আবার আমার হাতে বীণা দাও তুলি
আবার আমার হাতে বীণা দাও তুলি,
আবার আসুক ফিরে হারা গানগুলি।
সহসা কঠিন শীতে মানসের জলে
পদ্মবন মরে যায়, হংস দলে দলে
সারি বেঁধে উড়ে যায় সুদূর দক্ষিণে
জনহীন কাশফুল্ল নদীর পুলিনে;
আবার বসন্তে তারা ফিরে আসে যথা
বহি লয়ে আনন্দের কলমুখরতা–
তেমনি আমার যত উড়ে-যাওয়া গান
আবার আসুক ফিরে, মৌন এ পরান
ভরি উতরোলে; তারা শুনাক এবার
সমুদ্রতীরের তান, অজ্ঞাত রাজার
অগম্য রাজ্যের যত অপরূপ কথা,
সীমাশূন্য নির্জনের অপূর্ব বারতা।
আমরা কোথায় আছি, কোথায় সুদূরে
আমরা কোথায় আছি, কোথায় সুদূরে
দীপহীন জীর্ণভিত্তি অবসাদপুরে
ভগ্নগৃহে, সহস্রের ভ্রূকুটির নীচে
কুব্জপৃষ্ঠে নতশিরে, সহস্রের পিছে
চলিয়াছি প্রভুত্বের তর্জনী-সংকেতে
কটাক্ষে কাঁপিয়া–লইয়াছি শির পেতে
সহস্রশাসনশাস্ত্র।
সংকুচিত-কায়া
কাঁপিতেছে রচি নিজ কল্পনার ছায়া।
সন্ধ্যার আঁধারে বসি নিরানন্দ ঘরে
দীন-আত্মা মরিতেছে শত লক্ষ ডরে।
পদে পদে ত্রস্তচিত্তে হয়ে লুণ্ঠ্যমান
ধূলিতলে, তোমারে যে করি অপ্রমাণ।
যেন মোরা পিতৃহারা ধাই পথে পথে
অনীশ্বর অরাজক ভয়ার্ত জগতে।
আমার এ ঘরে আপনার করে
আমার এ ঘরে আপনার করে
গৃহদীপখানি জ্বালো।
সব দুখশোক সার্থক হোক
লভিয়া তোমারি আলো।
কোণে কোণে যত লুকানো আঁধার
মরুক ধন্য হয়ে,
তোমারি পুণ্য আলোকে বসিয়া
প্রিয়জনে বাসি ভালো।
আমার এ ঘরে আপনার করে
গৃহদীপখানি জ্বালো।
পরশমণির প্রদীপ তোমার
অচপল তার জ্যোতি,
সোনা করে নিক পলকে আমার
সব কলঙ্ক কালো।
আমার এ ঘরে আপনার করে
গৃহদীপখানি জ্বালো।
আমি যত দীপ জ্বালি শুধু তার
জ্বালা আর শুধু কালি,
আমার ঘরে দুয়ারে শিয়রে
তোমারি কিরণ ঢালো।
আমার এ ঘরে আপনার করে
গৃহদীপখানি জ্বালো।
আমার এ মানসের কানন কাঙাল
আমার এ মানসের কানন কাঙাল
শীর্ণ শুষ্ক বাহু মেলি বহু দীর্ঘকাল
আছে ক্রুদ্ধ ঊর্ধ্ব-পানে চাহি। ওহে নাথ,
এ রুদ্র মধ্যাহ্ন-মাঝে কবে অকস্মাৎ
পথিক পবন কোন্ দূর হতে এসে
ব্যগ্র শাখাপ্রশাখায় চক্ষের নিমেষে
কানে কানে রটাইবে আনন্দমর্মর,
প্রতীক্ষায় পুলকিয়া বনবনান্তর।
গম্ভীর মাভৈঃমন্দ্র কোথা হতে ব’হে
তোমার প্রসাদপুঞ্জ ঘনসমারোহে
ফেলিবে আচ্ছন্ন করি নিবিড়ছায়ায়।
তার পরে বিপুল বর্ষণ। তার পরে
পরদিন প্রভাতের সৌম্যরবিকরে
রিক্ত মালঞ্চের মাঝে পূজাপুষ্পরাশি
নাহি জানি কোথা হতে উঠিবে বিকাশি।
আমার সকল অঙ্গে তোমার পরশ
আমার সকল অঙ্গে তোমার পরশ
লগ্ন হয়ে রহিয়াছে রজনী-দিবস
প্রাণেশ্বর, এই কথা নিত্য মনে আনি
রাখিব পবিত্র করি মোর তনুখানি।
মনে তুমি বিরাজিছ, হে পরম জ্ঞান,
এই কথা সদা স্মরি মোর সর্বধ্যান
সর্বচিন্তা হতে আমি সর্বচেষ্টা করি
সর্বমিথ্যা রাখি দিব দূরে পরিহরি।
হৃদয়ে রয়েছে তব অচল আসন
এই কথা মনে রেখে করিব শাসন
সকল কুটিল দ্বেষ, সর্ব অমঙ্গল–
প্রেমেরে রাখিব করি প্রস্ফুট নির্মল।
সর্ব কর্মে তব শক্তি এই জেনে সার
করিব সকল কর্মে তোমারে প্রচার।
আমারে সৃজন করি যে মহাসম্মান
আমারে সৃজন করি যে মহাসম্মান
দিয়েছ আপন হস্তে, রহিতে পরান
তার অপমান যেন সহ্য নাহি করি।
যে আলোক জ্বালায়েছ দিবস-শর্বরী
তার ঊর্ধ্বশিখা যেন সর্ব-উচ্চে রাখি,
অনাদর হতে তারে প্রাণ দিয়া ঢাকি।
মোর মনুষ্যত্ব সে যে তোমারি প্রতিমা,
আত্মার মহত্ত্বে মম তোমারি মহিমা
মহেশ্বর!
সেথায় যে পদক্ষেপ করে,
অবমান বহি আনে অবজ্ঞার ভরে,
হোক-না সে মহারাজ বিশ্বমহীতলে
তারে যেন দণ্ড দিই দেবদ্রোহী বলে
সর্বশক্তি লয়ে মোর। যাক আর সব,
আপন গৌরবে রাখি তোমার গৌরব।
আমি ভালোবাসি, দেব, এই বাঙালার
আমি ভালোবাসি, দেব, এই বাঙালার
দিগন্তপ্রসার ক্ষেত্রে যে শান্তি উদার
বিরাজ করিছে নিত্য, মুক্ত নীলাম্বরে
অচ্ছায় আলোকে গাহে বৈরাগ্যের স্বরে
যে ভৈরবীগান, যে মাধুরী একাকিনী
নদীর নির্জন তটে বাজায় কিঙ্কিণী
তরল কল্লোলরোলে, যে সরল স্নেহ
তরুচ্ছায়া-সাথে মিশি স্নিগ্ধপল্লীগেহ
অঞ্চলে আবরি আছে, যে মোর ভবন
আকাশে বাতাসে আর আলোকে মগন
সন্তোষে কল্যাণে প্রেমে–
করো আশীর্বাদ,
যখনি তোমার দূত আনিবে সংবাদ
তখনি তোমার কার্যে আনন্দিতমনে
সব ছাড়ি যেতে পারি দুঃখে ও মরণে।
এ আমার শরীরের শিরায় শিরায়
এ আমার শরীরের শিরায় শিরায়
যে প্রাণ-তরঙ্গমালা রাত্রিদিন ধায়
সেই প্রাণ ছুটিয়াছে বিশ্বদিগ্বিজয়ে,
সেই প্রাণ অপরূপ ছন্দে তালে লয়ে
নাচিছে ভুবনে; সেই প্রাণ চুপে চুপে
বসুধার মৃত্তিকার প্রতি রোমকূপে
লক্ষ লক্ষ তৃণে তৃণে সঞ্চারে হরষে,
বিকাশে পল্লবে পুষ্পে– বরষে বরষে
বিশ্বব্যাপী জন্মমৃত্যুসমুদ্রদোলায়
দুলিতেছে অন্তহীন জোয়ার-ভাঁটায়।
করিতেছি অনুভব, সে অনন্ত প্রাণ
অঙ্গে অঙ্গে আমারে করেছে মহীয়ান।
সেই যুগযুগান্তের বিরাট স্পন্দন
আমার নাড়ীতে আজি করিছে নর্তন।
এ কথা মানিব আমি, এক হতে দুই
এ কথা মানিব আমি, এক হতে দুই
কেমনে যে হতে পারে জানি না কিছুই।
কেমনে যে কিছু হয়, কেহ হয় কেহ,
কিছু থাকে কোনোরূপে, কারে বলে দেহ,
কারে বলে আত্মা মন, বুঝিতে না পেরে
চিরকাল নিরখিব বিশ্বজগতেরে
নিস্তব্ধ নির্বাক্ চিত্তে।
বাহিরে যাহার
কিছুতে নারিব যেতে আদি অন্ত তার,
অর্থ তার, তত্ত্ব তার, বুঝিব কেমনে
নিমেষের তরে? এই শুধু জানি মনে
সুন্দর সে, মহান সে, মহাভয়ংকর,
বিচিত্র সে, অজ্ঞেয় সে, মম মনোহর।
ইহা জানি, কিছুই না জানিয়া অজ্ঞাতে
নিখিলের চিত্তস্রোত ধাইছে তোমাতে।