নিশীথশয়নে ভেবে রাখি মনে
নিশীথশয়নে ভেবে রাখি মনে
ওগো অন্তরযামী,
প্রভাতে প্রথম নয়ন মেলিয়া
তোমারে হেরিব আমি,
ওগো অন্তরযামী।
জাগিয়া বসিয়া শুভ্র আলোকে
তোমার চরণে নমিয়া পুলকে
মনে ভেবে রাখি দিনের কর্ম
তোমারে সঁপিব স্বামী,
ওগো অন্তরযামী।
দিনের কর্ম সাধিতে সাধিতে
ক্ষণে ক্ষণে ভাবি মনে
কর্ম-অন্তে সন্ধ্যাবেলায়
বসিব তোমার সনে।
সন্ধ্যেবেলায় ভাবি বসে ঘরে
তোমার নিশীথবিরামসাগরে
শ্রান্ত প্রাণের ভাবনা বেদনা
নীরবে যাইবে নামি,
ওগো অন্তরযামী।
পতিত ভারতে তুমি কোন্ জাগরণে
পতিত ভারতে তুমি কোন্ জাগরণে
জাগাইবে, হে মহেশ, কোন্ মহাক্ষণে,
সে মোর কল্পনাতীত। কী তাহার কাজ,
কী তাহার শক্তি, দেব, কী তাহার সাজ,
কোন্ পথ তার পথ, কোন্ মহিমায়
দাঁড়াবে সে সম্পদের শিখরসীমায়
তোমার মহিমাজ্যোতি করিতে প্রকাশ
নবীন প্রভাতে!
আজি নিশার আকাশ
যে আদর্শে রচিয়াছে আলোকের মালা,
সাজায়েছে আপনার অন্ধকার-থালা,
ধরিয়াছে ধরিত্রীর মাথার উপর,
সে আদর্শ প্রভাতের নহে মহেশ্বর!
জাগিয়া উঠিবে প্রাচী যে অরুণালোকে
সে কিরণ নাই আজি নিশীথের চোখে।
পাঠাইলে আজি মৃত্যুর দূত
পাঠাইলে আজি মৃত্যুর দূত
আমার ঘরের দ্বারে,
তব আহ্বান করি সে বহন
পার হয়ে এল পারে।
আজি এ রজনী তিমির-আঁধার,
ভয়ভারাতুর হৃদয় আমার,
তবু দীপ হাতে খুলি দিয়া দ্বার
নমিয়া লইব তারে।
পাঠাইলে আজি মৃত্যুর দূত
আমার ঘরের দ্বারে।
পূজিব তাহারে জোড়-কর করি
ব্যাকুল নয়নজলে,
পূজিব তাহারে পরানের ধন
সঁপিয়া চরণতলে।
আদেশ পালন করিয়া তোমারি
যাবে সে আমার প্রভাত আঁধারি,
শূণ্যভবনে বসি তব পায়ে
অর্পিব আপনারে।
পাঠাইলে আজি মৃত্যুর দূত
আমার ঘরের দ্বারে।
প্রতিদিন আমি হে জীবনস্বামী
প্রতিদিন আমি হে জীবনস্বামী
দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে।
করি জোড়কর, হে ভুবনেশ্বর,
দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে।
তোমার অপার আকাশের তলে
বিজনে বিরলে হে–
নম্র হৃদয়ে নয়নের জলে
দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে।
তোমার বিচিত্র এ ভবসংসারে
কর্মপারাবারপারে হে,
নিখিলজগৎজনের মাঝারে
দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে।
তোমার এ ভবে মোর কাজ যবে
সমাপন হবে হে,
ওগো রাজরাজ, একাকী নীরবে
দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে।
আষাঢ় ১৩০৮
প্রতিদিন তব গাথা গাব আমি সুমধুর
প্রতিদিন তব গাথা
গাব আমি সুমধুর,
তুমি মোরে দাও কথা
তুমি মোরে দাও সুর।
তুমি যদি থাক মনে
বিকচ কমলাসনে,
তুমি যদি কর প্রাণ
তব প্রেমে পরিপূর–
প্রতিদিন তব গাথা
গাব আমি সুমধুর।
তুমি যদি শোন গান
আমার সমুখে থাকি,
সুধা যদি করে দান
তোমার উদার আঁখি,
তুমি যদি দুখ-‘পরে
রাখ হাত স্নেহভরে,
তুমি যদি সুখ হতে
দম্ভ করহ দূর–
প্রতিদিন তব গাথা
গাব আমি সুমধুর।
প্রভাতে যখন শঙ্খ উঠেছিল বাজি
প্রভাতে যখন শঙ্খ উঠেছিল বাজি
তোমার প্রাঙ্গনতলে, ভরি লয়ে সাজি
চলেছিল নরনারী তেয়াগিয়া ঘর
নবীন শিশিরসিক্ত গুঞ্জনমুখর
স্নিগ্ধবনপথ দিয়ে। আমি অন্যমনে
সঘনপল্লবপুঞ্জ ছায়াকুঞ্জবনে
ছিনু শুয়ে তৃণাস্তীর্ণ তরঙ্গিণীতীরে
বিহঙ্গের কলগীতে সুমন্দ সমীরে।
আমি যাই নাই দেব,তোমার পূজায়–
চেয়ে দেখি নাই পথে কারা চলে যায়।
আজ ভাবি ভালো হয়েছিল মোর ভুল,
তখন কুসুমগুলি আছিল মুকুল-
হেরো তারা সারা দিনে ফুটিতেছে আজি।
অপরাহ্নে ভরিলাম এ পূজার সাজি।
প্রার্থনা
চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির,
জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর
আপন প্রাঙ্গনতলে দিবসশর্বরী
বসুধারে রাখে নাই খণ্ড ক্ষুদ্র করি,
যেথা বাক্য হৃদয়ের উত্সমুখ হতে
উচ্ছ্বসিয়া উঠে, যেথা নির্বারিত স্রোতে
দেশে দেশে দিশে দিশে কর্মধারা ধায়
অজস্র সহস্রবিধ চরিতার্থতায়,
যেথা তুচ্ছ আচারের মরুবালুরাশি
বিচারের স্রোতঃপথ ফেলে নাই গ্রাসি—
পৌরুষেরে করে নি শতধা, নিত্য যেথা
তুমি সর্ব কর্ম চিন্তা আনন্দের নেতা,
নিজ হস্তে নির্দয় আঘাত করি, পিতঃ,
ভারতেরে সেই স্বর্গে করো জাগরিত॥
বাসনারে খর্ব করি দাও হে প্রাণেশ
বাসনারে খর্ব করি দাও হে প্রাণেশ।
সে শুধু সংগ্রাম করে লয়ে এক লেশ
বৃহতের সাথে। পণ রাখিয়া নিখিল
জিনিয়া নিতে সে চাহে শুধু এক তিল।
বাসনার ক্ষুদ্র রাজ্য করি একাকার
দাও মোরে সন্তোষের মহা অধিকার।
অযাচিত যে সম্পদ অজস্র আকারে
ঊষার আলোক হতে নিশার আঁধারে
জলে স্থলে রচিয়াছে অনন্ত বিভব–
সেই সর্বলভ্য সুখ অমূল্য দুর্লভ
সব চেয়ে। সে মহা সহজ সুখখানি
পূর্ণশতদলসম কে দিবে গো আনি
জলস্থল-আকাশের মাঝখান হতে,
ভাসাইয়া আপনারে সহজের স্রোতে!
বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি, সে আমার নয়
বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি, সে আমার নয়।
অসংখ্যবন্ধন-মাঝে মহানন্দময়
লভিব মুক্তির স্বাদ। এই বসুধার
মৃত্তিকার পাত্রখানি ভরি বারম্বার
তোমার অমৃত ঢালি দিবে অবিরত
নানাবর্ণগন্ধময়। প্রদীপের মতো
সমস্ত সংসার মোর লক্ষ বর্তিকায়
জ্বালায়ে তুলিবে আলো তোমারি শিখায়
তোমার মন্দির-মাঝে।
ইন্দ্রিয়ের দ্বার
রুদ্ধ করি যোগাসন,সে নহে আমার।
যে কিছু আনন্দ আছে দৃশ্যে গন্ধে গানে
তোমার আনন্দ রবে তার মাঝখানে।
মোহ মোর মুক্তিরূপে উঠিবে জ্বলিয়া,
প্রেম মোর ভক্তিরূপে রহিবে ফলিয়া।