সকল গর্ব দূর করি দিব
সকল গর্ব দূর করি দিব,
তোমার গর্ব ছাড়িব না।
সবারে ডাকিয়া কহিব, যেদিন
পাব তব পদরেণুকণা।
তব আহ্বান আসিবে যখন
সে কথা কেমনে করিব গোপন?
সকল বাক্যে সকল কর্মে
প্রকাশিবে তব আরাধনা।
সকল গর্ব দূর করি দিব,
তোমার গর্ব ছাড়িব না।
যত মান আমি পেয়েছি যে কাজে
সেদিন সকলি যাবে দূরে।
শুধু তব মান দেহে মনে মোর
বাজিয়া উঠিবে এক সুরে।
পথের পথিক সেও দেখে যাবে
তোমার বারতা মোর মুখভাবে
ভবসংসারবাতায়নতলে
বসে রব যবে আনমনা।
সকল গর্ব দূর করি দিব,
তোমার গর্ব ছাড়িব না।
সে উদার প্রত্যুষের প্রথম অরুণ
সে উদার প্রত্যুষের প্রথম অরুণ
যখনি মেলিবে নেত্র প্রশান্তকরুণ,
শুভ্রশির অভ্রভেদী উদয়শিখরে,
হে দুঃখী জাগ্রত দেশ, তব কন্ঠস্বরে
প্রথম সংগীত তার যেন উঠে বাজি
প্রথম ঘোষণাধ্বনি।
তুমি থেকো সাজি
চন্দনচর্চিত স্নাত নির্মল ব্রাহ্মণ,
উচ্চশির ঊর্ধ্বে তুলি গাহিয়ো বন্দন–
“এসো শান্তি, বিধাতার কন্যা ললাটিকা,
নিশাচর পিশাচের রক্তদীপশিখা
করিয়া লজ্জিত।’ তব বিশাল সন্তোষ
বিশ্বলোকে-ঈশ্বরের রত্নরাজকোষ।
তব ধৈর্য দৈববীর্য। নম্রতা তোমার
সমুচ্চ মুকুটশ্রেষ্ঠ, তাঁরি পুরস্কার।
সে পরম পরিপূর্ণ প্রভাতের লাগি
সে পরম পরিপূর্ণ প্রভাতের লাগি,
হে ভারত, সর্বদুঃখে রহো তুমি জাগি
সরলনির্মলচিত্ত– সকল বন্ধনে
আত্মারে স্বাধীন রাখি, পুষ্প ও চন্দনে
আপনার অন্তরের মাহাত্ম্যমন্দির
সজ্জিত সুগন্ধি করি, দুঃখনম্রশির
তাঁর পদতলে নিত্য রাখিয়া নীরবে।
তাঁ’ হতে বঞ্চিত করে তোমারে এ ভবে
এমন কেহই নাই– সেই গর্বভরে
সর্বভয়ে থাকো তুমি নির্ভয় অন্তরে
তাঁর হস্ত হতে লয়ে অক্ষয় সম্মান।
ধরায় হোক-না তব যত নিম্ন স্থান
তাঁর পাদপীঠ করো সে আসন তব
যাঁর পাদরেণুকণা এ নিখিল ভব।
সেই তো প্রেমের গর্ব ভক্তির গৌরব
সেই তো প্রেমের গর্ব ভক্তির গৌরব।
সে তব অগমরুদ্ধ অনন্ত নীরব
নিস্তব্ধ নির্জন-মাঝে যায় অভিসারে
পূজার সুবর্ণথালি ভরি উপহারে।
তুমি চাও নাই পূজা, সে চাহে পূজিতে–
একটি প্রদীপ হাতে রহে সে খুঁজিতে
অন্তরের অন্তরালে। দেখে সে চাহিয়া,
একাকী বসিয়া আছ ভরি তার হিয়া।
চমকি নিবায়ে দীপ দেখে সে তখন
তোমারে ধরিতে নারে অনন্ত গগন।
চিরজীবনের পূজা চরণের তলে
সমর্পন করি দেয় নয়নের জলে।
বিনা আদেশের পূজা, হে গোপনচারী,
বিনা আহ্বানের খোঁজ–সেই গর্ব তারি।
স্বার্থের সমাপ্তি অপঘাতে অকস্মাৎ
স্বার্থের সমাপ্তি অপঘাতে। অকস্মাৎ
পরিপূর্ণ স্ফীতি-মাঝে দারুণ আঘাত
বিদীর্ণ বিকীর্ণ করি চূর্ণ করে তারে
কালঝঞ্ঝাঝংকারিত দুর্যোগ-আঁধারে।
একের স্পর্ধারে কভু নাহি দেয় স্থান
দীর্ঘকাল নিখিলের বিরাট বিধান।
স্বার্থ যত পূর্ণ হয় লোভক্ষুধানল
তত তার বেড়ে ওঠে– বিশ্বধরাতল
আপনার খাদ্য বলি না করি বিচার
জঠরে পুরিতে চায়। বীভৎস আহার
বীভৎস ক্ষুধারে করে নির্দয় নিলাজ–
তখন গর্জিয়া নামে তব রুদ্র বাজ।
ছুটিয়াছে জাতিপ্রেম মৃত্যুর সন্ধানে
বাহি স্বার্থতরী, গুপ্ত পর্বতের পানে।
হে অনন্ত, যেথা তুমি ধারণা-অতীত
হে অনন্ত, যেথা তুমি ধারণা-অতীত
সেথা হতে আনন্দের অব্যক্ত সংগীত
ঝরিয়া পড়িছে নামি, অদৃশ অগম
হিমাদ্রিশিখর হতে জাহ্নবীর সম।
সে ধ্যানাভ্রভেদী শৃঙ্গ, যেথা স্বর্ণলেখা
জগতের প্রাতঃকালে দিয়েছিল দেখা
আদি অন্ধকার-মাঝে, যেথা রক্তচ্ছবি
অস্ত যাবে জগতের শ্রান্ত সন্ধ্যারবি
নব নব ভুবনের জ্যোতির্বাষ্পরাশি
পুঞ্জ পুঞ্জ নীহারিকা যার বক্ষে আসি
ফিরিছে সৃজনবেগে মেঘখন্ডসম
যুগে যুগান্তরে–চিত্তবাতায়ন মম
সে অগম্য অচিন্ত্যের পানে রাত্রিদিন
রাখিব উন্মুক্ত করি হে অন্তবিহীন।
হে দূর হইতে দূর, হে নিকটতম
হে দূর হইতে দূর, হে নিকটতম,
যেথায় নিকটে তুমি সেথা তুমি মম,
যেথায় সুদূরে তুমি সেথা আমি তব।
কাছে তুমি নানা ভাবে নিত্য নব নব
সুখে দুঃখে জনমে মরণে। তব গান
জল স্থল শূন্য হতে করিছে আহ্বান
মোরে সর্ব কর্ম-মাঝে– বাজে গূঢ়স্বরে
প্রহরে প্রহরে চিত্তকুহরে কুহরে
তোমার মঙ্গলমন্ত্র।
যেথা দূর তুমি
সেথা আত্মা হারাইয়া সর্ব তটভূমি
তোমার নিঃসীম-মাঝে পূর্ণানন্দভরে
আপনারে নিঃশেষিয়া সমর্পণ করে।
কাছে তুমি কর্মতট আত্মা-তটিনীর,
দূরে তুমি শান্তিসিন্ধু অনন্ত গভীর।
হে ভারত, তব শিক্ষা দিয়েছে যে ধন
হে ভারত, তব শিক্ষা দিয়েছে যে ধন,
বাহিরে তাহার অতি অল্প আয়োজন,
দেখিতে দীনের মতো, অন্তরে বিস্তার
তাহার ঐশ্বর্য যত।
আজি সভ্যতার
অন্তহীন আড়ম্বরে, উচ্চ আস্ফালনে,
দরিদ্ররুধিরপুষ্ট বিলাসলালনে,
অগন্য চক্রের গর্জে মুখরঘর্ঘর,
লৌহবাহু দানবের ভীষণ বর্বর
রুদ্ররক্ত-অগ্নিদীপ্ত পরম স্পর্ধায়
নিঃসংকোচে শান্তচিত্তে কে ধরিবে, হায়,
নীরবগৌরব সেই সৌম্য দীনবেশে
সুবিরল,নাহি যাহে চিন্তাচেষ্টালেশ?
কে রাখিবে ভরি নিজ অন্তর-আগার
আত্মার সম্পদরাশি মঙ্গল উদার?
হে ভারত, নৃপতিরে শিখায়েছ তুমি
হে ভারত, নৃপতিরে শিখায়েছ তুমি
ত্যজিতে মুকট দণ্ড সিংহাসন ভূমি,
ধরিতে দরিদ্রবেশ; শিখায়েছ বীরে
ধর্মযুদ্ধে পদে পদে ক্ষমিতে অরিরে,
ভুলি জয়-পরাজয় শর সংহরিতে।
কর্মীরে শিখালে তুমি যোগযুক্ত চিতে
সর্বফলস্পৃহা ব্রহ্মে দিতে উপহার।
গৃহীরে শিখালে গৃহ করিতে বিস্তার
প্রতিবেশী আত্মবন্ধু অতিথি অনাথে।
ভোগেরে বেঁধেছ তুমি সংযমের সাথে,
নির্মল বৈরাগ্যে দৈন্য করেছ উজ্জ্বল,
সম্পদের পুণ্যকর্মে করেছ মঙ্গল,
শিখায়েছ স্বার্থ ত্যজি সর্ব দুঃখে সুখে
সংসার রাখিতে নিত্য ব্রহ্মের সম্মুখে।