্দ সভা নিস্তব্ধে বিরাজে।
সব দুঃখে, সব সুখে, সব ঘরে ঘরে,
সব চিত্তে সব চিন্তা সব চেষ্টা ‘পরে
যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু যায় দেখা,
হে সঙ্গবিহীন দেব, তুমি বসি একা!
মর্তবাসীদের তুমি যা দিয়েছ প্রভু
মর্তবাসীদের তুমি যা দিয়েছ প্রভু,
মর্তের সকল আশা মিটাইয়া তবু
রিক্ত তাহা নাহি হয়। তার সর্বশেষ
আপনি খুঁজিয়া ফিরে তোমারি উদ্দেশ।
নদী ধায় নিত্যকাজে, সর্ব কর্ম সারি
অন্তহীন ধারা তার চরণে তোমারি
নিত্য জলাঞ্জলিরূপে ঝরে অনিবার।
কুসুম আপন গন্ধে সমস্ত সংসার
সম্পূর্ণ করিয়া তবু সম্পূর্ণ না হয়–
তোমারি পূজায় তার শেষ পরিচয়।
সংসারে বঞ্চিত করি তব পূজা নহে।
কবি আপনার গানে যত কথা কহে
নানা জনে লহে তার নানা অর্থ টানি,
তোমা-পানে ধায় তার শেষ অর্থখানি।
মহারাজ ক্ষণেক দর্শন দিতে হবে
মহারাজ ক্ষণেক দর্শন দিতে হবে
তোমার নির্জন ধামে। সেথা ডেকে লবে
সমস্ত আলোক হতে তোমার আলোতে
আমারে একাকী-সর্ব সুখদুঃখ হতে
সর্ব সঙ্গ হতে, সমস্ত এ বসুধার
কর্মবন্ধ হতে। দেব, মন্দিরে তোমার
পশিয়াছি পৃথিবীর সর্বযাত্রীসনে,
দ্বার মুক্ত ছিল যবে আরতির ক্ষণে।
দীপাবলী নিবাইয়া চলে যাবে যবে
নানা পথে নানা ঘরে পূজকেরা সবে,
দ্বার রুধ হয়ে যাবে; শান্ত অন্ধকার
আমারে মিলায়ে দিবে চরণে তোমার।
একখানি জীবনের প্রদীপ তুলিয়া
তোমারে হেরিব একা ভুবন ভুলিয়া।
মাঝে মাঝে কতবার ভাবি কর্মহীন
মাঝে মাঝে কতবার ভাবি কর্মহীন
আজ নষ্ট হল বেলা, নষ্ট হল দিন।
নষ্ট হয় নাই, প্রভু, সে-সকল ক্ষণ–
আপনি তাদের তুমি করেছ গ্রহণ
ওগো অন্তর্যামী দেব। অন্তরে অন্তরে
গোপনে প্রচ্ছন্ন রহি কোন্ অবসরে
বীজেরে অঙ্কুররূপে তুলেছ জাগায়ে,
মুকুলে প্রস্ফুটবর্ণে দিয়েছ রাঙায়ে,
ফুলেরে করেছ ফল রসে সুমধুর
বীজে পরিণত গর্ভ।
আমি নিদ্রাতুর
আলশ্যশয্যায় ‘পরে শ্রান্তিতে মরিয়া
ভেবেছিনু সব কর্ম রহিল পড়িয়া।
প্রভাতে জাগিয়া উঠি মেলিনু নয়ন,
দেখিনু ভরিয়া আছে আমার কানন।
মাঝে মাঝে কভু যবে অবসাদ আসি
মাঝে মাঝে কভু যবে অবসাদ আসি
অন্তরের আলোক পলকে ফেলে গ্রাসি,
মন্দপদে যবে শ্রান্তি আসে তিল তিল
তোমার পূজার বৃন্ত করে সে শিথিল
ম্রিয়মাণ– তখনো না যেন করি ভয়,
তখনো অটল আশা যেন জেগে রয়
তোমা-পানে।
তোমা-‘পরে করিয়া নির্ভর
সে শ্রান্তির রাত্রে যেন সকল অন্তর
নির্ভয়ে অর্পণ করি পথধূলিতলে
নিদ্রারে আহ্বান করি। প্রাণপণ বলে
ক্লান্ত চিত্তে নাহি তুলি ক্ষীণ কলরব
তোমার পূজার অতি দরিদ্র উৎসব।
রাত্রি এনে দাও তুমি দিবসের চোখে,
আবার জাগাতে তারে নবীন আলোকে।
মাতৃস্নেহবিগলিত স্তন্যক্ষীররস
মাতৃস্নেহবিগলিত স্তন্যক্ষীররস
পান করি হাসে শিশু আনন্দে অলস–
তেমনি বিহ্বল হর্ষে ভাবরসরাশি
কৈশোরে করিছি পান; বাজায়েছি বাঁশি
প্রমত্ত পঞ্চম সুরে, প্রকৃতির বুকে
লালনললিতচিত্ত শিশুসম সুখে
ছিনু শুয়ে; প্রভাত-শর্বরী-সন্ধ্যা-বধূ
নানা পাত্রে আনি দিত নানাবর্ণ মধু
পুষ্পগন্ধে মাখা।
আজি সেই ভাবাবেশ
সেই বিহ্বলতা যদি হয়ে থাকে শেষ,
প্রকৃতির স্পর্শমোহ গিয়ে থাকে দূরে–
কোনো দঃখ নাহি। পল্লী হতে রাজপুরে
এবার এনেছ মোরে,দাও চিত্তে বল
দেখাও সত্যের মূর্তি কঠিন নির্মল।
মুক্ত করো, মুক্ত করো নিন্দা-প্রশংসার
মুক্ত করো, মুক্ত করো নিন্দা-প্রশংসার
দুশ্ছেদ্য শৃঙ্খল হতে। সে কঠিন ভার
যদি খসে যায় তবে মানুষের মাঝে
সহজে ফিরিব আমি সংসারের কাজে–
তোমারি আদেশ শুধু জয়ী হবে নাথ।
তোমার চরণপ্রান্তে করি প্রণিপাত
তব দন্ড পুরস্কার অন্তরে গোপনে
লইব নীরবে তুলি–
নিঃশব্দ গমনে
চলে যাব কর্মক্ষেত্র-মাঝখান দিয়া
বহিয়া অসংখ্য কাজে একনিষ্ঠ হিয়া,
সঁপিয়া অব্যর্থ গতি সহস্র চেষ্টায়
এক নিত্য ভক্তিবলে, নদী যথা ধায়
লক্ষ লোকালয়-মাঝে নানা কর্ম সারি
সমুদ্রের পানে লয়ে বন্ধহীন বারি।
মৃত্যুও অজ্ঞাত মোর। আজি তার তরে
মৃত্যুও অজ্ঞাত মোর। আজি তার তরে
ক্ষণে ক্ষণে শিহরিয়া কাঁপিতেছি ডরে।
সংসারে বিদায় দিতে, আঁখি ছলছলি
জীবন আঁকড়ি ধরি আপনার বলি
দুই ভুজে।
ওরে মূঢ়, জীবন সংসার
কে করিয়া রেখেছিল এত আপনার
জনম-মুহূর্ত হতে তোমার অজ্ঞাতে,
তোমার ইচ্ছার পূর্বে? মৃত্যুর প্রভাতে
সেই অচেনার মুখ হেরিবি আবার
মুহূর্তে চেনার মতো। জীবন আমার
এত ভালোবাসি বলে হয়েছে প্রত্যয়,
মৃত্যুরে এমনি ভালো বাসিব নিশ্চয়।
স্তন হতে তুলে নিলে কাঁদে শিশু ডরে,
মুহূর্তে আশ্বাস পায় গিয়ে স্তনান্তরে।