তুমি সর্বাশ্রয়, এ কি শুধু শূন্যকথা
তুমি সর্বাশ্রয়, এ কি শুধু শূন্যকথা?
ভয় শুধু তোমা-‘পরে বিশ্বাসহীনতা
হে রাজন।
লোকভয়? কেন লোকভয়
লোকপাল? চিরদিবসের পরিচয়
কোন্ লোক সাথে?
রাজভয় কার তরে
হে রাজেন্দ্র? তুমি যার বিরাজ’ অন্তরে
লভে সে কারার মাঝে ত্রিভুবনময়
তব ক্রোড়, স্বাধীন সে বন্দিশালে।
মৃত্যুভয়
কী লাগিয়া হে অমৃত? দু দিনের প্রাণ
লুপ্ত হলে তখনি কি ফুরাইবে দান–
এত প্রাণদৈণ্য, প্রভু, ভাণ্ডারেতে তব?
সেই অবিশ্বাসে প্রাণ আঁকড়িয়া রব?
কোথা লোক, কোথা রাজা, কোথা ভয় কার!
তুমি নিত্য আছ, আমি নিত্য সে তোমার।
তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে
তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে
যত দূরে আমি যাই
কোথাও দুঃখ কোথাও মৃত্যু
কোথা বিচ্ছেদ নাই।
মৃত্যু সে ধরে মৃত্যুর রূপ,
দুঃখ সে হয় দুঃখের কূপ
তোমা হতে যবে স্বতন্ত্র হয়ে
আপনার পানে চাই।
হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে
যাহা-কিছুসব আছে আছে আছে–
নাই নাই ভয়, সে শুধু আমারি–
নিশিদিন কাঁদি তাই।
অন্তরগ্লানি সংসারভার
পলক ফেলিতে কোথা একাকার
তোমার স্বরূপ জীবনের মাঝে
রাখিবারে যদি পাই।
তোমার ইঙ্গিতখানি দেখি নি যখন
তোমার ইঙ্গিতখানি দেখি নি যখন
ধূলিমুষ্টি ছিল তারে করিয়া গোপন।
যখনি দেখেছি আজ, তখনি পুলকে
নিরখি ভুবনময় আঁধারে আলোকে
জ্বলে সে ইংগিত; শাখে শাখে ফুলে ফুলে
ফুটে সে ইঙ্গিত; সমুদ্রের কূলে কূলে
ধরিত্রীর তটে তটে চিহ্ন আঁকি ধায়
ফেনাঙ্কিত তরঙ্গের চূড়ায় চূড়ায়
দ্রুত সে ইঙ্গিত; শুভ্রশীর্ষ হিমাদ্রির
শৃঙ্গে শৃঙ্গে ঊর্ধ্বমুখে জাগি রহে স্থির
স্তব্ধ সে ইংগিত।
তখন তোমার পানে
বিমুখ হইয়া ছিনু কি লয়ে কে জানে!
বিপরীত মুখে তারে পড়েছিনু, তাই
বিশ্বজোড়া সে লিপির অর্থ বুঝি নাই।
তোমার ন্যায়ের দন্ড প্রত্যেকের করে
তোমার ন্যায়ের দন্ড প্রত্যেকের করে
অর্পণ করেছ নিজে। প্রত্যেকের ‘পরে
দিয়েছ শাসনভার হে রাজাধিরাজ।
সে গুরু সম্মান তব সে দুরূহ কাজ
নমিয়া তোমারে যেন শিরোধার্য করি
সবিনয়ে। তব কার্যে যেন নাহি ডরি
কভু কারে।
ক্ষমা যেথা ক্ষীণ দুর্বলতা,
হে রুদ্র, নিষ্ঠুর যেন হতে পারি তথা
তোমার আদেশে। যেন রসনায় মম
সত্যবাক্য ঝলি উঠে খরখড়গসম
তোমার ইঙ্গিতে। যেন রাখি তব মান
তোমার বিচারাসনে লয়ে নিজস্থান।
অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে।
তোমার পতাকা যারে দাও
তোমার পতাকা যারে দাও, তারে
বহিবারে দাও শকতি।
তোমার সেবায়ে মহৎ প্রয়াস
সহিবারে দাও ভকতি।
আমি তাই চাই ভরিয়া পরান
দুঃখেরি সাথে দুঃখেরি ত্রাণ
তোমার হাতের বেদনার দান
এড়িয়ে চাহি না মুকতি।
দুখ হবে মোর মাথার মানিক
সাথে যদি দাও ভকতি।
যত দিতে চাও কাজ দিয়ো,যদি
তোমারে না দাও ভুলিতে–
অন্তর যদি জড়াতে না দাও
জালজঞ্জালগুলিতে।
বাঁধিয়ো আমায় যত খুশি ডোরে
মুক্ত রাখিয়ো তোমা-পানে মোরে,
ধুলায় রাখিয়ো পবিত্র ক’রে
তোমার চরণধূলিতে।
ভুলায় রাখিয়ো সংসারতলে,
তোমারে দিয়ো না ভুলিতে।
যে পথে ঘুরিতে দিয়েছ ঘুরিব,
যাই যেন তব চরণে।
সব শ্রম যেন বহি লয় মোরে
সকল-শ্রান্তি-হরণে।
দুর্গমপথ এ ভবগহন,
কত ত্যাগ শোক বিরহদহন–
জীবনে মরণ করিয়া বহন
প্রাণ পাই যেন মরণে।
সন্ধ্যাবেলায় লভি গো কুলায়
নিখিলশরণ চরণে।
তোমার ভুবন-মাঝে ফিরি মুগ্ধসম
তোমার ভুবন-মাঝে ফিরি মুগ্ধসম
হে বিশ্বমোহন নাথ। চক্ষে লাগে মম
প্রশান্ত আনন্দঘন অনন্ত আকাশ;
শরৎমধ্যাহ্নে পূর্ণ সুবর্ণ উচ্ছ্বাস
আমার শিরার মাঝে করিয়া প্রবেশ
মিশায় রক্তের সাথে আতপ্ত আবেশ।
ভুলায় আমারে সবে। বিচিত্র ভাষায়
তোমার সংসার মোরে কাঁদায় হাসায়;
তব নরনারী সবে দিগ্বিদিকে মোরে
টেনে নিয়ে যায় কত বেদনার ডোরে,
বাসনার টানে। সেই মোর মুগ্ধ মন
বীণাসম তব অঙ্কে করিনু অর্পণ–
তার শত মোহতন্ত্রে করিয়া আঘাত
বিচিত্র সংগীত তব জাগাও হে নাথ।
তোমারি রাগিনী জীবনকুঞ্জে
তোমারি রাগিনী জীবনকুঞ্জে
বাজে যেন সদা বাজে গো।
তোমারি আসন হৃদয়পদ্মে
রাজে যেন সদা রাজে গো।
তব নন্দনগন্ধমোদিত
ফিরি সুন্দর ভুবনে
তব পদরেণু মাখি লয়ে তনু
সাজে যেন সদা সাজে গো।
তোমারি রাগিণী জীবনকুঞ্জে
বাজে যেন সদা বাজে গো।
সব বিদ্বেষ দূরে যায় যেন
তব মঙ্গলমন্ত্রে,
বিকাশে মাধুরী হৃদয়ে বাহিরে
তব সংগীতছন্দে।
তব নির্মল নীরব হাস্য
হেরি অম্বর ব্যাপিয়া
তব গৌরবে সকল গর্ব
লাজে যেন সদা লাজে গো।
তোমারি রাগিণী জীবনকুঞ্জে
বাজে যেন সদা বাজে গো।
তোমারে বলেছে যারা পুত্র হতে প্রিয়
তোমারে বলেছে যারা পুত্র হতে প্রিয়,
বিত্ত হতে প্রিয়তর, যা-কিছু আত্মীয়
সব হতে প্রিয়তম নিখিল ভুবনে,
আত্মার অন্তরতর, তাদের চরণে
পাতিয়া রাখিতে চাহি হৃদয় আমার।
সে সরল শান্ত প্রেম গভীর উদার–
সে নিশ্চিত নিঃসংশয়,সেই সুনিবিড়
সহজ মিলনাবেগ, সেই চিরস্থির
আত্মার একাগ্র লক্ষ্য, সেই সর্ব কাজে
সহজেই সঞ্চরণ সদা তোমা-মাঝে
গম্ভীর প্রশান্ত চিত্তে, হে অন্তরযামী,
কেমনে করিব লাভ? পদে পদে আমি
প্রেমের প্রবাহ তব সহজ বিশ্বাসে
অন্তরে টানিয়া লব নিশ্বাসে নিশ্বাসে।