এ কথা স্মরণে রাখা কেন গো কঠিন
এ কথা স্মরণে রাখা কেন গো কঠিন
তুমি আছ সব চেয়ে, আছ নিশিদিন,
আছ প্রতি ক্ষণে–আছ দূরে, আছ কাছে,
যাহা-কিছু আছে, তুমি আছ ব’লে আছে।
যেমনি প্রবেশ আমি করি লোকালয়ে,
যখনি মানুষ আসে স্তুতিনিন্দা লয়ে–
লয়ে রাগ, লয়ে দ্বেষ, লয়ে গর্ব তার
অমনি সংসার ধরে পর্বত-আকার
আবরিয়া ঊর্ধ্বলোক; তরঙ্গিয়া উঠে
লাভজয় লোভক্ষোভ; নরের মুকুটে
যে হীরক জ্বলে তারি আলোক-ঝলকে
অন্য আলো নাহি হেরি দ্যুলোকে ভূলোকে।
মানুষ সম্মুখে এলে কেন সেই ক্ষণে
তোমার সম্মুখে আছি নাহি পড়ে মনে?
এ দুর্ভাগ্য দেশ হতে হে মঙ্গলময়
এ দুর্ভাগ্য দেশ হতে হে মঙ্গলময়,
দূর করে দাও তুমি সর্ব তুচ্ছ ভয়–
লোকভয়, রাজভয়, মৃত্যুভয় আর।
দীনপ্রাণ দুর্বলের এ পাষাণভার,
এই চিরপেষণযন্ত্রণা, ধূলিতলে
এই নিত্য অবনতি, দণ্ডে পলে পলে
এই আত্ম-অবমান,অন্তরে বাহিরে
এই দাসত্বের রজ্জু, ত্রস্ত নতশিরে
সহস্রের পদপ্রান্ততলে বারম্বার
মনুষ্যমর্যাদাগর্ব চিরপরিহার–
এ বৃহৎ লজ্জারাশি চরণ-আঘাতে
চূর্ণ করি দূর করো। মঙ্গলপ্রভাতে
মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে
উদার আলোক-মাঝে উন্মুক্ত বাতাসে।
এ নদীর কলধ্বনি যেথায় বাজে না
এ নদীর কলধ্বনি যেথায় বাজে না
মাতৃকলকণ্ঠসম, যেথায় সাজে না
কোমলা উর্বরা ভূমি নবনবোৎসবে
নবীন-বরন বস্ত্রে যৌবনগৌরবে
বসন্তে শরতে বরষায়, রুদ্ধাকাশ
দিবস-রাত্রিরে যেথা করে না প্রকাশ
পূর্ণপ্রস্ফুটিতরূপে, যেথা মাতৃভাষা
চিত্ত-অন্তঃপুরে নাহি করে যাওয়া-আসা
কল্যাণী হৃদয়লক্ষ্মী, যেথা নিশিদিন
কল্পনা ফিরিয়া আসে পরিচয়হীন
পরগৃহদ্বার হতে পথের মাঝারে–
সেখানেও যাই যদি, মন যেন পারে
সহজে টানিয়া নিতে অন্তহীন স্রোতে
তব সদানন্দধারা সর্ব ঠাঁই হতে।
এ মৃত্যু ছেদিতে হবে, এই ভয়জালে
এ মৃত্যু ছেদিতে হবে, এই ভয়জালে,
এই পুঞ্জপুঞ্জীভূত জড়ের জঞ্জালে,
মৃত আবর্জনা। ওরে, জাগিতেই হবে
এ দীপ্ত প্রভাতকালে, এ জাগ্রত ভবে
এই কর্মধামে। দুই নেত্র করি আঁধা
জ্ঞানে বাধা, কর্মে বাধা, গতিপথে বাধা,
আচারে বিচারে বাধা, করি দিয়া দূর
ধরিতে হইবে মুক্ত বিহঙ্গের সুর
আনন্দে উদার উচ্চ।
সমস্ত তিমির
ভেদ করি দেখিতে হইবে ঊর্দ্ধশির
এক পূর্ণ জ্যোতির্ময়ে অনন্ত ভুবনে।
ঘোষণা করিতে হবে অসংশয়মনে–
“ওগো দিব্যধামবাসী দেবগণ যত,
মোরা অমৃতের পুত্র তোমাদের মতো।’
এই পশ্চিমের কোণে রক্তরাগরেখা
এই পশ্চিমের কোণে রক্তরাগরেখা
নহে কভু সৌম্যরশ্মি অরুণের লেখা
তব নব প্রভাতের। এ শুধু দারুণ
সন্ধ্যার প্রলয়দীপ্তি। চিতার আগুন
পশ্চিমসমুদ্রতটে করিছে উদ্গার
বিস্ফুলিঙ্গ, স্বার্থদীপ্ত লুব্ধ সভ্যতার
মশাল হইতে লয়ে শেষ অগ্নিকণা।
এই শ্মশানের মাঝে শক্তির সাধনা
তব আরাধনা নহে হে বিশ্বপালক।
তোমার নিখিলপ্লাবী আনন্দ-আলোক
হয়তো লুকায়ে আছে পূর্বসিন্ধুতীরে
বহু ধৈর্যে নম্র স্তব্ধ দুঃখের তিমিরে
সর্বরিক্ত অশ্রুসিক্ত দৈন্যের দীক্ষায়
দীর্ঘকাল, ব্রাহ্ম মুহূর্তের প্রতীক্ষায়।
একদা এ ভারতের কোন্ বনতলে
একদা এ ভারতের কোন্ বনতলে
কে তুমি মহান্ প্রাণ, কী আনন্দবলে
উচ্চারি উঠিলে উচ্চে– “শোনো বিশ্বজন,
শোনো অমৃতের পুত্র যত দেবগণ
দিব্যধামবাসী, আমি জেনেছি তাঁহারে,
মহান্ত পুরুষ যিনি আঁধারের পারে
জ্যোতির্ময়। তাঁরে জেনে, তাঁর পানে চাহি
মৃত্যুরে লঙ্ঘিতে পারো, অন্য পথ নাহি।’
আরবার এ ভারতে কে দিবে গো আনি
সে মহা আনন্দমন্ত্র, সে উদাত্তবাণী
সঞ্জীবনী, স্বর্গে মর্তে সেই মৃত্যুঞ্জয়
পরম ঘোষণা, সেই একান্ত নির্ভয়
অনন্ত অমৃতবার্তা।
রে মৃত ভারত,
শুধু সেই এক আছে, নাহি অন্য পথ।
একাধারে তুমিই আকাশ, তুমি নীড়
একাধারে তুমিই আকাশ, তুমি নীড়।
হে সুন্দর, নীড়ে তব প্রেম সুনিবিড়
প্রতি ক্ষণে নানা বর্ণে নানা গন্ধে গীতে
মুগ্ধ প্রাণ বেষ্টন করেছে চারি ভিতে।
সেথা ঊষা ডান হাতে ধরি স্বর্ণথালা
নিয়ে আসে একখানি মাধুর্যের মালা
নীরবে পরায়ে দিতে ধরার ললাটে;
সন্ধ্যা আসে নম্রমুখে ধেনুশূন্য মাঠে
চিহ্নহীন পথ দিয়ে লয়ে স্বর্ণঝারি
পশ্চিমসমুদ্র হতে ভরি শান্তিবারি।
তুমি যেথা আমাদের আত্মার আকাশ,
অপার সঞ্চারক্ষেত্র, সেথা শুভ্র ভাস;
দিন নাই, রাত নাই, নাই জনপ্রাণী,
বর্ণ নাই, গন্ধ নাই–নাই নাই বাণী।
ওরে মৌনমূক, কেন আছিস নীরবে
ওরে মৌনমূক, কেন আছিস নীরবে
অন্তর করিয়া রুদ্ধ? এ মুখর ভবে
তোর কোনো কথা নাই রে আনন্দহীন?
কোনো সত্য পড়ে নাই চোখে? ওরে দীন,
কণ্ঠে নাই কোনো সংগীতের নব তান?
তোর গৃহপ্রান্ত চুম্বি সমুদ্র মহান
গাহিছে অনন্ত গাথা, পশ্চিমে পুরবে
কত নদী নিরবধি ধায় কলরবে
তরলসংগীতধারা হয়ে মূর্তিমতী।
শুধু তুমি দেখ নাই সে প্রত্যক্ষ জ্যোতি
যাহা সত্যে যাহা গীতে আনন্দে আশায়
ফুটে উঠে নব নব বিচিত্র ভাষায়।
তব সত্য তব গান রুদ্ধ হয়ে রাজে
রাত্রিদিন জীর্ণশাস্ত্রে শুষ্কপত্র-মাঝে!
কত-না তুষারপুঞ্জ আছে সুপ্ত হয়ে
কত-না তুষারপুঞ্জ আছে সুপ্ত হয়ে
অগ্রভেদী হিমাদ্রির সুদূর আলয়ে
পাষাণপ্রাচীর-মাঝে। হে সিন্ধু মহান,
তুমি তো তাদের কারে কর না আহ্বান
আপন অতল হতে। আপনার মাঝে
আছে তারা অবরুদ্ধ, কানে নাহি বাজে
বিশ্বের সংগীত।
প্রভাতের রৌদ্রকরে
যে তুষার বয়ে যায়, নদী হয়ে ঝরে,
বন্ধ টুটি ছুটি চলে,হে সিন্ধু মহান,
সেও তো শোনে নি কভু তোমার আহ্বান।
সে সুদূর গঙ্গোত্রীর শিখরচূড়ায়
তোমার গম্ভীর গান কে শুনিতে পায়!
আপন স্রোতের বেগে কী গভীর টানে
তোমারে সে খুঁজে পায় সেই তাহা জানে।