তোমারে শতধা করি ক্ষুদ্র করি দিয়া
তোমারে শতধা করি ক্ষুদ্র করি দিয়া
মাটিতে লুটায় যারা তৃপ্ত-সুপ্ত হিয়া
সমস্ত ধরণী আজি অবহেলাভরে
পা রেখেছে তাহাদের মাথার উপরে।
মনুষ্যত্ব তুচ্ছ করি যারা সারাবেলা
তোমারে লইয়া শুধু করে পূজা-খেলা
মুগ্ধভাবভোগে, সেই বৃদ্ধ শিশুদল
সমস্ত বিশ্বের আজি খেলার পুত্তল।
তোমারে আপন-সাথে করিয়া সমান
যে খর্ব বামনগণ করে অবমান
কে তাদের দিবে মান! নিজ মন্ত্রস্বরে
তোমারেই প্রাণ দিতে যারা স্পর্ধা করে
কে তাদের দিবে প্রাণ! তোমারেও যারা
ভাগ করে, কে তাদের দিবে ঐক্যধারা!
ত্রাসে লাজে নতশিরে নিত্য নিরবধি
ত্রাসে লাজে নতশিরে নিত্য নিরবধি
অপমান অবিচার সহ্য করে যদি
তবে সেই দীন প্রাণে তব সত্য হায়
দন্ডে দন্ডে ম্লান হয়। দুর্বল আত্মায়
তোমারে ধরিতে নারে দৃঢ়নিষ্ঠাভরে।
ক্ষীণপ্রাণ তোমারেও ক্ষুদ্রক্ষীণ করে
আপনার মতো– যত আদেশ তোমার
পড়ে থাকে, আবেশে দিবস কাটে তার।
পুঞ্জ পুঞ্জ মিথ্যা আসি গ্রাস করে তারে
চতুর্দিকে। মিথ্যা মুখে, মিথ্যা ব্যবহারে,
মিথ্যা চিত্তে, মিথ্যা তার মস্তক মাড়ায়ে–
না পারে তাড়াতে তারে উঠিয়া দাঁড়ায়ে।
অপমানে নতশির ভয়ে-ভীত জন
মিথ্যারে ছাড়িয়া দেয় তব সিংহাসন।
দীর্ঘকাল অনাবৃষ্টি, অতি দীর্ঘকাল
দীর্ঘকাল অনাবৃষ্টি, অতি দীর্ঘকাল,
হে ইন্দ্র, হৃদয়ে মম। দিক্চক্রবাল
ভয়ংকার শূন্য হেরি, নাই কোনোখানে
সরস সজল রেখা– কেহ নাহি আনে
নববারিবর্ষনের শ্যামল সংবাদ।
যদি ইচ্ছা হয়, দেব, আনো বজ্রনাদ
প্রলয়মুখর হিংস্র ঝটিকার সাথে।
পলে পলে বিদ্যুতের বক্র কশাঘাতে
সচকিত করো মোর দিগ্দিগন্তর।
সংহরো সংহরো, প্রভো, নিস্তব্ধ প্রখর
এই রুদ্র, এই ব্যাপ্ত, এ নিঃশব্দ দাহ
নিঃসহ নৈরাশ্যতাপ। চাহো নাথ, চাহো
জননী যেমন চাহে সজল নয়ানে
পিতার ক্রোধের দিনে সন্তানের পানে।
দুর্গম পথের প্রান্তে পান্থশালা-‘পরে
দুর্গম পথের প্রান্তে পান্থশালা-‘পরে
যাহারা পড়িয়া ছিল ভাবাবেশভরে
রসপানে হতজ্ঞান,যাহারা নিয়ত
রাখে নাই আপনারে উদ্যত জাগ্রত–
মুগ্ধ মূঢ় জানে নাই বিশ্বযাত্রীদলে
কখন চলিয়া গেছে সুদূর অচলে
বাজায়ে বিজয়শঙ্খ! শুধু দীর্ঘ বেলা
তোমারে খেলনা করি করিয়াছে খেলা।
কর্মেরে করেছে পঙ্গু নিরর্থ আচারে,
জ্ঞানেরে করেছে হত শাস্ত্রকারাগারে,
আপন কক্ষের মাঝে বৃহৎ ভুবন
করেছে সংকীর্ণ রুধি দ্বার-বাতায়ন–
তারা আজ কাঁদিতেছে। আসিয়াছে নিশা–
কোথা যাত্রী, কোথা পথ, কোথায় রে দিশা!
দুর্দিন ঘনায়ে এল ঘন অন্ধকারে
দুর্দিন ঘনায়ে এল ঘন অন্ধকারে
হে প্রাণেশ। দিগ্বিদিক বৃষ্টিবারিধারে
ভেসে যায়, কুটিল কটাক্ষে হেসে যায়
নিষ্ঠুর বিদ্যুৎ-শিখা, উতরোল বায়
তুলিল উতলা করি অরণ্য কানন।
আজি তুমি ডাকো অভিসারে, হে মোহন,
হে জীবনস্বামী। অশ্রুসিক্ত বিশ্ব-মাঝে
কোনো দুঃখে, কোনো ভয়ে, কোনো বৃথা কাজে
রহিব না রুদ্ধ হয়ে। এ দীপ আমার
পিচ্ছিল তিমিরপথে যেন বারম্বার
নিবে নাহি যায়, যেন আর্দ্র সমীরণে
তোমার আহ্বান বাজে। দুঃখের বেষ্টনে
দুর্দিন রচিল আজি নিবিড় নির্জন,
হোক আজি তোমা-সাথে একান্ত মিলন।
দেহে আর মনে প্রাণে হয়ে একাকার
হে আর মনে প্রাণে হয়ে একাকার
একি অপরূপ লীলা এ অঙ্গে আমার!
একি জ্যোতি, একি ব্যোম দীপ্ত দীপ-জ্বালা
দিন আর রজনীর চিরনাট্যশালা!
একি শ্যাম বসুন্ধরা, সমুদ্রে চঞ্চল,
পর্বতে কঠিন, তরুপল্লবে কোমল,
অরণ্যে আঁধার! একি বিচিত্র বিশাল
অবিশ্রাম রচিতেছে সৃজনের জাল
আমার ইন্দ্রিয়যন্ত্রে ইন্দ্রজালবৎ!
প্রত্যেক প্রাণীর মাঝে প্রকাণ্ড জগৎ।
তোমারি মিলনশয্যা, হে মোর রাজন্,
ক্ষুদ্র এ আমার মাঝে অনন্ত আসন
অসীম বিচিত্রকান্ত। ওগো বিশ্বভূপ,
দেহে মনে প্রাণে আমি একি অপরূপ!
না গণি মনের ক্ষতি ধনের ক্ষতিতে
না গণি মনের ক্ষতি ধনের ক্ষতিতে
হে বরেণ্য, এই বর দেহো মোর চিতে।
যে ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ তোমার ভুবন
এই তৃণভূমি হতে সুদূর গগন
যে আলোকে, যে সংগীতে, যে সৌন্দর্যধনে,
তার মূল্য নিত্য যেন থাকে মোর মনে
স্বাধীন সবল শান্ত সরল সন্তোষ।
অদৃষ্টেরে কভু যেন নাহি দিই দোষ
কোনো দুঃখ কোনো ক্ষতি অভাবের তরে।
বিস্বাদ না জন্মে যেন বিশ্বচরাচরে
ক্ষুদ্র খন্ড হারাইয়া। ধনীর সমাজে
না হয় না হোক স্থান, জগতের মাঝে
আমার আসন যেন রহে সর্ব ঠাঁই,
হে দেব, একান্তচিত্তে এই বর চাই।
না বুঝেও আমি বুঝেছি তোমারে
না বুঝেও আমি বুঝেছি তোমারে
কেমনে কিছু না জানি।
অর্থের শেষ পাই না, তবুও
বুঝেছি তোমার বাণী।
নিশ্বাসে মোর নিমেষের পাতে
চেতনা বেদনা ভাবনাআঘাতে
কে দেয় সর্বশরীরে ও মনে
তব সংবাদ আনি।
না বুঝেও আমি বুঝেছি তোমারে
কেমনে কিছু না জানি।
তব রাজত্ব লোক হতে লোকে
সে বারতা আমি পেয়েছি পলকে,
হৃদি-মাঝে যবে হেরেছি তোমার
বিশ্বের রাজধানী।
না বুঝেও আমি বুঝেছি তোমারে
কেমনে কিছু না জানি।
আপনার চিতে নিবিড় নিভৃতে
যেথায় তোমারে পেয়েছি জানিতে
সেথায় সকলি স্থির নির্বাক্
ভাষা পরাস্ত মানি।
না বুঝেও আমি বুঝেছি তোমারে
কেমনে কিছু না জানি।
নির্জন শয়ন-মাঝে কালি রাত্রিবেলা
নির্জন শয়ন-মাঝে কালি রাত্রিবেলা
ভাবিতেছিলাম আমি বসিয়া একেলা
গতজীবনের কত কথা; হেন ক্ষণে
শুনিলাম তুমি কহিতেছ মোর মনে–
“ওরে মত্ত ওরে মুগ্ধ, ওরে আত্মভোলা,
রেখেছিলি আপনার সব দ্বার খোলা;
চঞ্চল এ সংসারের যত ছায়ালোক,
যত ভুল, যত ধূলি, যত দুঃখশোক,
যত ভালোমন্দ, যত গীতগন্ধ লয়ে
বিশ্ব পশেছিল তোর অবাধ আলয়ে।
সেই সাথে তোর মুক্ত বাতায়নে আমি
অজ্ঞাতে অসংখ্য বার এসেছিনু নামি।
দ্বার রুধি জপিতিস মোর নাম
কোন্ পথ দিয়ে তোর চিত্তে পশিতাম!”