তখন করি নি, নাথ, কোনো আয়োজন
তখন করি নি, নাথ, কোনো আয়োজন;
বিশ্বের সবার সাথে, হে বিশ্বরাজন,
অজ্ঞাতে আসিতে হাসি আমার অন্তরে
কত শুভদিনে; কত মুহূর্তের ‘পরে
অসীমের চিহ্ন লিখে গেছ! লই তুলি
তোমার স্বাক্ষর-আঁকা সেই ক্ষণগুলি–
দেখি তারা স্মৃতি-মাঝে আছিল ছড়ায়ে
কত-না ধূলির সাথে,আছিল জড়ায়ে
ক্ষণিকের কত তুচ্ছ সুখদুঃখ ঘিরে!
হে নাথ, অবজ্ঞা করি যাও নাই ফিরে
আমার সে ধুলাস্তূপ খেলাঘর দেখে!
খেলা-মাঝে শুনিতে পেয়েছি থেকে থেকে
যে চরণধ্বনি–আজ শুনি তাই বাজে
জগৎসংগীত-সাথে চন্দ্রসূর্য-মাঝে।
তব কাছে এই মোর শেষ নিবেদন
তব কাছে এই মোর শেষ নিবেদন–
সকল ক্ষীণতা মম করহ ছেদন
দৃঢ়বলে, অন্তরের অন্তর হইতে
প্রভু মোর। বীর্য দেহো সুখের সহিতে,
সুখেরে কঠিন করি। বীর্য দেহো দুখে,
যাহে দুঃখ আপনারে শান্তস্মিত মুখে
পারে উপেক্ষিতে। ভকতিরে। বীর্য দেহো
কর্মে যাহে হয় সে সফল, প্রীতি স্নেহ
পুণ্যে ওঠে ফুটি। বীর্য দেহো ক্ষুদ্র জনে
না করিতে হীনজ্ঞান, বলের চরণে
না লুটিতে। বীর্য দেহো চিত্তেরে একাকী
প্রত্যহের তুচ্ছতার ঊর্ধ্বে দিতে রাখি।
বীর্য দেহো তোমার চরণে পাতি শির
অহর্নিশি আপনারে রাখিবারে স্থির।
তব চরণের আশা, ওগো মহারাজ
তব চরণের আশা, ওগো মহারাজ,
ছাড়ি নাই। এত যে হীনতা, এত লাজ,
তবু ছাড়ি নাই আশা। তোমার বিধান
কেমনে কী ইন্দ্রজাল করে যে নির্মাণ
সংগোপনে সবার নয়ন-অন্তরালে
কেহ নাহি জানে। তোমার নির্দিষ্ট কালে
মুহূর্তেই অসম্ভব আসে কোথা হতে
আপনারে ব্যক্ত করি আপন আলোতে
চিরপ্রতীক্ষিত চিরসম্ভবের বেশে।
আছ তুমি অন্তর্যামী এ লজ্জিত দেশে–
সবার অজ্ঞাতসারে হৃদয়ে হৃদয়ে
গৃহে গৃহে রাত্রিদিন জাগরূক হয়ে
তোমার নিগূঢ় শক্তি করিতেছে কাজ।
আমি ছাড়ি নাই আশা, ওগো মহারাজ!
তব পূজা না আনিলে দণ্ড দিবে তারে
তব পূজা না আনিলে দণ্ড দিবে তারে,
যমদূত লয়ে যাবে নরকের দ্বারে–
ভক্তিহীনে এই বলি যে দেখায় ভয়
তোমার নিন্দুক সে যে, ভক্ত কভু নয়।
হে বিশ্বভুবনরাজ, এ বিশ্বভুবনে
আপনারে সব চেয়ে রেখেছ গোপনে
আপন মহিমা-মাঝে। তোমার সৃষ্টির
ক্ষুদ্র বালুকণাটুকু,ক্ষণিক শিশির
তারাও তোমার চেয়ে প্রত্যক্ষ আকারে
দিকে দিকে ঘোষণা করিছে আপনারে।
যা-কিছু তোমারি তাই আপনার বলি
চিরদিন এ সংসার চলিয়াছে ছলি–
তবু সে চোরের চৌর্য পড়ে না তো ধরা।
আপনারে জানাইতে নাই তব ত্বরা।
তব প্রেমে ধন্য তুমি করেছ আমারে
তব প্রেমে ধন্য তুমি করেছ আমারে
প্রিয়তম। তবু শুধু মাধুর্য-মাঝারে
চাহি না নিমগ্ন করে রাখিতে হৃদয়।
আপনি যেথায় ধরা দিলে, স্নেহময়,
বিচিত্র সৌন্দর্যডোরে কত স্নেহে প্রেমে,
কত রূপে–সেথা আমি রহিব না থেমে
তোমার প্রণয়-অভিমানে। চিত্তে মোর
জড়ায়ে বাঁধিব নাকো সন্তোষের ডোর।
আমার অতীত তুমি যেথা, সেইখানে
অন্তরাত্মা ধায় নিত্য অনন্তের টানে
সকল বন্ধন-মাঝে– যেথায় উদার
অন্তহীন শক্তি আর মুক্তির বিস্তার।
তোমার মাধুর্য যেন বেঁধে নাহি রাখে,
তব ঐশ্বর্যের পানে টানে সে আমাকে।
তাঁরি হস্ত হতে নিয়ো তব দুঃখভার
তাঁরি হস্ত হতে নিয়ো তব দুঃখভার,
হে দুঃখী, হে দীনহীন। দীনতা তোমার
ধরিবে ঐশ্বর্যদীপ্তি, যদি নত রহে
তাঁরি দ্বারে। আর কেহ নহে নহে নহে,
তিনি ছাড়া আর কেহ নাই ত্রিসংসারে
যার কাছে তব শির লুটাইতে পারে।
পিতৃরূপে রয়েছেন তিনি, পিতৃ-মাঝে
নমি তাঁরে। তাঁহারি দক্ষিণ হস্ত রাজে
ন্যায়দন্ড-‘পরে, নতশিরে লই তুলি
তাহার শাসন। তাঁরি চরণ-অঙ্গুলি
আছে মহত্ত্বের ‘পরে, মহতের দ্বারে
আপনারে নম্র ক’রে পূজা করি তাঁরে।
তাঁরি হস্তস্পর্শরূপে করি অনুভব
মস্তকে তুলিয়া লই দুঃখের গৌরব।
তাঁহারা দেখিয়াছেন– বিশ্ব চরাচর
তাঁহারা দেখিয়াছেন– বিশ্ব চরাচর
ঝরিছে আনন্দ হতে আনন্দনির্ঝর।
অগ্নির প্রত্যেক শিখা ভয়ে তব কাঁপে,
বায়ুর প্রত্যেক শ্বাস তোমারি প্রতাপে,
তোমারি আদেশ বহি মৃত্যু দিবারাত
চরাচর মর্মরিয়া করে যাতায়াত।
গিরি উঠিয়াছে ঊর্ধ্বে তোমারি ইঙ্গিতে,
নদী ধায় দিকে দিকে তোমারি সংগীতে।
শূন্যে শূন্যে চন্দ্রসূর্য গ্রহতারা যত
অনন্ত প্রাণের মাঝে কাঁপিছে নিয়ত।
তাঁহারা ছিলেন নিত্য এ বিশ্ব-আলয়ে
কেবল তোমারি ভয়ে, তোমারি নির্ভয়ে–
তোমারি শাসনগর্বে দীপ্ততৃপ্তমুখে
বিশ্বভুবনেশ্বরের চক্ষুর সম্মুখে।
তুমি তবে এসো নাথ, বোসো শুভক্ষণে
তুমি তবে এসো নাথ, বোসো শুভক্ষণে
দেহে মনে গাঁথা এই মহা সিংহাসনে।
মোর দু নয়নে ব্যাপ্ত এই নীলাম্বরে
কোনো শূন্য রাখিয়ো না আর-কারো তরে,
আমার সাগরে শৈলে কান্তারে কাননে,
আমার হৃদয়ে দেহে; সজনে নির্জনে।
জ্যোৎস্নাসুপ্ত নিশীথের নিস্তব্ধ প্রহরে
আনন্দে বিষাদে গাঁথা ছায়ালোক-‘পরে
বোসো তুমি মাঝখানে। শান্তিরস দাও
আমার অশ্রুর জলে,শ্রীহস্ত বুলাও
সকল স্মৃতির ‘পরে, প্রেয়সীর প্রেমে
মধুর মঙ্গলরূপে তুমি এসো নেমে।
সকল সংসারবন্ধে বন্ধনবিহীন
তোমার মহান মুক্তি থাক্ রাত্রিদিন।
তুমি মোরে অর্পিয়াছ যত অধিকার
তুমি মোরে অর্পিয়াছ যত অধিকার
ক্ষুণ্ন না করিয়া কভু কণামাত্র তার
সম্পূর্ণ সঁপিয়া দিব তোমার চরণে
অকুণ্ঠিত রাখি তারে বিপদে মরণে।
জীবন সার্থক হবে তবে।
চিরদিন
জ্ঞান যেন থাকে মুক্ত শৃঙ্খলাবিহীন।
ভক্তি যেন ভয়ে নাহি হয় পদানত
পৃথিবীর কারো কাছে। শুভচেষ্টা যত
কোনো বাধা নাহি মানে কোনো শক্তি হতে
আত্মা যেন দিবারাত্রি অবারিত স্রোতে
সকল উদ্যম লয়ে ধায় তোমা-পানে
সর্ব বন্ধ টুটি। সদা লেখা থাকে প্রাণে
“তুমি যা দিয়েছ মোরে অধিকারভার
তাহা কেড়ে নিতে দিলে অমান্য তোমার।’