কাব্যের কথা বাঁধা পড়ে যথা
কাব্যের কথা বাঁধা পড়ে যথা
ছন্দের বাঁধনে,
পরানে তোমায় ধরিয়া রাখিব
সেইমতো সাধনে।
কাঁপায়ে আমার হৃদয়ের সীমা
বাজিবে তোমার অসীম মহিমা,
চিরবিচিত্র আনন্দরূপে
ধরা দিবে জীবনে
কাব্যের কথা বাঁধা পড়ে যথা
ছন্দের বাঁধনে।
আমার তুচ্ছ দিনের কর্মে
তুমি দিবে গরিমা,
আমার তনুর অণুতে অণুতে
রবে তব প্রতিমা।
সকল প্রেমের স্নেহের মাঝারে
আসন সঁপিব হৃদয়রাজারে,
অসীম তোমার ভুবনে রহিয়া
রবে মম ভবনে,
কাব্যের কথা বাঁধা রহে যথা
ছন্দের বাঁধনে।
কারে দূর নাহি কর। যত করি দান
কারে দূর নাহি কর। যত করি দান
তোমারে হৃদয় মন, তত হয় স্থান
সবারে লইতে প্রাণে। বিদ্বেষ যেখানে
দ্বার হতে কারেও তাড়ায় অপমানে
তুমি সেই সাথে যাও; যেথা অহংকার
ঘৃণাভরে ক্ষুদ্রজনে রুদ্ধ করে দ্বার
সেথা হতে ফির তুমি; ঈর্ষা চিত্তকোণে
বসি বসি ছিদ্র করে তোমারি আসনে
তপ্ত শূলে। তুমি থাক,যেথায় সবাই
সহজে খুঁজিয়া পায় নিজ নিজ ঠাঁই।
ক্ষুদ্র রাজা আসে যবে, ভৃত্য উচ্চরবে
হাঁকি কহে, “সরে যাও, দূরে যাও সবে।’
মহারাজ তুমি যবে এস, সেই সাথে
নিখিল জগৎ আসে তোমারি পশ্চাতে।
কালি হাস্যে পরিহাসে গানে আলোচনে
কালি হাস্যে পরিহাসে গানে আলোচনে
অর্ধরাত্রি কেটে গেল বন্ধুজন-সনে;
আনন্দের নিদ্রাহারা শ্রান্তি বহে লয়ে
ফিরি আসিলাম যবে নিভৃত আলয়ে
দাঁড়াইনু আঁধার অঙ্গনে। শীতবায়
বুলালো স্নেহের হস্ত তপ্ত ক্লান্ত গায়
মুহূর্তে চঞ্চল রক্তে শান্তি আনি দিয়া।
মুহূর্তেই মৌন হল স্তব্ধ হল হিয়া
নির্বাণপ্রদীপ রিক্ত নাট্যশালা-সম।
চাহিয়া দেখিনু ঊর্ধ্বপানে; চিত্ত মম
মুহূর্তেই পার হয়ে অসীম রজনী
দাঁড়ালো নক্ষত্রলোকে।
হেরিনু তখনি–
খেলিতেছিলাম মোরা অকুণ্ঠিতমনে
তব স্তব্ধ প্রাসাদের অনন্ত প্রাঙ্গণে।
কোথা হতে আসিয়াছি নাহি পড়ে মনে
কোথা হতে আসিয়াছি নাহি পড়ে মনে
অগণ্য যাত্রীর সাথে তীর্থদরশনে
এই বসুন্ধরাতলে; লাগিয়াছে তরী
নীলাকাশ সমুদ্রের ঘাটের উপরি।
শুনা যায় চারি দিকে দিবসরজনী
বাজিতেছে বিরাট সংসার-শঙ্খধ্বনি
লক্ষ লক্ষ জীবন-ফুৎকারে। এত বেলা
যাত্রী নরনারী-সাথে করিয়াছি মেলা
পুরীপ্রান্তে পান্থশালা-‘পরে। স্নানে পানে
অপরাহ্ন হয়ে এল গল্পে হাসিগানে–
এখন মন্দিরে তব এসেছি, হে নাথ,
নির্জনে চরণতলে করি প্রণিপাত
এ জন্মের পূজা সমাপিব। তার পর
নবতীর্থে যেতে হবে হে বসুধেশ্বর।
কোরো না কোরো না লজ্জা হে ভারতবাসী
কোরো না কোরো না লজ্জা হে ভারতবাসী,
শক্তিমদমত্ত ওই বণিক বিলাসী
ধনদৃপ্ত পশ্চিমের কটাক্ষসম্মুখে
শুভ্র উত্তরীয় পরি শান্ত সৌম্যমুখে
সরল জীবনখানি করিতে বহন।
শুনো না কী বলে তারা; তব শ্রেষ্ঠ ধন
থাকুক হৃদয়ে তব, থাক্ তারা ঘরে,
থাক্ তাহা সুপ্রসন্ন ললাটের ‘পরে
অদৃশ্য মুকুট তব। দেখিতে যা বড়ো,
চক্ষে যাহা স্তূপাকার হইয়াছে জড়ো,
তারি কাছে অভিভূত হয়ে বারে বারে
লুটায়ো না আপনায়। স্বাধীন আত্মারে
দারিদ্র৻ের সিংহাসনে করো প্রতিষ্ঠিত
রিক্ততার অবকাশে পূর্ণ করি চিত।
ক্রমে ম্লান হয়ে আসে নয়নের জ্যোতি
ক্রমে ম্লান হয়ে আসে নয়নের জ্যোতি
নয়নতারায়; বিপুলা এ বসুমতী
ধীরে মিলাইয়া আসে ছায়ার মতন
লয়ে তার সিন্ধু শৈল কান্তার কানন।
বিচিত্র এ বিশ্বগান ক্ষীণ হয়ে বাজে
ইন্দ্রিয়বীণার সূক্ষ্ম শততন্ত্রী-মাঝে;
বর্ণে বর্ণে সুরঞ্জিত বিশ্বচিত্রখানি
ধীরে ধীরে মৃদু হস্তে লও তুমি টানি
সর্বাঙ্গ হৃদয় হতে; দীপ্ত দীপাবলী
ইন্দ্রিয়ের দ্বারে দ্বারে ছিল যা উচ্ছলি
দাও নিবাইয়া; তার পরে অর্ধরাতে
যে নির্মল মৃত্যুশয্যা পাতো নিজহাতে–
সে বিশ্বভুবনহীন নিঃশব্দ আসনে
একা তুমি বোসো আসি পরম নির্জনে।
ঘাটে বসে আছি আনমনা
ঘাটে বসে আছি আনমনা,
যেতেছে বহিয়া সুসময়।
এ বাতাসে তরী ভাসাব না
তোমা-পানে যদি নাহি বয়।
দিন যায় ওগো দিন যায়,
দিনমণি যায় অস্তে।
নাহি হেরি বাট, দূরতীরে মাঠ
ধূসর গোধূলিধূলিময়।
ঘরের ঠিকানা হল না গো,
মন করে তবু যাই-যাই।
ধ্রুবতারা তুমি যেথা জাগ’
সে দিকের পথ চিনি নাই।
এত দিন তরী বাহিলাম,
বাহিলাম তরী যে পথে,
শতবার তরী ডুবুডুবু করি
সে পথে ভরসা নাহি পাই।
তীর-সাথে হেরো শত ডোরে
বাঁধা আছে মোর তরীখান।
রশি খুলে দেবে কবে মোরে,
ভাসিতে পারিলে বাঁচে প্রাণ।
কোথা বুক-জোড়া খোলা হাওয়া,
সাগরের খোলা হাওয়া কই!
কোথা মহাগান ভরি দিবে কান,
কোথা সাগরের মহাগান!
জীবনে আমার যত আনন্দ
জীবনে আমার যত আনন্দ
পেয়েছি দিবসরাত
সবার মাঝারে তোমারে আজিকে
স্মরিব জীবননাথ।
যেদিন তোমার জগৎ নিরখি
হরষে পরান উঠেছে পুলকি
সেদিন আমার নয়নে হয়েছে
তোমারি নয়নপাত।
সব আনন্দ-মাঝারে তোমারে
স্মরিব জীবননাথ।
বার বার তুমি আপনার হাতে
স্বাদে গন্ধে ও গানে
বাহির হইতে পরশ করেছ
অন্তর-মাঝখানে।
পিতা মাতা ভ্রাতা প্রিয় পরিবার,
মিত্র আমার, পুত্র আমার,
সকলের সাথে হৃদয়ে প্রবেশি
তুমি আছো মোর সাথ।
সব আনন্দ-মাঝারে তোমারে
স্মরিব জীবননাথ।
জীবনের সিংহদ্বারে পশিনু যে ক্ষণে
জীবনের সিংহদ্বারে পশিনু যে ক্ষণে
এ আশ্চর্য সংসারের মহানিকেতনে,
সে ক্ষণ অজ্ঞাত মোর। কোন্ শক্তি মোরে
ফুটাইল এ বিপুল রহস্যের ক্রোড়ে
অর্ধরাত্রে মহারণ্যে মুকুলের মতো?
তবু তো প্রভাতে শির করিয়া উন্নত
যখনি নয়ন মেলি নিরখিনু ধরা
কনককিরণ-গাঁথা নীলাম্বর-পরা।
নিরখিনু সুখে-দুঃখে-খচিত সংসার,
তখনি অজ্ঞাত এই রহস্য অপার
নিমেষেই মনে হল মাতৃবক্ষসম
নিতান্তই পরিচিত, একান্তই মম।
রূপহীন জ্ঞানাতীত ভীষণ শকতি
ধরেছে আমার কাছে জননী-মুরতি।